সারা দেশে এখন নারীদের ওপর এত নির্যাতনের ঘটনায় সরকার পর্যন্ত বিব্রত বলে মন্তব্য করেছেন প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন। তিনি বলেছেন, ‘সরকারের মন্ত্রী পর্যন্ত বলেছেন আমরা ক্ষমতায়, আমরা এটার দায় এড়াতে পারি না। আমরা জুডিশিয়ারিতে আছি, আমরাও চাই উপযুক্ত বিচার হোক।’
সদ্য প্রয়াত অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমের স্মরণে আয়োজিত শোকসভায় বুধবার (৭ অক্টোবর) প্রধান অতিথির বক্তব্যে প্রধান বিচারপতি এসব কথা বলেন। সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি মিলনায়তনে ওই স্মরণসভার আয়োজন করে ল’ রিপোর্টার্স ফোরাম।
গণমাধ্যমকর্মীদের উদ্দেশে প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন বলেন, ‘কিছুদিন আপিল বিভাগে জেল আপিলের রায় হয়েছে। জেল আপিল করতে গিয়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত অনেক আসামিকে আমরা ছেড়েছি। কারণ, সংবিধানের অধীনে শপথ নিয়েছি যে ন্যায়বিচার করব। শপথের প্রতি সম্মান দেখিয়ে বিচার করেছি, ছেড়েছি। আপনারাও (সাংবাদিকেরা) এটি নিয়ে বড় বড় প্রতিবেদন করেছেন। টিভিতে দেখেছি যে এত বছর কেন (আসামি) কনডেমড সেলে ছিল, আপিল বিভাগ কেন আগে করেনি। হ্যাঁ, আপিল বিভাগ কিন্তু বসে থাকেনি। বার থেকে বলে যে এটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ মামলা, এটা এখন করতে হবে। এখন বলেছি সিরিয়াল ছাড়া কোনো মামলা হবে না। আপনারা যে রকম প্রতিবেদন করেছেন, এত দিন ডেথ সেলে থাকার পর আমরা ছেড়েছি কেন। কিন্তু আমরা গত কয়েক দিনে একটাতে মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখেছি। এটার ওপর সংবাদ করেননি।’
বুধবার এক মামলায় তিনজনের ডেথ নিশ্চিত (মৃত্যুদণ্ড বহাল) করেছেন উল্লেখ করে প্রধান বিচারপতি বলেন, এটা নিয়ে কোনো নিউজ নেই। এরপর নারী নির্যাতন প্রসঙ্গ নিয়ে ওই সব কথা বলেন প্রধান বিচারপতি। তিনি গণমাধ্যমকর্মীদের উদ্দেশে বলেন, ‘যেখানে উপযুক্ত বিচার হচ্ছে, যেখানে ছাড়া (খালাস কিংবা দণ্ড কমানো) হচ্ছে, সেটা যে রকম বলবেন, যেখানে সাজা হচ্ছে, মৃত্যুদণ্ড যেখানে বহাল রাখা হচ্ছে, সেটাও যদি জনগণের সামনে আসে, তখন জনগণের স্বস্তি হবে। শুধু ছাড়ছে না, তার সঙ্গে সঙ্গে ফাঁসিও হচ্ছে, মৃত্যুদণ্ড হচ্ছে, সেটাও মানুষের জানার অধিকার আছে।’
অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম প্রসঙ্গে প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘তাঁর একটা সবচেয়ে বড় কথা ছিল বিচার অঙ্গনে যত অনিয়ম আছে, এগুলো দূর করতে হবে। তিনি আমাকে বলেছেন, সেন্ট্রাল ফাইলিং করেন। এটা যদি করেন তাহলে কোর্টের ৫০ শতাংশ অনিয়ম দূর হয়ে যাবে। আমি বারের (সুপ্রিম কোর্ট বার) নেতাদের বলেছি, আপনারা যদি সেন্ট্রাল ফাইলিংয়ে আসেন, তাহলে বারের যে অনিয়ম আছে, তার ৫০ শতাংশ চলে যাবে। কিন্তু বার থেকে বলল, সেন্ট্রাল ফাইলিং হবে না। আমরা (বার) আমাদের পছন্দ অনুযায়ী কোর্ট নির্বাচন করব।’
প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘আমি আশা করব বার (সুপ্রিম কোর্ট বার) মাহবুবে আলমের ইচ্ছাটা অচিরেই বাস্তবায়ন করবেন। আমিও ব্যক্তিগতভাবে চাই, সেন্ট্রাল ফাইলিং যদি হয় তাহলে সুপ্রিম কোর্টের অনিয়ম ৫০ শতাংশ থাকবে।’
সমস্যার মূলে যদি হাত না দিই, যত অনিয়মের কথা বলি কোনো অনিয়ম কোর্ট থেকে দূর হবে না উল্লেখ করে প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘আগে মূলে আঘাত করতে হবে। মূলে আঘাত করলে অনিয়ম দূর হবে। তার আগে অনিয়ম দূর হবে না।’
মাহবুবে আলম প্রসঙ্গে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, ‘মাহবুব ভাইকে কোনো বিচারকের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করতে দেখিনি। আদালতে জজ সাহেব যত রাগ হতেন, উনি তত ঠান্ডা মাথায় কথা বলতেন। এটি ছিল তাঁর বিরাট গুণ। তিনি অত্যন্ত সংস্কৃতিমনা ছিলেন। তিনি অসাম্প্রদায়িকতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাস করতেন। এসব ক্ষেত্রে কোনো আপস নেই। এই যে কমিটমেন্ট এগুলোও তাঁর কাছে আমাদের শেখার। মাহবুব ভাইকে যদি সত্যি সত্যি মনে রাখতে চাই, শ্রদ্ধা জানাতে চাই, তাহলে মাহবুব ভাইয়ের সেসব বিরল গুণ ছিল, সেগুলো অনুসরণ করে যদি আমরা আদালতে চলি, তাহলেই বোধ হয় তাঁকে সঠিকভাবে সম্মান করা হবে।’
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম বলেন, ভুয়া এলএলবি সার্টিফিকেটধারীদের ঠেকাতে (আইনজীবী না হতে) সফল হয়েছেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। বার কাউন্সিলকে ক্লিন জায়গায় নিয়ে আসার চেষ্টা করেছেন তিনি (বার কাউন্সিলের চেয়ারম্যান)। তিনি যেমন আয় করেছেন, তেমন অকাতরে মানুষের কল্যাণে তা বিলিয়ে দিয়েছেন। ছিলেন ধৈর্যশীল ও সহনশীল মানুষ। মাহবুবে আলম তাঁর কর্মের ভেতর দিয়ে চিরদিন বেঁচে থাকবেন।
আপিল বিভাগের বিচারপতি ওবায়দুল হাসান বলেন, সাদামাটা মানুষ ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। কখনো দম্ভ বা দাম্ভিকতা দেখাতেন না। চলার পথে সব সময় মানুষকে সাহায্য করতেন।
মাহবুবে আলমের প্রসঙ্গে হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম বলেন, মাহবুবে আলমের বিপক্ষে কোনো আদেশ গেলে, তাঁর প্রতি কোনো রূঢ় কথা বললেও তিনি কখনোই রেগে যেতেন না। আদালত ও বিচারকের প্রতি তাঁর এমন সম্মান বোধ ছিল। পেশাগত জীবনে তিনি ছিলেন অসম্ভব, অসম্ভব ও অসম্ভব একজন ধৈর্যশীল মানুষ।
মাহবুবে আলম প্রসঙ্গে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মাহবুব আলী বলেন, ‘উনি চাইতেন কলুষমুক্ত বিচারব্যবস্থা। মাহবুবে আলমকে আমরা আর ফিরে পাব না। আমাদের আদালত অঙ্গন যাতে বিশুদ্ধ হয়, বিচারাঙ্গন যাতে কলুষমুক্ত থাকে—এটিই হবে মাহবুবে আলমের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো।’
ল’ রিপোর্টার্স ফোরামের সভাপতি মাশহুদুল হকের সভাপতিত্বে সভায় অন্যান্যের মধ্যে আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক, হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন সেলিম, সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি এ এম আমিন উদ্দিন, অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মুরাদ রেজা, সমিতির সম্পাদক রুহুল কুদ্দুস, আইনজীবী কে এম সাইফুদ্দিন আহমেদ ও অ্যাটর্নি জেনারেলের ছেলে সুমন মাহবুব বক্তব্য দেন।