দেশের বিচার বিভাগ নিয়ে ফেসবুকে বিরূপ মন্তব্য করে পোস্ট দেয়ায় সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ইউনুছ আলী আকন্দের বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের আদেশ আজ। রায়ের মাধ্যমে জানা যাবে তিনি আইন পেশায় থাকছেন নাকি আপিল বিভাগের নির্দেশনা দিয়ে তাকে অবসরে পাঠানো হচ্ছে।
আজ সোমবার (১২ অক্টোবর) প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বাধীন সাত সদস্যের আপিল বিভাগের ভার্চুয়াল পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে এ বিষয়ে আদেশ দেয়ার জন্যে নির্ধারিত রয়েছে।
এর আগে, ফেসবুকে বিরূপ মন্তব্য করে পোস্ট দেয়ায় সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ইউনুছ আলী আকন্দ গতকাল সশরীরে উপস্থিত হয়ে নিঃশর্ত ক্ষমা চেয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে। এরপর এ বিষয়ে শুনানি শেষে আজ সোমবার (১২ অক্টোবর) আদেশের জন্য দিন ঠিক করেছেন আপিল আদালত। প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের সাত বিচারপতির পূর্ণাঙ্গ ভার্চুয়াল বেঞ্চে এ মামলার শুনানি চলে। সিনিয়র আইনজীবীরা শুনানিতে অংশ নেন।
ফেইসবুকে দেশের সর্বোচ্চ আদালত নিয়ে আইনজীবী ইউনূস আলী আকন্দের করা বিরুপ মন্তব্যের প্রেক্ষিতে আদালত অবমাননার মামলার শুনানিতে গতকাল প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন বলেছেন, এই আইনজীবী (ইউনুস আলী আকন্দ) একজন হ্যাবিচুয়াল কনটেম্পনার (অভ্যাসগত আদালত অবমাননাকারী)। এর আগে উনি তিনবার এ ধরনের অপরাধ করলেও তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। আর কতবার তাকে ছেড়ে দেব? উনি এবার যে কাজ করেছেন সেটা কি ক্ষমারযোগ্য। উনার যে বয়স (৬১ বছর) তাতে প্র্যাকটিস থেকে অবসর নেওয়ার সময় হয়েছে।
আইনজীবীদের উদ্দেশ্যে প্রধান বিচারপতি বলেন, কোন কাজটি গোপনে হয়েছে আপনারাই বলুন? ১৫ বছর ধরে যেসব ফাঁসির আসামি কনডেম সেলে আছে, তাদের জেল আপিল শুনছি। এসব আপিল কি আমরা গোপনে শুনছি? উভয় পক্ষের আইনজীবীদের শুনানি নিয়েই জেল আপিলের রায় দেয়া হচ্ছে। তাতে কেউ খালাস পাচ্ছেন, কারো সাজা বহাল থাকছে। এসব পুরনো মামলা শোনার ক্ষেত্রে সরকারের কি স্বার্থ থাকতে পারে? পুরনো মামলা শুনানি করতে গিয়ে কি বিচার বিভাগ ধ্বংস হয়ে গেছে? আর করোনাকালে আমরাই ভার্চুয়াল কোর্ট চালু করেছি। আদালতের নানা বিষয়ের সঙ্গে গর্ভনমেন্টকে টেনে আনা বা যোগসূত্র খোজা দু:খজনক।
গতকাল সকাল সাড়ে ৯ টায় প্রধান বিচারপতির কোর্টে ডায়াসের উপর রাখা ল্যাপটপের সামনে হাজির হন আদালত অবমাননাকারী আইনজীবী ইউনুস আলী আকন্দ। তিনি নি:শর্ত ক্ষমা চেয়ে লিখিত আবেদন দেন। সেখানে তিনি দাবি করেছেন, এক হজারের মত জনস্বার্থমূলক মামলা করেছেন। তিনি জনস্বার্থ মামলা করার ক্ষেত্রে একজন ‘পাইওনিয়ার’। একইসঙ্গে তার ওই ক্ষমার আবেদনে ১০/১৫ জন সিনিয়র আইনজীবীর নাম উল্লেখ করেছেন। সেখানে বলেছেন উনি তাদেরকে এই মামলায় এনগেজ করেছেন। কিন্তু সিনিয়র আইনজীবীরা বলেন তাদের সম্মতি না নিয়েই ক্ষমার আবেদনে তাদের নাম জুড়ে দেওয়া হয়েছে।
তখন আবেদনে উল্লিখিত অন্যান্য তথ্যের সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন আপিল বিভাগের বিচারপতিরা। বিচারপতি মির্জা হোসেইন হায়দার বলেন, এটা কি আদালতকে ধোঁকা দেওয়া নয়? এত মিথ্যা আপনি ঢাকবেন কি করে? একটি নয়, হাজারটি মিথ্যা বলেছেন। তখন ইউনুস আলী বলেন, মাই লর্ড যে আবেদন দিয়েছি সেটা পরিবর্তন করে নতুন আবেদন দেব। বিচারপতি মোহাম্মদ ইমান আলী বলেন, যে আবেদন দিয়েছেন সেটা এখন কোর্টের রেকর্ড। এটা মুছে ফেলা বা পরিবর্তন করা যাবে না।
‘সারাবিশ্বে আমাদের জুডিসিয়ারিকে হেয় করেছন’
শুনানির শুরুতে অ্যাটর্নি জেনারেল এএম আমিন উদ্দিন বলেন, ঐ আইনজীবী ফেইসবুকে যেসব স্ট্যাটাস দিয়েছেন তা বিচার বিভাগের ভাবমূর্তিকে ক্ষুন্ন করেছে। আদালত অবমাননাকারী আইনজীবীর উদ্দেশ্যে বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী বলেন, আপনার ফেইসবুক স্ট্যাটাসে কার বিচার চেয়েছেন বা কারা বিচার বিভাগকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে এসেছে, সেটা বলুন। আইনজীবী বলেন, আমি বিচারক বা বিচার বিভাগ কোনটিকেই বোঝায়নি। আমি তো ক্ষমা চেয়েছি। যেদিন এই স্ট্যাটাস দিয়েছি সেদিনই মুছে ফেলেছি।
বিচারপতি হাসান ফয়েজ বলেন, ঐ স্ট্যাটাস দিয়ে সারাবিশ্বে আমাদের জুডিসিয়ারিকে হেয় করেছেন। আইনজীবী বলেন, আমাকে তলব করার আগেই তা ডিলিট করেছি? প্রধান বিচারপতি বলেন, মিথ্যা বলার আর জায়গা পান না। বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী বলেন, আমাদের পরিসংখ্যান বলছে ভার্চুয়াল কোর্ট করোনাকালে ১ লাখ ৪৭ হাজার জামিনের আবেদন শুনেছে। ৭২ হাজার আসামিকে জামিন দিয়েছে।
‘করোনাকালে আইনজীবীরাই বাধ্য করেছেন কোর্ট বন্ধ রাখতে’
প্রধান বিচারপতি বলেন, করোনাকালে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি ও সম্পাদক আমাকে বলেছিলো বর্তমান অবস্থায় কোর্ট খোলা ঠিক হবে না। কোর্ট খুললে হাঙ্গামা করবে আইনজীবীরা। কিন্তু করোনাকালে বিশ্বের কোন দেশে সম্পূর্ণ কোর্ট বন্ধ থাকে নাই। আপনারা (আইনজীবী) বাধ্য করেছেন কোর্ট বন্ধ রাখতে। তখন সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সম্পাদক রুহুল কুদ্দুস কাজল বলেন, করোনায় মানুষের আক্রান্ত ও মৃত্যুর বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে আমরা কোর্ট বন্ধ রাখার কথা বলেছিলাম। সমিতির সভাপতি ও অ্যাটর্নি জেনারেল এএম আমিন উদ্দিন বলেন, আপনারা যখন কোর্ট খুলে দিলেন তখন আইনজীবীরা চিঠি ও ফেসবুকে শতশত স্ট্যাটাস দিয়ে বিরোধিতা করতে লাগল। এরপর আমরা বসে ভার্চুয়াল কোর্ট খোলার প্রস্তাব দেই। প্রধান বিচারপতি বলেন, আমি তো সমস্যার মধ্যে আছি, কোর্ট খুললেও বিপদ, আবার না খুললেও বিপদ।
বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী বলেন, আমরা ৫০ দিনের অবকাশকালীন ছুটি বাতিল করেছি। কিন্তু বাতিল না করে তো ছুটিগুলো এনজয় করতে পারতাম। কিন্তু তা আমরা করিনি। সমিতির সম্পাদক রুহুল কুদ্দুস কাজল বলেন, কোর্ট খুলে দেওয়ার আগে আমরা সমিতি থেকে আইনজীবীদের লোনের ব্যবস্থা করেছি। এখন কোর্ট খুলে দেওয়ায় কারো মধ্যে কোন হাহাকার নাই। তিনি বলেন, আপনাদের উদ্যোগ নেওয়ার কারনে এফিডেভিট ও ফাইলিং শাখায় দীর্ঘদিন ধরে যে অব্যবস্থাপনা ছিলো সেটা দূর হয়েছে। এজন্য আমরা কৃতজ্ঞ।
‘দয়ার সাগরের কারনে এসব শুনতে হচ্ছে’
প্রধান বিচারপতি বলেন, সরকারি চাকরি করলে তো ওই আইনজীবীকে এতদিন অবসরে যেতে হত। যেহেতু তার বয়স ৬০ পেরিয়ে গেছে তাহলে অবসরে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দেই। আইনজীবী জয়নুল আবেদীন ও মাহবুবউদ্দিন খোকন বলেন, অবসরে পাঠালে সে কি করবে? পরিবার পরিজন নিয়ে বিপদে পড়বে। আপনারা তো দয়ার সাগর। ক্ষমা করে দিন। বিচারপতি মো. নুরুজ্জামান বলেন, দয়ার সাগরের কারনেই তো আমাদের বিচার বিভাগ নিয়ে নানা কথা শুনতে হচ্ছে। রুহুল কুদ্দুস কাজল বলেন, আপনারা তো সবাই উনাকে চেনেন। ক্ষমা করে দেন। বিচারপতি নুরুজ্জামান বলেন, বিচারে আসলে কাউকে চেনার সুযোগ নাই। সবাই আদালতের কাছে সমান। সিনিয়র আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, উনি যা করেছেন ভুল করেছেন, সতর্ক করে ক্ষমা করে দিন। মতিন খসরু বলেন, দোষ স্বীকার করে ক্ষমা চেয়েছেন। কিন্তু উনি এই কোর্টের শ্রেষ্ঠত্ব ক্ষুন্ন করেছেন।