কাজী শরীফ: আমার আদালতে একটা দলিল সংশোধনের মোকদ্দমা বিচারাধীন। বাদী দাবি করছেন তার জেঠাতো ভাই তার কাছে ১৫১২ দাগে সম্পত্তি বিক্রি করেছেন। সে অনুযায়ী ঐ দাগে তিনি ঘর করেছেন। এখন ভাইয়ের মৃত্যুতে ভাতিজারা দাবি করছেন তাদের বাবা ১৫১৫ দাগে বিক্রি করেছেন। তারা চাচাকে দখল ছেড়ে দিতে বললে তিনি দলিল পর্যালোচনা করে তা সংশোধনের মোকদ্দমা করেন।
বাদীর সাক্ষীর শুরু থেকে এ মোকদ্দমা দেখার সুযোগ হয় আমার। বাদী তার আরজি অনুযায়ী সাক্ষ্য দেন। জেরায় বিজ্ঞ আইনজীবীর ক্রমাগত প্রশ্নের মুখে তিনি ভড়কে যাচ্ছিলেন। বিজ্ঞ আইনজীবীর কথা অযৌক্তিক নয়৷তিনি বলছেন “আপনি দলিলে স্বাক্ষর করে জমি কিনেছেন এবং সে দাগে বাড়ি না করে ভিন্ন দাগে করেছেন।”
বাদী কাঁদতে কাঁদতে বলেন স্যার আমি কিছু বলতে চাই। বিজ্ঞ আইনজীবী বলেন “জেরায় আমার প্রশ্নের বাইরে কথা বলার সুযোগ নাই” আমি বাদীর কান্না দেখে বলার অনুমতি দিলাম। তিনি অভয় পেয়ে বললেন “স্যার আমি পুলিশে চাকুরি করতাম৷কক্সবাজারে আমার পোস্টিং ছিল। জমির বিক্রেতা আমার জেঠাতো ভাই ও সমবয়সী। তাকে আমি খুবই বিশ্বাস করতাম। আমি আর সে বন্ধুর মত ছোটবেলা থেকে বড় হয়েছি। তার জায়গা সে আমার কাছে বিক্রি করেছে। ১৫১২ কিংবা ১৫১৫ কোন দাগ সম্পর্কেই আমি জানিনা। আমি জানি আমার কাছে এ জায়গা বিক্রি করেছে। সাড়ে তিন শতক জায়গায় আমি ঘর করেছি। এখন দেখি এ দাগ সে দাগ নয়। বিক্রিত দাগ পাশের ডোবা।” আমার ভদ্রলোকের কথা শুনে অবিশ্বাস করার মত মনে হয়নি। এরপর বিজ্ঞ আইনজীবী জেরা শেষ করলেন।
পরের তারিখে বাদী দখলের সাক্ষী আনলেন। দখলের সাক্ষী গতানুগতিক বাদীর দখলে আছে বললেন তবে ১৫১২ দাগে! জেরায় উকিল সাহেব ১৫১২ ও ১৫১৫ এর পার্থক্য ধরিয়ে দিলেন। আমি বুঝলাম এ মোকদ্দমা দালিলিকভাবে বাদী প্রমাণ করতে পারবেন না। কিন্তু আমার মন বলছে ভিন্ন কথা। দখলের সাক্ষী সাক্ষ্য দেয়ার সময় দেখলাম বাদী এক বোরকা পরা মহিলার পাশে বসে আছেন। যার চোখ ছাড়া সব ঢাকা।
জিজ্ঞেস করলাম “ইনি কে?” বাদী জবাবে বলেন আমার ভাবি। অর্থাৎ মহিলা জমি বিক্রেতার স্ত্রী। বাদী ও তিনি যেহেতু একসাথে বসেছিলেন বুঝলাম সম্পর্ক এখনো তিক্ততার পর্যায়ে যায়নি। আমি মহিলাকে ডাক দিলাম। এজলাসের সামনে তিনি আসলেন। আমি বললাম, “আমি জানি আপনি প্রকৃত সত্য জানেন। আপনি জানেন আপনার স্বামী কোন দাগে সম্পত্তি বিক্রি করেছেন। স্ত্রী হিসেবে আপনার জানার কথা। যদি আপনার স্বামীর ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃত ভুলের জন্য আপনি এ সাড়ে তিন শতক জায়গা থেকে এ লোককে বঞ্চিত করেন বা ঘরহারা করেন তাহলে আল্লাহ অসন্তুষ্ট হবেন। আপনি জানেন মানুষের জন্য আসলে সাড়ে তিন শতক জায়গা লাগেনা। লাগে মাত্র সাড়ে তিন হাত। সাড়ে তিন হাত মাটিতে যাওয়ার আগে অন্যায় করে কারো সাড়ে তিন ইঞ্চি জায়গাও ভোগ করা ঠিক না। আমি বিশ্বাস করি আপনি সত্যটাই আদালতকে বলবেন। আমি একমাস সময় দিলাম। এরপর বিবাদীর সাক্ষ্য শুরু হবে। সেদিন আপনি সত্যটা আমাদের বলবেন। যদি এ জায়গা আপনার দেবরের হয়ে থাকে তাহলে আগামী তারিখে সত্য স্বীকার করে এ ডি আর (বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি) করবেন। যাতে কোনদিন এটা নিয়ে আর সমস্যা না হয়। আর যদি আপনার স্বামী ১৫১৫ দাগেই বিক্রি করেন তাহলে আপনি সাক্ষ্য দেবেন। মনে রাখবেন আমাদের দরকার সাড়ে তিন হাত মাত্র!”
আমি এরপর অন্য কাজে মন দিলাম। মাঝেমাঝে মনেহয় মামলাটার কথা। কিন্তু পরক্ষণেই কাজের চাপে ভুলে যাই। একমাস পর মামলার তারিখ আসে। পেশকার সাহেব মামলার নাম্বার দেখে ডাকেন। আমার হাতে নথি। বিজ্ঞ আইনজীবীরা এসে বলেন স্যার এডিআর করবো। আমি অবাক হয়ে গেলাম। বাদী সাক্ষ্য দিলেন। বিবাদী ভদ্রমহিলা সাক্ষীর কাঠগড়ায় ওঠার পর জিজ্ঞেস করলাম এডিআর কেনো করছেন? জবাবে বললেন “স্যার সেদিন আপনার কথাগুলো বাড়িতে গিয়ে ভেবেছি। আমাদের আসলে লাগে মাত্র সাড়ে তিন হাত। আমার স্বামী ১৫১২ দাগেই বিক্রি করেছিলেন। আমি জানি।”
আমার গলা ধরে আসছিল আনন্দে। একটা মানুষের কষ্টের সম্পদ রক্ষা পেলো। বাদীকে ডেকে বললাম, “আপনার ভাবি ভালো মানুষ। ভাই মারা গেছেন। এ ভাবিকে অমর্যাদা করবেন না। ঈদে ভাবিকে সবসময় শাড়ি কিনে দিবেন। ওনার খোঁজখবর রাখবেন। এটা আপনার প্রতি ওনার হক।”
উভয়পক্ষ এডিআর করলো। একটি বিরোধের এত সুন্দর নিষ্পত্তি করে এজলাস থেকে নেমে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া জ্ঞাপন করলাম। বুড়ো বয়সে চাকুরিটা না পেলে কী এ আনন্দের ভাগীদার হতে পারতাম!
কাজী শরীফ: সহকারী জজ, নোয়াখালী।