প্রত্যক মানুষের স্বপ্ন থাকে নিজের সুন্দর একটি বাড়ি থাকবে। এক্ষেত্রে রাজধানী সকলের প্রথম পছন্দ। কিন্তু ঢাকাতে আবাসনের জায়গা স্বল্পতা ও ব্যয়বহুল হওয়ায় বেশিরভাগ মানুষ স্বপ্ন দেখেন অন্তত সুন্দর একটি ফ্ল্যাট কেনার। আর এই ফ্ল্যাট কিনতে গিয়ে অনেক সময় দেখা যায় ডেভেলপার কোম্পানি সময়মত ফ্ল্যাট রেজিস্ট্রেশন করে দিচ্ছে না, তখনই শুরু হয় ভোগান্তি। অনেকেই দেশের বাইরে থেকেও ফ্ল্যাট ক্রয় করেন যাতে করে স্বদেশের আপন নিবাসে শান্তিতে কয়েকটি দিন কাটাতে পারেন। অথচ কিছু অসাধু ডেভেলপার কোম্পানি এদের দেশে না থাকার অসহায়ত্বকে কাজে লাগিয়ে নানা ধরনের হয়রানি করেন। তবে হতাশ হবার কারণ নেই। ফ্ল্যাট রেজিস্ট্রেশন বা দখল না বুঝিয়ে দিলে আছে আইনি প্রতিকার।
ফ্ল্যাট/ভূমি রেজিস্ট্রেশন কি
আমরা জীবনের প্রয়োজনে সম্পত্তি ক্রয়-বিক্রয় করে থাকি। আর এই ক্রয়-বিক্রয়কে স্থায়ী এবং নিজের মালিকানায় আনতে গিয়ে রেজিস্ট্রেশন আইনের উদ্ভব হয়েছে। রেজিস্ট্রিকরণের অন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য হলো, স্থাবর সম্পত্তির ক্রেতাদের স্বত্ত্বের অবস্থা নির্ণয়ের অবলম্বন প্রদান করা। রেজিস্ট্রেশন হলো- স্বত্ত্বের নিশ্চয়তা প্রদান করা ও জাল-জালিয়াতি ও গোপনীয় আদান-প্রদান প্রতিরোধ করা এবং একটি সম্পত্তিতে একজন ব্যক্তির এরূপভাবে অর্জিত স্বত্ত্ব পরাভূত করা।
ফ্ল্যাট রেজিষ্ট্রেশন না করে দিলে আইনি প্রতিকার
রিয়েল এস্টেট উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা আইন, ২০১০- এর ধারা ৯ অনুযায়ী রিয়েল এস্টেট এর মূল্য পরিশোধ হবার পর ডেভেলপার অনুর্ধ্ব ৩ মাসের মধ্যে ক্রেতাকে রিয়াল এস্টেট এর দখল, দলিল সম্পাদন ও রেজিস্ট্রেশন করে দিবে। কিন্তু অনেক সময় দেখা যায় তারা বিভিন্ন কারণ দেখিয়ে রেজিস্ট্রেশন করতে অনিহা প্রকাশ করে থাকে, আর তখন যেন ক্রেতার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ে। দিশেহারা হয়ে ক্রেতা, কি করবেন আর কি না করবেন, ভেবে পান না কিছুই!
যেসব কারণে ডেভেলপার কোম্পানি ফ্ল্যাট রেজিস্ট্রেশন করতে গড়িমসি করতে পারে
- ডেভেলপার কোম্পানি যদি ফ্ল্যাটটি ব্যাংকের কাছে বন্ধক রাখে
- ডেভেলপার কোম্পানি যদি ফ্ল্যাটটি অন্যকারো কাছে বিক্রি করে দিয়ে থাকে, অথবা
- ডেভেলপার কোম্পানি কোন প্রতারক চক্রের সাথে জড়িত
রিয়েল এস্টেট উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা আইন, ২০১০-এর ৩৬ ধারায় বলা আছে, ডেভেলপার এবং ক্রেতার সাথে চুক্তির কোন বিধান লঙ্ঘনের জন্য মতবিরোধ সৃষ্টি হলে প্রথমে আপোষ-মীমাংসার মাধ্যমে সমাধান করার চেষ্টা করবে। কোন পক্ষের মাধ্যমে যদি আপোষ-মীমাংসায় সমাধান না হয় তবে এ সমস্যা নিষ্পত্তির জন্য সালিস আইন, ২০০১ অনুযায়ী ট্রাইব্যুনাল গঠন করার জন্য নোটিশ প্রদান করবে। নোটিশ প্রাপক নোটিশ পাওয়ার ৩০ দিনের মধ্যে সালিস ট্রাইবুনাল গঠন করবেন। চুক্তিতে যদি সালিসি দফা (Arbitration clause) থাকে বা আপনি এমন শর্তে স্বাক্ষর (sign) করেন তবে প্রথমে মধ্যস্থতার (Arbitration) মাধ্যমেই আপনাকে আগাতে হবে। যদিও এই কার্যক্রম দীর্ঘদিন ধরে চলমান থাকে এবং ব্যয়বহুল। তাই ক্রেতার কখনো সালিসি দফায় (Arbitration clause) এ সহমত হওয়া উচিৎ নয়।
যেহেতু রিয়েল এস্টেট উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা আইন, ২০১০ অনুযায়ী এবং সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইন ১৮৭৭ এর ২২(ক) ধারা মতে ডেভেলপারের বিরুদ্ধে কোনো দেওয়ানি মামলা করা যায় না, তাই পেনাল কোড ১৮৬৫ সালের ৪২০ ধারা অনুযায়ী প্রতারণার মামলা করা যায়। তবে রিয়েল এস্টেট উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা আইনের ১৫ এবং ২৭ ধারায় ফৌজদারী মামলা করা যাবে। এক্ষেত্রে ৩৬ ধারার কার্যক্রম শেষ না করে অন্য কোন আদালতে মামলা করা যাবে না।
তবে আরেকটি প্রতিকার আছে যার সুফল পাওয়া গিয়েছে। বেশকিছুদিন আগে অত্র রিয়েল এস্টেট উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা আইন, ২০১০- এর ধারা ৩৬, সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইনের ২১ (ক) ধারা, তামাদি আইনের প্রথম তফসিলের ১১৩ এবং ১১৪ অনুচ্ছেদের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে সংবিধানের ১০২(১) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী অন্তর্বর্তীকালীন প্রতিকার (interim relief) চাওয়া হয়েছিল এবং সেই মামলায় মহামান্য হাইকোর্ট সরকারের প্রতি রুল ইস্যু করেছিল এবং ডেভেলপারের কাছে ব্যাখ্যা চাওয়া হয়েছিল “চুক্তির শর্তানুযায়ী ফ্ল্যাটের সম্পূর্ণ টাকা পরিশোধ হবার পরেও কেন রেজিস্ট্রেশন করে দেওয়া হবে না, তা দুই সপ্তাহের মধ্যে জানতে চাওয়া হয়েছিল এবং ডেভেলপার কোম্পানির সঠিক উত্তর না দিতে পারায় পরবর্তী ১ মাসের মধ্যে ক্রেতার নামে ফ্ল্যাট রেজিস্ট্রেশন করে দেওয়ার আদেশ দেন আদালত।
ফ্ল্যাট দখল
চুক্তি অনুযায়ী অনুযায়ী ডেভেলপারের কার্যক্রম শেষ হওয়া মাত্র বা শেষ হলে ক্রেতাকে তার দখল বুজিয়ে দেবে বা তাকে ফ্ল্যাট বুঝিয়ে দিতে নোটিশ করবে। আর তা যদি ডেভেলপার কোম্পানি না করে তবে নিজ উদ্যোগে তাদের ডাকযোগে নোটিশ দিতে হবে। রিয়েল এস্টেট উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা আইন, ২০১০-এর ১৫ ধারা অনুযায়ী, ‘চুক্তি অনুযায়ী নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ডেভেলপার রিয়েল এস্টেট হস্তান্তরে ব্যর্থ হইলে রিয়েল এস্টেট এর মূল্য বাবদ পরিশোধিত সমুদয় অর্থ চুক্তিতে নির্ধারিত পরিমাণ ক্ষতিপূরণসহ ৬ (ছয়) মাসের মধ্যে প্রাপকের হিসাবে প্রদেয় (account payee) চেকের মাধ্যমে ফেরৎ প্রদান করিবে।’
যেকোন ডেভেলপার কোম্পানির প্রজেক্টের কাজ শেষ হবার পরে দায়িত্ব হল তার দখল বুজিয়ে দেওয়ার জন্য নোটিশ করা। তবে মাঝে মাঝে দেখা যায় কোম্পানি তা না করে নানা প্রকার ঝামেলা সৃষ্টি করে। এক্ষেত্রে ক্রেতার উচিৎ ডেভেলপার কোম্পানিকে দখল হস্তান্তর করার জন্য চিঠি প্রদান করা। এই চিঠি বা নোটিশটি সেটি দিতে হবে ডাকযোগে।
রিয়েল এস্টেট উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা আইন, ২০১০ ক্রেতার অধিকারকে অনেকটা লাঘব করেছে কারণ এই আইন দিয়ে ক্রেতার অধিকার আদায় করা কঠিন, সময় সাপেক্ষ এবং ব্যয়বহুল। তাই ক্রেতার উচিৎ ফ্ল্যাট ক্রয় করার আগে ডেভেলপার কোম্পানির সমস্ত কাগজপত্র ভালভাবে যাচাই-বাছাই করে নেওয়া। এক্ষেত্রে নিজে বুঝতে না পারলে একজন আইনজীবীর পরামর্শ নিয়ে ফ্ল্যাট বুকিং দেওয়া উচিত।
রীনা পারভিন মিমি : অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট ও সহযোগী সম্পাদক- ল’ইয়ার্স ক্লাব বাংলাদেশ ডটকম। Email- rinaparvinmimi18@gmail.com