দুটি আইনের মধ্যে বৈপরীত্য থাকায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের যৌতুক সংক্রান্ত একটি ধারা আপোষযোগ্য করে ছয় মাসের মধ্যে সংশোধন করতে সরকারকে উদ্যোগ নিতে বলেছিলেন হাইকোর্ট। চলতি বছরের ১০ এপ্রিল যৌতুকের এক মামলায় আসামির সাজা বাতিল করে বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের হাই কোর্ট বেঞ্চ এই নির্দেশনা দেয়।
গত ১২ অক্টোবর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২০ মন্ত্রীসভায় চূড়ান্ত অনুমোদন পায়। জাতীয় সংসদের অধিবেশন না থাকায় তা রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশের মাধ্যমে কার্যকর করা হয়। তবে সংসদের পরবর্তী অধিবেশনে এই অধ্যাদেশ উপস্থাপন করতে হবে। আইনটি বলবৎ রাখতে চাইলে পরে বিল আকারে তা আনবে সরকার।
সংশোধনীতে ধর্ষণের সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ডের বিধান করার পাশাপাশি আরও কয়েকটি ধারায় পরিবর্তন আনা হয়। এরমধ্যে একটি হলো যৌতুকের ঘটনায় মারধরের ক্ষেত্রে (ধারা ১১-এর গ) সাধারণ জখম হলে তা আপসযোগ্য হবে। এ ছাড়া এই আইনের চিলড্রেন অ্যাক্ট-১৯৭৪-এর (ধারা ২০-এর ৭) পরিবর্তে শিশু আইন ২০১৩ প্রতিস্থাপিত হবে।
দেশের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালসমূহে লক্ষাধিক মামলা বিচারাধীন রয়েছে। এর মধ্যে বহু পরিবার তাদের দম্পত্য কলহ থেকে ফিরে এসে আবারো একত্রে বসবাস করতে চাইলেও আইনে আপসের বিধান না থাকায় সেটি পারতো না। নতুন সংশোধনীর ফলে এ সমস্যার সমাধান হল।
আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালসমূহে লক্ষাধিক মামলা বিচারাধীন রয়েছে। সরকার উক্ত আইনের সংশ্লিষ্ট ধারার অপরাধসমূহ আপোষের মাধ্যমে নিষ্পত্তির সুযোগ সৃষ্টি করায় ট্রাইব্যুনালে মামলার জট কমবে। তেমনি বিবদমান ঘরে শান্তি ফিরে আসবে।
উল্লেখ্য, চার লাখ টাকা যৌতুকের দাবিতে স্ত্রী লাভলী আক্তার স্বামী মো. শফিকুল ইসলামের বিরুদ্ধে ২০১২ সালে মামলা করে। দুই জনের বাড়িই কিশোরগঞ্জের কটিয়াদিতে। কিন্তু শফিকুল ইসলামের চাকরির কারণে স্বামী-স্ত্রী দুজনই চট্টগ্রামে থাকতেন। ২০১৪ সালের ১০ জুলাই মামলার আসামি শফিকুলকে তিন বছর সশ্রম কারাদণ্ড ও ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করে চট্টগ্রামের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল।
কিন্তু দুই বছর পর সাজার রায় বাতিল চেয়ে ২০১৬ সালে হাইকোর্টে আবেদন করেন শফিকুল। হাইকোর্ট তখন তাকে জামিন দেয় এবং সাজা কেন বাতিল করা হবে না তা জানতে চেয়ে রুল জারি করে। এর মধ্যে তাদের দু’জনার মিল হয়ে যায়। এর কিছুদিন আগে তাদের একটি সন্তান হয়। সেই সন্তানের বয়স আড়াই মাস। রায় ঘোষণার দিন আড়াই মাসের ঐ সন্তানকে নিয়েই স্বামী-স্ত্রী হাইকোর্টে হাজির হন।
একপর্যায়ে অঙ্গীকারনামায় স্বাক্ষরের পর আদালত শফিকুলকে বলে, ভবিষ্যতে যৌতুকের জন্য স্ত্রীকে নির্যাতন করলে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। এরপর তার তিন বছরের সাজা বাতিল করেন হাইকোর্ট।
একই সঙ্গে, রায় হাতে পাওয়ার ছয় মাসের মধ্যে নারী ও শিশু নির্যাতন আইনের ১১ (গ) ধারার অপরাধ আপসযোগ্য করতে সরকারের সংশ্লিষ্টদের প্রতি নির্দেশনা দেন। ওই রায় ঘোষণার পর সম্প্রতি সরকার বিদ্যমান আইনে সংশোধনী এনে ওই ধারার অপরাধ আপসযোগ্য করেছেন।
নারী ও শিশু নির্যাতন আইনের ১১ ধারায় যৌতুকের অপরাধে শাস্তির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, যদি কোনো নারীর স্বামী অথবা স্বামীর পিতা, মাতা, অভিভাবক, আত্মীয় বা স্বামীর পক্ষে অন্য কোনো ব্যক্তি (যৌতুকের জন্য উক্ত নারীর মৃত্যু ঘটান বা মৃত্যু ঘটানোর চেষ্টা করেন কিংবা উক্ত নারীকে মারাত্মক জখম করেন বা সাধারণ জখম করেন) তাহলে উক্ত স্বামী, স্বামীর পিতা, মাতা, অভিভাবক, আত্মীয় বা ব্যক্তি—
- (ক) মৃত্যু ঘটানোর জন্য মৃত্যুদণ্ডে বা মৃত্যু ঘটানোর চেষ্টার জন্য যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবেন এবং উভয় ক্ষেত্রে উক্ত দণ্ডের অতিরিক্ত অর্থদণ্ডেও দণ্ডিত হবেন।
- (খ) মারাত্মক জখম করার জন্য যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে অথবা অনধিক বার বছর কিন্তু অন্যূন পাঁচ বছর সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবেন এবং উক্ত দণ্ডের অতিরিক্ত অর্থদণ্ডেও দণ্ডিত হবেন।
- (গ) সাধারণ জখম করার জন্য অনধিক তিন বছর কিন্তু অন্যূন এক বছর সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবেন এবং উক্ত দণ্ডের অতিরিক্ত অর্থদণ্ডেও দণ্ডিত হবেন।
১১ (গ) ধারাটি আপোষযোগ্য করার ক্ষেত্রে হাইকোর্টের বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চের দেয়া রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, যৌতুকের দাবিসহ যে কোনো অজুহাতে স্বামী কর্তৃক স্ত্রীর ওপর শারীরিক নির্যাতন নিঃসন্দেহে নিন্দনীয় ও গর্হিত অপরাধ। একটি সংসার ভেঙে গেলে তার পারিবারিক ও সামাজিক নেতিবাচক দিক সুদূর প্রসারী। এতে শুধু সামাজিক, পারিবারিক ও অর্থনৈতিক বিপর্যয়ই ঘটে না তাদের সন্তান এমনকি স্বজনদের ওপরেও গভীর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। যা পূরণ করা কঠিন। এ অপরাধের পরেও যদি স্বামী-স্ত্রী নিজেদের ভুল বোঝাবুঝির অবসান ঘটিয়ে দাম্পত্য জীবন অব্যাহত রাকার সিদ্ধান্ত নেয় সেক্ষেত্রে আইনের বিধান যত কঠোর হোক না কেন তা একটি সংসার রক্ষার চাইতে বড় হতে পারে না।
আদালত তার রায়ে আরও বলেছেন, ‘আমাদের আইনগুলো বজ্র আঁটুনি ফস্কা গেরোর মত। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে আপসের বিধান নেই। অথচ অনেক যৌতুকের মামলায় স্বামী ও স্ত্রী একপর্যায়ে আপস করতে চান। কিন্তু আপসের বিধান না থাকায় আসামির সাজা হয়ে যায়। তাই এ আইনটি সংশোধন হলে বা বিচারকই আদালতের অনেক মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি হয়ে যাবে, সাক্ষ্য-প্রমাণের দরকার পড়বে না। মামলার দীর্ঘসূত্রিতা বা মামলাজট কমবে।’