দেশজুড়ে ধর্ষণ-বিরোধী বিক্ষোভের প্রতি সংহতি প্রকাশ করে ধর্ষণের অপরাধে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠায় ১০ দফা দাবি জানিয়েছে ধর্ষণ আইন সংস্কার জোট। যার উদ্দেশ্য ধর্ষণের শিকার এবং ধর্ষণের কবল থেকে বেঁচে যাওয়া ব্যক্তিদের জন্য সামগ্রিক, কার্যকর ও পরিবেষ্টিত বিচার নিশ্চিত করা এবং ধর্ষণের দায়মুক্তির অবসান ঘটানো।
২০১৮ সালে ‘ধর্ষণ আইন সংস্কার এখনই’ ক্যাম্পেইনটি আইনী এবং প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর ফাঁক/প্রতিবন্ধকতা সমূহ সনাক্ত করতে যা ধর্ষণের জন্য ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে বাধা প্রদান করে এবং এই ফাঁকগুলি কাটিয়ে ওঠার জন্য সংস্কার প্রস্তাবসমূহ প্রণয়ন করার জন্য শুরু হয়েছিল। এই প্রচারের অংশ হিসাবে এই সংস্কারের দাবিতে জোর প্রদানকারী দল হিসেবে “ধর্ষণ আইন সংস্কার কোয়ালিশন” প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল।
২০১৮ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত ধর্ষণ আইন সংস্কার সম্পর্কিত জাতীয় সম্মেলনের ঘোষণার প্রতিফলন করে এই দাবীসমূহ। এই সম্মেলনে সারা দেশ থেকে প্রায় ১৮০ জন আইনজীবী, বিচারক, শিক্ষাবিদ, গবেষক, সরকারী কর্মকর্তা, আইন প্রয়োগকারী কর্মকর্তা, সাংবাদিক এবং অধিকার কর্মীদের একত্রিত করা হয়েছিল। সম্মেলনে দাবীকৃত ১০ দফা নিম্নরূপ-
আইনী সংস্কার
১। মানবাধিকার মানদণ্ডের সাথে সামঞ্জস্য রেখে ধর্ষণ আইনের সংস্কার: ধর্ষণের শিকার/বেঁচে যাওয়া ব্যক্তিদের (লিঙ্গ, লিঙ্গ পরিচয়, যৌনতা, ধর্ম, বর্ণ, জাতি, অক্ষমতা এবং বয়স নির্বিশেষে) সুরক্ষা এবং ন্যায় বিচার লাভের অধিকার নিশ্চিত করার জন্য বাংলাদেশের সংবিধানের আওতায় নিশ্চিত মৌলিক অধিকার সমূহ এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের (সিইডিএডাব্লু, সিআরসি এবং আইসিসিপিআর সহ) সাথে সামঞ্জস্য রেখে ধর্ষণ আইন সংস্কার করতে হবে এবং অভিযুক্তদের জন্য ন্যায্য বিচার প্রক্রিয়া নিশ্চিত করতে হবে।
২। ধর্ষণের সংজ্ঞাকে বিস্তৃত করার মাধমে বৈষম্যহীন করা: ধর্ষণের সংজ্ঞা পুনর্নির্ধারণ করতে হবে যার মাধ্যমে সম্মতি ব্যতীত সকল ধরনের পেনেট্রেশনের ব্যাপারটি এই সংজ্ঞার আওতায় আনতে, অপরাধী বা ধর্ষণের শিকার/বেঁচে যাওয়া ব্যাক্তিদের লিঙ্গ নির্বিশেষে।
৩। অনুপ্রবেশের সংজ্ঞা সংজ্ঞায়িত করার মাধ্যমে ধর্ষণের সব ধরনকে সমূহকে এর আওতায় আনা: “অনুপ্রবেশ” এর একটি সংজ্ঞা যুক্ত করতে হবে যাতে করে ধর্ষণের শিকার বা বেঁচে যাওয়া ব্যক্তির যোনি, মলদ্বার বা মুখে যৌনাঙ্গ অনুপ্রবেশ সহ বিভিন্ন বস্তুর বা অপরাধীর শরীরের অন্যান্য অঙ্গের অনুপ্রবেশও অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
৪। আনুপাতিক হারে শাস্তি মনজুর করা এবং সাজা প্রদানের নির্দেশিকা প্রবর্তন: বিচারকদের সাজা দেওয়ার ক্ষেত্রে বিচক্ষণতা প্রয়োগে সক্ষম করার জন্য আইন সংশোধন এবং প্রয়োজনীয় শাস্তি নির্দেশিকা প্রণয়ন করা যা শাস্তির আনুপাতিকতা নিশ্চিত করে এবং প্রশমিতকরণ পরিস্থিতি (যেমন অভিযুক্ত ব্যক্তির বয়স বা মানসিক স্বাস্থ্য) এবং উদ্বেগজনক পরিস্থিতিকে (যেমন অস্ত্রের ব্যবহার, শক্তি বা সহিংসতা এবং ধর্ষণের শিকার / বেঁচে যাওয়া ব্যক্তির স্থায়ী শারীরিক বা মানসিক প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা) বিবেচনা করে।
৫। ফৌজদারি কার্যবিধি, ১৮৯৮ এর আধুনিকরন: ভাষা ও শ্রবন এবং বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী ব্যাক্তিগন যাতে ধর্ষণ মামলায় সাক্ষ্য প্রদান করতে পারে এবমন ব্যবস্থা রেখে ফৌজদারি কার্যবিধি সংশোধন করা।
৬। ধর্ষণ মামলায় ধর্ষণের শিকার ব্যাক্তির চরিত্রগত সাক্ষ্য ব্যাবহার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করতে হবে: সাক্ষ্য আইনের ১৫৫(৪) ধারা এবং এ সংক্রান্ত অন্যান্য ধারার সংস্কারের মাধ্যমে ধর্ষণ মামলার বিচার প্রক্রিয়ায় অভিযোগকারীর চরিত্রগত সাক্ষ্য ব্যাবহার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করতে হবে। এ সংস্কারের মাধ্যমে বিচারকেরা নিশ্চিত করবেন যে আইনজীবীরা ক্রাস এক্সামিনেশনে অভিযোগকারীকে কোন অবমাননাকর বা অবজ্ঞামূলক প্রশ্ন করবে না।
৭। সাক্ষী সুরক্ষা আইন প্রণয়ন: খসড়া ভিকটিম এবং সাক্ষী সুরক্ষা বিল (২০০৬ সালে আইন কমিশন প্রথম খসড়া করেছিল এবং পরবর্তীতে ২০১১ সালে এটি পুনর্বিবেচনা করা হয়েছে) পুনর্বিবেচনা করে এই আইনটি কার্যকর করা যার মাধ্যমে ভুক্তভোগী ব্যাক্তি এবং সাক্ষীদের প্রাতিষ্ঠানিক সুরক্ষা, জরুরি আশ্রয়, জীবিকা নির্বাহের সহায়তা, মনো-সামাজিক সহায়তা এবং প্রয়োজন অনুসারে তাদের পরিচয় বা স্থানান্তরের সুরক্ষা এবং ভুক্তভোগী এবং সাক্ষীর নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার কোন আশঙ্কা নেই এবং সন্তোষজনক বিকল্প ব্যবস্থা না করা পর্যন্ত এ জাতীয় সুরক্ষা অব্যাহত রাখা নিশ্চিত করা।
৮। ধর্ষণের শিকার ব্যাক্তিদের জন্য রাষ্ট্র পরিচালিত একটি ক্ষতিপূরন তহবিল গঠন করা: রাষ্ট্র পরিচালিত একটি “ক্ষতিপূরন তহবিল” গপ্টহন করা, যেখানে ধর্ষণ প্রমান হওয়া সাপেক্ষে ধর্ষণের শিকার ব্যক্তি ক্ষতিপূরন পেতে পারে। এক্ষেত্রে অপরাধী চিনহত হয়েছি কিনা বা তার বিচার হয়েছে কিনা তা বিবেচনা না করা।
প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার
৯। বিচার খাতের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের জন্য জেন্ডার সংবেদনশীল প্রশিক্ষণ: পুলিশ, আইনজীবী(বাদী/বিবাদী), বিচারক এবং সামাজিক কর্মীদের জন্য লিঙ্গ সংবেদনশীল প্রশিক্ষনের আয়োজন এবং প্রশিক্ষনের মডিউনের পরযবেক্ষন যাতে করে ধর্ষণের থেকে বেঁচে যাওয়া বাক্তিদের সাথে ন্যায়বিচারের পুরো প্রক্রিয়ায় যথাযথ লিঙ্গ প্রতিক্রিয়া এবং সংবেদনশীলভাবে ব্যবহার করা হয়।
১০। শিক্ষামূলক প্রতিষ্ঠানে সম্মতির বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা: লিঙ্গ এবং নারী এবং মেয়েদের বিরুদ্ধে সহিংসতা সম্পর্কে মানুষের ধারণার পরিবর্তন এবং প্রচলিত সামাজিক নিয়মাবলীর পরিবর্তন করার জন্য নারী এবং মেয়েদের বিরুদ্ধে সহিংসতার বিষয়টি (বিশেষত ধর্ষণ এবং যৌন সহিংসতার অন্যান্য প্রকারগুলি), সম্মতি ও পছন্দের ধারনাকে প্রাথমিক শিক্ষা স্তর থেকে শিক্ষামূলক পাঠ্যক্রমে এ সঙ্ক্রান্ত তথ্য অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।