রতন কুমার রায়: আইন কমিশন কর্তৃক প্রস্তাবিত বাংলাদেশ ভূমি আইন, ২০২০ প্রণয়ন পরবর্তীতে বিভিন্ন মাধ্যমে ব্যাপকভাবে জনমত গঠনের উদ্যোগ গ্রহণ সত্যিই অভিনন্দন পাওয়ার যোগ্য। প্রস্তাবিত আইনে বেশ কিছু অধ্যায় যুগোপযোগী ও যৌক্তিক হলেও বিচারপ্রার্থী জনগণের দেওয়ানী অধিকার (Civil Rights) ও উচ্চ আদালতসহ দেওয়ানী আদালতের (Civil Court) এখতিয়ার প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের উপর স্থানান্তরিত করার প্রস্তাবিত বিধানাবলী সভ্যতা, নৈতিকতা ও ন্যায় বিচারের মাপকাঠিতে আদৌ গ্রহণযোগ্য নয়।
প্রস্তাবিত আইনের ২৭৩ ধারায় “রহিতকরণ ও হেফাজত” অংশে প্রচলিত অনেক গুরুত্বপূর্ণ আইনকে পরিপূর্ণ ও আংশিকভাবে রহিত করণের কথা উল্লেখ করা হলেও প্রস্তাবিত আইনে তৎসংক্রান্ত বিধানাবলী বা ব্যাখ্যা উপস্থাপিত হয় নাই। আইনের ৬ষ্ঠ অধ্যায়ে ৯১ ও ৯৩ ধারায় তিন ফসলী কৃষি জমি সুরক্ষা করা এবং সেখানে আবাসন উন্নয়নসহ অনুৎপাদনশীল খাতে ফসলি জমির অসংগত রূপান্তর নিষিদ্ধ করা হয়েছে এবং কৃষিযোগ্য ভূমিতে ইটখোলা নির্মাণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। অনুরূপভাবে এই অধ্যায়ের ১০৩ ধারায় নাজুক প্রতিবেশ ব্যবস্থা (Fragile ecosystem) সংরক্ষণের জন্য ভূমি ব্যবহার বিষয়ক পরিবেশগত সচেতনতা বৃদ্ধি করা ও মৎস্য ক্ষেত্র, বনাঞ্চল, জলাশয়, উপকূলীয় এলাকা সুরক্ষার বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে। অপর দিকে দুর্নীতি ও অস্বচ্ছতায় আকন্ঠ নিমজ্জিত অধিগ্রহণ ও হুকুম দখল সংক্রান্ত বিরোধ নিষ্পত্তির লক্ষ্যে ১৪২ ধারায় যুগ্ম জেলা জজ পদমর্যাদার একজন বিচার বিভাগীয় ব্যক্তিকে সালিশদার (Arbitrator) নিয়োগের বিধান করাসহ উপরোক্ত প্রস্তাবিত বিধানাবলী নিঃসন্দেহে ভাল প্রস্তাব।
প্রস্তাবিত আইনের ১৭, ৩৬, ৪৮ ও ১৭৬ ধারায় ভূমি জরীপ ও রেকর্ড, চূড়ান্ত প্রকাশিত খতিয়ান, সেটেলমেন্ট কর্মকর্তার কার্যাবলী ও সরকারী জমি সম্পর্কে দেওয়ানী আদালতে প্রশ্ন উত্থাপন করা যাবে না এবং দেওয়ানী আদালতের রায়-ডিক্রী অগ্রহণযোগ্য হবে এবং সেটেলমেন্ট অফিসাররা সংশ্লিষ্ট কার্যাবলী সম্পাদনকালে দেওয়ানী আদালতের ন্যায় সকল ক্ষমতার অধিকারী হবেন মর্মে উল্লেখ করা হয়েছে। আইনের ১৬তম অধ্যায়ের ২৭১ ধারায় প্রস্তাবিত আইনের বা তদধীন প্রণীত বিধির অধীনে প্রদত্ত কোন আদেশ বা গৃহীত ব্যবস্থার বিরুদ্ধে কোনরূপ দেওয়ানী মোকদ্দমা দায়ের করা যাবে না এবং কোনরূপ নিষেধাজ্ঞার আদেশ প্রদান করা যাবে না মর্মে উল্লেখ করা হয়। আইনের ২৬৩ ধারায় ভূমি সংক্রান্ত বিভিন্ন প্রকার বিরোধ নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে প্রস্তাবিত আইনের বিধানাবলী কার্যকরী হবে মর্মে উল্লেখ করা হয়। যাতে উচ্চ আদালতসহ দেওয়ানী আদালতের এখতিয়ার ক্ষুণ্ণ করা হবে।
প্রস্তাবিত আইনের ২৬৪ ধারায় ভূমি রেকর্ড, বন্টন, সীমানা বিরোধ, অবৈধ দখল ও জবর দখল সংক্রান্ত বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য অতিরিক্ত জেলা প্রশাসকের নেতৃত্বে সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও সংশ্লিষ্ট সেটেলমেন্ট অফিসারের সমন্বয়ে একটি ট্রাইব্যূনাল গঠনের বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে। যা শুধু অগ্রহণযোগ্য নয়; নিন্দনীয় প্রস্তাবও বটে। কারণ উক্ত প্রস্তাব দ্বারা বিচার বিভাগের বিচারিক ক্ষমতা ও এখতিয়ারকে প্রশাসন বিভাগের উপর ন্যস্ত করার
জন্য প্রস্তাব করা হয়েছে। ভূমি প্রশাসনের দীর্ঘদিনের দুর্নীতি ও হয়রানী প্রতিরোধ করার জন্য যেখানে বাধ্য হয়ে সরকার অনেক ক্ষেত্রে ডিজিটাল সিস্টেম (Digital Based Management System) চালু করে, সেখানে তাদের উপর উল্লেখিত বিচারিক ক্ষমতা অর্পিত হলে দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনা বহু মাত্রিকতা লাভ করবে। অপরদিকে সভ্যতা, বিচারপ্রার্থী জনগণ ও দেওয়ানী আদালত ভয়ানক ভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হবে। এটি বিচার বিভাগের উপর প্রশাসন বিভাগের একটি নগ্ন হস্তক্ষেপ হিসাবে বিবেচিত হবে। ল’ ব্যাকগ্রাউন্ড (Law background) ছাড়া প্রশাসনিক কর্মকর্তারা বিচারকে প্রহসনে পরিণত করার সুযোগ পাবে। সরকার পার্বত্য জেলা সমূহে জনগণের দেওয়ানী অধিকার (Civil Rights) সংরক্ষণে সম্প্রতি নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচারিক ক্ষমতা দেওয়ানী আদালতের (Civil Court) উপর ন্যস্ত করেছে। কিন্তু আকস্মিকভাবে দেশের দেওয়ানী আদালতের এখতিয়ার নির্বাহী বিভাগের উপর ন্যস্ত করণের প্রস্তাবিত আইন রহস্যজনক।
প্রস্তাবিত আইনের ২৭৩ ধারায় রহিতকরণ ও হেফাজত অংশে The Non-Agricultural Tenancy Act, 1949 and all amendments এবং The State Acquisition and Tenancy Act, 1950 and all amendments রহিত করার জন্য প্রস্তাব করা হলেও সংশ্লিষ্ট আইনগুলিতে বিদ্যমান বিধানাবলী সম্পর্কে কোনরূপ সংশোধনীর জন্য প্রস্তাব করা হয় নাই। আবার প্রস্তাবিত আইনের ৭৪ ধারায় অগ্রক্রয় বা (Pre-emption) সংক্রান্ত ভূমি খন্ডের সম্পূর্ণ বা আংশিক বিক্রীত হলে শরীকদার কর্তৃক অগ্রক্রয় মামলা দায়ের করার অধিকার প্রদান করা হয়েছে। একই ধারার ১৭ উপধারায় এই ধারার কোন কিছুই বাস্তভিটার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না মর্মে উল্লেখ করা হয়। তাহলে অনুমিত হয় যে, প্রস্তাবিত ৭৪ ধারাটি কৃষি ভূমির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে। কিন্তু কৃষি ভূমির ক্ষেত্রে “ভূমিখন্ড” (Land) বিষয়টি বিবেচিত হয় না; বরঞ্চ কৃষি জমির ক্ষেত্রে “হোল্ডিং” শব্দটি প্রযোজ্য হয় এবং হোল্ডিংয়ের শরীকগণ অগ্রক্রয়ের মামলা দায়ের করতে অধিকারী হন। সুতরাং প্রস্তাবিত ৭৪ ধারাটি পরস্পর বিরোধী ও বেআইনী হয়। SAT ACT ও NAT ACT এর প্রস্তাবিত রহিতকরণ এই ক্ষেত্রে দুুর্বোধ্য হয়।
প্রস্তাবিত আইনে দি ওয়াক্ফ অর্ডিনেন্স (The Waqfs Ordinance), ১৯৬২ এর সংশ্লিষ্ট ধারাসমূহ রহিত করার জন্য প্রস্তাব করা হয়েছে। কিন্তু প্রস্তাবিত আইনের ২৬১ ধারায় ওয়াক্ফ বা দেবোত্তর বা ট্রাস্ট সম্পত্তির বিরোধ নিষ্পত্তির যাবতীয় দায়িত্ব জেলা প্রশাসকের উপর অর্পণ করা হয়েছে। যাতে ওয়াক্ফ প্রশাসক ও জেলা প্রশাসকের মধ্যে এখতিয়ার সম্পর্কিত বিরোধ সৃষ্টি হইবার সম্ভাবনা আছে। অপর দিকে দেবোত্তর সম্পত্তি ব্যবস্থাপনা সংক্রান্তে ওয়াক্ফ প্রশাসনের ন্যায় কোনরূপ প্রশাসন ও ব্যবস্থাপনার জন্য বিধানাবলী নাই। সেক্ষেত্রে জেলা প্রশাসক কোন আইন ও নীতি মালার ভিত্তিতে দেবোত্তর সম্পত্তির বিরোধ নিষ্পত্তি করিবেন তা প্রস্তাবিত আইনে অনুপস্থিত। প্রস্তাবিত আইনে অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যার্পণ আইন, ২০০১ এবং সর্বশেষ সংশোধনী রহিত করার জন্য প্রস্তাব করা হয়। আবার প্রস্তাবিত আইনের ২৪৯ ধারায় শুধুমাত্র যে সকল অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যার্পিত হবে না বা কোন মালিক/দাবিদার পাওয়া যাবে না বা ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক দাবী নামঞ্জুর হবে সেই সকল সম্পত্তি সরকার বরাবরে সমর্পিত হয়ে খাস জমি হিসাবে গণ্য হইবে মর্মে উল্লেখ করা হয়। এখন প্রশ্ন হল, সর্বশেষ সংশোধনীসহ অর্পিত সম্পত্তি আইন রহিত হলে বিচারাধীন মামলা সমূহ ট্রাইব্যুনালে কোন আইনের ভিত্তিতে পরিচালিত হবে কিংবা প্রকৃত মালিক/দাবীদারগণ কোন আইনের ভিত্তিতে প্রত্যার্পণ পাবে তার কোন বিধান প্রস্তাবিত আইনে বিধৃত করা হয় নাই। উল্লেখ্য যে, এই আইনটির Immediate Effect দেওয়া হয়েছে।
আমি ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বাস করি বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও এখতিয়ার এবং বিচারপ্রার্থী জনগণের দেওয়ানী অধিকার সমুন্নত রাখার জন্য উপরে বর্ণিত প্রস্তাবিত বিধানাবলীর অসংগতি নিরসন করা প্রয়োজন এবং বিচার বিভাগের ক্ষমতা খর্ব করিয়া প্রশাসনের উপর ন্যাস্ত করার প্রস্তাবিত বিধানাবলী বাতিল করার কোন বিকল্প নাই। অন্যথায় বিচার বিভাগের স্বাধীনতার জন্য এই দেশের আইনজীবী সমাজ যে ভাবে আন্দোলন-সংগ্রাম করে ছিলেন, একই ভাবে এই প্রস্তাবিত আইনের সংশ্লিষ্ট বিধানাবলীর বিরুদ্ধে আইনজীবী-জনতা জনমত গঠনপূর্বক আন্দোলনে সম্পৃক্ত হইবে এবং প্রয়োজনে আইনী যুদ্ধেও সামিল হবে -এইটা নিশ্চিত করে বলা যায়। কারণ ইতোমধ্যে এই আইনের সংশ্লিষ্ট বিধানবলীর বিরুদ্ধে ব্যাপক জনমত সৃষ্টি হয়েছে। পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ বাংলাদেশ সংবিধানে বর্ণিত মৌলিক ও নাগরিক অধিকারের সহিত প্রস্তাবিত ভূমি আইন, ২০২০ সাংঘর্ষিক। প্রস্তাবিত ভূমি আইনের উল্লেখিত বিধানাবলী সংশোধন/বাতিল না করে আইনটি পাস করা হলে এটি একটি ঐতিহাসিক ভুল (Historical Mistake) হবে এবং আইনের শাসন (Rule of Law) মারাত্মক ভাবে ভুলুন্ঠিত হবে।
রতন কুমার রায়: অ্যাডভোকেট; বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট এবং সাবেক সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক, চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতি।