দোষী না নির্দোষ তা জানার আগেই কারাগারে কেটেছে ২২ বছর। শেষ পর্যন্ত নির্দোষ প্রমাণ হওয়ায় খালাস পেলেন খুলনার শীর্ষ সন্ত্রাসী এরশাদ শিকদারের দুই সহযোগী জামাই ফারুক ও ইদ্রিস জামাই।
তাদের বিরুদ্ধে অপরাধ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত না হওয়ায় আজ সোমবার (২১ সেপ্টেম্বর) ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৯ এর বিচারক শেখ হাফিজুর রহমান এ রায় দেন।
তবে এই মামলার অন্য দুই আসামির মধ্যে জয়নালকে মৃত্যুদণ্ড ও রুস্তমকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। মৃত্যুদণ্ডের পাশাপাশি জয়নালকে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে। আর যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্ত রুস্তমকে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও ৬ মাসের কারাদণ্ড দেয়াও হয়। আরেকটি অভিযোগে এই দু’জনকে পাঁচ বছর করে কারাদণ্ড এবং ৩০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড করা হয়েছে। দণ্ডপ্রাপ্ত দুই আসামি পলাতক।
রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন এই মামলার খালাস পাওয়া দুই আসামির আইনজীবী আমিনুল গণী টিটো। তিনি বলেন, দীর্ঘদিন এই দুই আসামি কারাগারে। তারা দোষী বা নির্দোষ যাই হোক আমরা চাইছিলাম মামলাটি নিষ্পত্তি হোক। শেষ পর্যন্ত তারা খালাস পেয়েছেন। ২২ বছর কারাগারে থাকার পরও তারা ন্যায়বিচার পেয়েছেন। আমি এই রায়ে সন্তুষ্ট।
এই আসামিরা যেহেতু শীর্ষ সন্ত্রাসী এরশাদ শিকদারের সহযোগী, তাদের বিরুদ্ধে আর কোনো মামলা আছে কি-না জানতে চাইলে আইনজীবী আমিনুল গণী টিটো বলেন, আমি একটি মামলায়ই তাদের পক্ষে ছিলাম। অন্য কোনো মামলা আছে কিনা জানা নেই। অন্য কোনো মামলা না থাকলে তারা এখন মুক্তি পাবেন।
অপরদিকে এরশাদ শিকদারের দুই সহযোগীর খালাসের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা হবে কিনা জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) আব্দুল্লাহ আবু বলেন, আমরা পূর্ণাঙ্গ রায়টি দেখবো। তারপর যদি মনে হয় আপিল করলে কোনো বেনিফিট পাওয়া যাবে তবে আমরা আপিল করবো।
মামলার নথি সূত্রে জানা যায়, ১৯৯৮ সালের ৫ মার্চ সকাল ৭টায় আজিজ চাকলাদার ওরফে ঢাকাইয়া আজিজ লালবাগ রোডের বাসা থেকে খুলনা যাওয়ার পথে নিখোঁজ হয়েছিলেন। আজিজকে খুঁজে না পেয়ে ছোট ভাই মো. বাচ্চু মিয়া লালবাগ থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। জিডির ১২ দিন পর ১৭ মার্চ বাচ্চু একটি অপহরণ মামলা করেন। যেখানে মাকসুদ এবং আনুল্লাহ নামে দু’জনকে আসামি করা হয়।
মামলার এজাহারে বলা হয়, মাকসুদ ও আমানুল্লাহর সঙ্গে ভাঙা কাচের ব্যবসা করতেন আব্দুল আজিজ চাকলাদার। তারা দু’জন আজিজের কাছে ব্যবসায়িক কারণে ২৫ হাজার টাকা পেতেন। এই টাকা লেনদেন কেন্দ্র করে তাদের মধ্যে কথা কাটাকাটি ও ঝগড়া হয়। এ কারণে মাকসুদ ও আমানুল্লাহ তাকে অপহরণ করে নিয়ে যায়।
২০০০ সালের ৪ এপ্রিল লালবাগ থানার তৎকালীন উপপরিদর্শক (এসআই) মো. আব্দুর রাকিব খান অভিযোগপত্র দাখিল করেন। অভিযোগপত্রে মোট সাতজনকে আসামি করা হলেও প্রাথমিক তথ্য বিবরণীতে থাকা দুই আসামি মাকসুদ ও আমানুল্লাহকে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।
যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেওয়া হয় তারা হলেন- খুলনার শীর্ষ সন্ত্রাসী এরশাদ শিকদার, লস্কর মোহাম্মদ লিয়াকত, মো. নূরে আলম, ইদ্রিস, জয়নাল, জামাই ফারুক ও মো. রুস্তম আলী। এর মধ্যে কুখ্যাত সন্ত্রাসী এরশাদ শিকদারের অন্য এক মামলায় ২০০৪ সালের ১০ মে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। আসামি লস্কর মো. লিয়াকত বিচার চলাকালে মারা যাওয়ায় তাকে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। আসামি নূরে আলমকে রাষ্ট্রপক্ষ রাজসাক্ষী হিসেবে আদালতে উপস্থাপন করে। তাই বিচারে সোপর্দ করা হয় চারজন আসামিকে।
এই মামলার তদন্ত চলাকালে রূপসা নদী থেকে একটি মাথার খুলি ও হাড্ডি উদ্ধার করা হয়। খালিশপুর থানার অন্য একটি মামলার জব্দ তালিকা থেকে প্রাপ্ত ওই মাথার খুলি ও হাড্ডি ঢাকাইয়া আজিজের বলে তদন্ত কর্মকর্তা অভিযোগপত্রে উল্লেখ করেন।
তবে এই মামলায় কারাগারে থাকা দুই আসামি জামাই ফারুক ও ইদ্রিসের আইনজীবী আমিনুল গণি টিটো বলেন, আমরা আদালতে বলেছি ঢাকাইয়া আজিজের কোনো মরদেহ উদ্ধার করা যায়নি। উদ্ধার হওয়া মাথার খুলি ও হাড্ডির কোনো সুরতহাল, ময়নাতদন্ত বা ডিএনএ টেস্ট না করেই সেটিকে আজিজের বলে চালিয়ে দেওয়া হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, আমরা তদন্ত কর্মকর্তাকে সাক্ষ্যের সময় জেরা করেছিলাম, ১৯৯৮-৯৯ সালে রূপসা নদীতে কয়টি নৌকাডুবি হয়েছে বা তাতে কেউ হতাহত হয়েছে কিনা সেগুলো কি নোট নিয়েছিলেন? তিনি তা বলতে পারেননি। তাছাড়া রাজসাক্ষী হিসেবে উপস্থাপন করা নূরে আলমও এই আসামিদের নাম বলেননি। সার্বিক বিবেচনায় আদালত এই দু’জনকে খালাস দিয়েছেন। আমরা রায়ে সন্তুষ্ট।
২০০০ সালেই এই মামলার অভিযোগ গঠন হয়। অভিযোগ গঠনের আদেশকে চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে যান আসামিরা। এরপর হাইকোর্ট মামলার বিচার কার্যক্রমের উপর স্থগিতাদেশ দেন। ২০১৭ সালে হাইকোর্টের স্থগিতাদেশ উঠে গেলে এই মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়। অভিযোগপত্রে থাকা ১৯ সাক্ষীর মধ্যে ৬ জন এবং রাজসাক্ষী হিসেবে নূরে আলম আদালতে সাক্ষ্য দেন। এরপর গত ১৪ জানুয়ারি উভয়পক্ষের যুক্তিতর্ক শুনানি শেষ হয়। সোমবার রায় ঘোষণার মধ্য দিয়ে দীর্ঘ ২২ বছর আগের এই হত্যাকাণ্ডের বিচারকাজ শেষ হলো। সূত্র- বাংলানিউজ