ছগির আহমেদ টুটুল: রীট কি? রীটের উৎপত্তি হয়েছে কোথা থেকে? রীট পিটিশন (Writ Petition) কি? রীট জারীর এখতিয়ার কোন আদালতের? রীটের প্রকারভেদ কিংবাএবং হাইকোর্ট বিভাগ স্ব-উদ্যোগে [suo motu] রীট জারি করতে পারে কিনা? এমন নানা প্রশ্নের উত্তর দিয়ে সাজানো হয়েছে আজকের আলোচনা। এছাড়া রীট সম্পর্কিত বিখ্যাত মামলাসহ সরকারি কর্মচারী চাকরি হারালে রিট করতে পারেন কি-না এসব বিষয়ে সহজ ভাষায় লেখার চেষ্টা করেছি।
রীট [Writ]
রীট শব্দটির অর্থ হলো আদালত বা যথাযথ কর্তৃপক্ষ কর্তৃক ঘোষিত আদেশ। সর্বপ্রথম রীট (Writ) শব্দটির উৎপত্তি হয় বৃটেনে। বৃটেনের রাজা বা রানী তাদের কর্মচারী বা অফিসারদেরকে নিজ নিজ কার্যাবলী পালনে বাধ্য করার জন্য বা কোন অবৈধ কাজ করা থেকে বিরত রাখার জন্য রীট জারী করত। পরবর্তীতে রাজা বা রানীর এই বিশেষাধিকার নাগরিকদের অধিকারে চলে আসে। নাগরিকগণ সরকারী কর্মকর্তাদের আচরণে ও কাজে সংক্ষুব্ধ হয়ে রাজার কাছে আসত এবং রাজা বিশেষাধিকারবলে তার অফিসারদের উপর রীট জারি করত। এক কথায় রীট হল এমন এক আদেশ যার মাধ্যমে আদালত কোন ব্যক্তিকে কোন কাজ করতে বা করা হত বিরত থাকতে নির্দেশ প্রদান করে।
রীট পিটিশন (Writ Petition)
সংক্ষুব্ধ কোন ব্যক্তি সংবিধানের ১০২ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী প্রতিকার প্রাপ্তির জন্য যে পিটিশন দায়ের করে, তা রীট পিটিশন নামে পরিচিত। সংবিধানের ৪৪ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী কোন সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি তার মৌলিক অধিকার বলবৎ করার জন্য হাইকোর্ট বিভাগে পিটিশন (আবেদন) দায়ের করতে পারে। রীট পিটিশন দায়ের করা একটি মৌলিক অধিকার। সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি অথবা তার পক্ষে কোন ব্যক্তি অধিকারবলে (as of right) রীট পিটিশন দায়ের করতে পারে। মৌলিক অধিকার সংরক্ষণের জন্য আদালত ৫ ধরনের আদেশ দিতে পারেন। সংবিধানের ১০২ অনুচ্ছেদের অধীনে দেওয়া এই ৫ ধরনের আদেশকে রীট আদেশ বলা হয়ে থাকে।
রীট জারীর এখতিয়ার
সংবিধান শুধুমাত্র হাইকোর্ট বিভাগকে একটি ক্ষেত্রে আদি এখতিয়ার দিয়েছে। আদি এখতিয়ার মানে বিচারিক আদালত হিসেবে যে এখতিয়ার প্রয়োগ করা হয়। সংবিধানের ১০২ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী হাইকোর্ট বিভাগ যে এখতিয়ার প্রয়োগ করে তা রীট এখতিয়ার নামে পরিচিত।
রীটের প্রকারভেদ
বাংলাদেশ সংবিধানে পাঁচ ধরনের রীটের কথা বলা আছে। যথা:
- (১) Writ of Habeas Corpus (হেবিয়াস কর্পাস)
- (২) Writ of Mandamus (ম্যান্ডামাস)
- (৩) Writ of Prohibition (প্রহিবিসন)
- (৪) Writ of Certiorari ( ছারসিওরারি)
- (৫) Writ of Quo Warranto (কুয়া ওয়ারেন্টো)
(১) বন্দী প্রদর্শন রীট (Writ of Habeas Corpus): যখন কোন ব্যক্তিকে বেআইনীভাবে আটক করা হয়, তখন বন্দী হাজির রীট পিটিশন দায়ের করা যায়। কোন ব্যক্তিকে সরকার বা অন্য কেউ আটক করলে কি কারণে তাকে আটক করা হয়েছে তা জানার জন্য বন্দীকে আদালতে হাজির করার নির্দেশ দিয়ে হাইকোর্ট বিভাগ আটককারীকে যে আদেশ দিয়ে থাকেন তাকে বন্দী প্রদর্শন রীট বলে। অবৈধভাবে কাউকে যেন আটক করা না হয়, সেজন্য বন্দী প্রদর্শন রীট জারী করা হয়। তাছাড়া নাগরিকের ব্যক্তি স্বাধীনতাকে সুনিশ্চিত করার জন্য ও এই রীট জারী করা হয়।
(২) হুকুম জারী রীট (Writ of Mandamus): হুকুম জারী রীটের মাধ্যমে হাইকোর্ট বিভাগ কোন ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান, ট্রাইব্যুনাল বা আদালতকে আইনগত দায়িত্ব পালন করার নির্দেশ দিতে পারে। তার মানে কোন অধস্তন আদালত, ট্রাইব্যুনাল, ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান যদি তার আইনগত দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয় বা অস্বীকার করে তাহলে হাইকোর্ট বিভাগ যে আদেশের মাধ্যমে উক্ত আইনগত দায়িত্ব পালন করতে উক্ত আদালত বা ট্রাইব্যুনালকে বাধ্য করে তাকে হুকুম জারী রীট বলে। হুকুম জারী রীটের আরেক নাম পরমাদেশ রীট।
(৩) নিষেধাজ্ঞামূলক রীট (Writ of Prohibition): এই রীটের মাধ্যমে হাইকোর্ট বিভাগ কোন ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান, ট্রাইব্যুনাল কিংবা আদালতকে বেআইনী কাজ থেকে বিরত থাকতে আদেশ দিতে পারে। বৃটেনে নিষেধাজ্ঞামূলক রীটকে বিচার বিভাগীয় রীট বলা হয়। কারণ এই রীট শুধু মাত্র কোন বিচার বিভাগীয় বা আধা-বিচার বিভাগীয় সংস্থার বিরুদ্ধে প্রয়োগ করা যায়। যেমন- আইন কমিশনকে আধা-বিচার বিভাগীয় সংস্থা বলা হয়। বাংলাদেশের সংবিধানে নিষেধাজ্ঞামূলক রীটকে আর বিচার বিভাগীয় রীট বলা যায় না। কারণ ইহা বর্তমানে বাংলাদেশে যেকোন ব্যক্তি বা সংস্থার বিরুদ্ধে প্রয়োগ করা যায়।
(৪) উৎপ্রেষণ রীট (Writ of Certiorari): অধস্তন আদালত ক্ষমতা বহির্ভূত কোন কাজ করেছে কিনা তা তদারকি করার জন্য হাইকোর্ট বিভাগ কর্তৃক এই রীট জারী করা হয়। কোন আদালত, ট্রাইব্যুনাল,ব্যক্তি বা সংস্থা যদি তার আইনগত ক্ষমতাকে লংঘন করে কিংবা principle of natural justice যদি ভঙ্গ করে তবে হাইকোর্ট বিভাগ যে আদেশের মাধ্যমে উক্ত কাজ নাকচ করে দেয় তাকে উৎপ্রেষণ রীট বলে।
নোট: নিষেধাজ্ঞামূলক রীট ও উৎপ্রেষণ রীটের মধ্যে পার্থক্য আছে। যখন কোন কর্তৃপক্ষ বেআইনী কাজ করেনি কিন্তু করতে উদ্যত হচ্ছে তখন নিষেধাজ্ঞামূলক রীট জারী করা হয়। আর যেখানে কোন কর্তৃপক্ষ বেআইনী কাজ করে ফেলেছে সেখানে উৎপ্রেষণ রীট জারী করা হয়। তার মানে নিষেধাজ্ঞামূলক রীট হল প্রতিরোধক (Preventive) আর উৎপ্রেষণ রীট হল সংশোধক (Curative)। নিষেধাজ্ঞামূলক রীট ক্ষমতা বহির্ভূত কাজকে শুরুতেই বাধা প্রদান করে। আর Writ of Certiorari এর উদ্দেশ্য হল ক্ষমতা বহির্ভূত কাজকে বাতিল বা নাকচ করে দেয়া।
(৫) কারণ দর্শাও রীট (Writ of Quo Warranto): কোন ব্যক্তি যদি এমন কোন সরকারী পদ দাবী করে, যে পদের যোগ্যতা তার নেই অথবা অবৈধভাবে যদি কোন সরকারী পদ দখল করে বসে থাকে, তাহলে হাইকোর্ট বিভাগ যে আদেশের মাধ্যমে উক্ত ব্যক্তিকে তার পদ দখলের বা দাবীর কারণ দর্শানোর নির্দেশ দিয়ে থাকে তাকে কারণ দর্শাও রীট বলে। এই রীটের মাধ্যমে উচ্চ আদালত সরকারী পদ দাবীর বৈধতা অনুসন্ধান করে। সরকারী পদের দাবী অবৈধ প্রমাণিত হলে উচ্চ আদালত তাকে পদচ্যুত করার নির্দেশ দিতে পারে। একটা কথা বলে রাখা প্রয়োজন। কারণ দর্শাও রীট যেকোন ব্যক্তি করতে পারে। এক্ষেত্রে আবেদনকারীকে সংক্ষুব্ধ (aggrieved) হবার প্রয়োজন নেই। দাবীকৃত সরকারী পদটি অবশ্যই সংবিধান বা আইন দ্বারা সৃষ্ট পদ হতে হবে।
নোট: তিন ধরনের রীট একমাত্র সংক্ষুব্ধ (aggrieved) ব্যক্তি করতে পারে। অন্য কোন ব্যক্তি সংক্ষুব্ধ ব্যক্তির পক্ষ হয়ে এই তিন ধরণের রীট করতে পারে না। রীটের নামগুলো হল হুকুমজারী রীট, নিষেধাজ্ঞামূলক রীট এবং উৎপ্রেষণ রীট। এই তিনটি রীট একমাত্র সংক্ষুব্ধ ব্যক্তিই করতে পারে। অপরদিকে বন্দী প্রদর্শন রীট এবং কারণ দর্শাও রীট যেকোন ব্যক্তির আবেদনক্রমে হতে পারে। এই দুইটি রীট করতে কোন ব্যক্তিকে সংক্ষুব্ধ হবার প্রয়োজন নেই।
হাইকোর্ট বিভাগের স্ব-উদ্যোগে [suo motu] রীট জারির এখতিয়ার
কোন পত্র বা তথ্যে বা সংবাদপত্রে প্রকাশিত সংবাদের উপর ভিত্তি করে হাইকোর্ট বিভাগের স্ব-উদ্যোগে [suo motu] রীট জারি করার এখতিয়ার সংবিধানের ১০২ অনুচ্ছেদে বলা নেই। তবে বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ The Supreme Court of Bangladesh (High Court Division) Rules,1973 এর ১০ বিধি অনুযায়ী কোন পত্র বা তথ্যে বা সংবাদপত্রে প্রকাশিত সংবাদের উপর ভিত্তি করে স্ব-উদ্যোগে [suo motu] রীট জারি করতে পারে। এটাকে হাইকোর্ট বিভাগের Epistolary Jurisdiction বলা হয়। তবে এক্ষেত্রে অবশ্যই জনগণের মারাত্মক ক্ষতি হতে যাচ্ছে বলে আদালতের নিকট প্রতীয়মান হতে হবে। Tayeeb vs Bangladesh (২০১৫) মামলায় আপীল বিভাগ মতামত দেন, কারো মৌলিক অধিকার লংঘন হলে হাইকোর্ট বিভাগ স্ব-উদ্যোগে [Suo motu] রীট জারী করতে পারে। তবে এক্ষেত্রে great public importance থাকতে হবে। সংবাদপত্রের রিপোর্ট, কোন তথ্যকে হাইকোর্ট বিভাগ কর্তৃক এক্ষেত্রে রীট এপ্লিকেশন হিসেবে বিবেচনা করা হবে।
রীট সম্পর্কিত বিখ্যাত মামলা
*মহিউদ্দিন ফারুক বনাম বাংলাদেশ (১৯৯৬)
এই মামলা ফ্যাপ-২০ (পরিবেশ বিষয়ক) মামলা নামেও পরিচিত। এই মামলার রায়ের মাধ্যমে বাংলাদেশে জনস্বার্থমূলক মামলা (Public Interest Litigation) করার আনুষ্ঠানিক দ্বার খুলে যায়। আপীল বিভাগ এই মামলায় বলেন- “Aggrieved Person” কথাটি শুধুমাত্র ব্যক্তিগতভাবে অর্থাৎ প্রত্যক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিকে বুঝায় না বরং এটা জনসাধারণ পর্যন্ত বিস্তৃত। তার মানে “Aggrieved Person” বলতে জোটবদ্ধ বা সমষ্টিগত ব্যক্তিকেও বুঝায়।*মোখলেছুর রহমান বনাম বাংলাদেশ [২৬ DLR ১৯৭৪,(AD)৪৪]
রীটের জন্য আবেদন প্রসঙ্গে “সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি” কথাটি এই মামলায় উদারভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। আবেদনকারী ব্যক্তি কাজী মুখলেছুর রহমান বাংলাদেশের বেড়ুবাড়ী এলাকার বাসিন্দা ছিলেন না। হাইকোর্ট বিভাগ আবেদনটিকে অসময়োচিত (Pre-mature) বলে খারিজ করে দেন। আপীল বিভাগ আবেদনকারীর আবেদন করার যোগ্যতাকে [লোকাস স্ট্যান্ডি(Locus Standi) বা সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি] বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে বৈধতা দেয়।
চাকুরী থেকে অপসারিত একজন সরকারী কর্মচারী তার অপসারণের বিরুদ্ধে রীট দায়ের করতে পারে কিনা?
নিয়ম অনুযায়ী সরকারী চাকুরী সংক্রান্ত বিষয়গুলো প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনাল নিষ্পত্তি করে থাকেন। চাকুরী থেকে অপসারিত একজন সরকারী কর্মচারী ইচ্ছা করলে তার অপসারণের বিরুদ্ধে উৎপ্রেষণ রীট (Writ of Certiorari) দায়ের করতে পারেন। এই রীটের মূল কথা হলো, কোন অধস্তন আদালত, ট্রাইব্যুনাল, কর্তৃপক্ষ, সংস্থা বা ব্যক্তি তার আইনগত ক্ষমতাকে লঙ্ঘন করে কিংবা স্বাভাবিক ন্যায়-নীতি ভঙ্গ করে তবে হাইকোর্ট বিভাগে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি আবেদন করতে পারেন। এই ধরনের আবেদনের উপর ভিত্তি করে হাইকোর্ট বিভাগ অপসারণ আদেশ বৈধ কিনা তা যাচাই করে দেখতে পারেন। সরকারী কর্মকর্তাকে যদি অন্যায়ভাবে অপসারণ করা হয়ে থাকে তাহলে উক্ত অপসারণ আদেশকে হাইকোর্ট বিভাগ অবৈধ ঘোষণা করতে পারেন।
রীট সম্পর্কে একটা সামগ্রিক আলোচনা করার চেষ্টা করেছি। এই আলোচনা থেকে আপনারা কিছুটা উপকৃত হলেও আমার পরিশ্রম সার্থক হবে।
ছগির আহমেদ টুটুল: সহকারী জজ; জেলা ও দায়রা জজ আদালত, শরীয়তপুর।