কাজী শরীফ: আমার আদালতে একটা ঘোষণামূলক মোকদ্দমা বিচারাধীন। বাদীপক্ষের একতরফা শুনানি ছিল দিন দুয়েক আগে ৷ মোকদ্দমার বাদীপক্ষ আদালতের কাছে একজন কন্যা সন্তানের পিতা-মাতা হিসেবে নিজেদের নাম ঘোষণার প্রার্থনা করেছেন। বাদীর দাবি হলো ২০০২ সালের ২রা ফেব্রুয়ারি তার স্ত্রী শীতের দিনে আগুন পোহাতে গিয়ে দুর্ঘটনাবশত মারাত্নকভাবে অগ্নিদগ্ধ হন৷তখন তিনি ছিলেন অন্তঃসত্ত্বা।
হাসপাতালে ভর্তি করালে ডাক্তার সাহেব চার তারিখে সিজারের মাধ্যমে কন্যাসন্তান ফাতেমাকে (ছদ্মনাম) ভূমিষ্ঠ করান। ভদ্রমহিলা অগ্নিদগ্ধ ও অসুস্থ বলে এ সন্তানকে লালনপালন করেন ভদ্রমহিলার নিঃসন্তান চাচাতো বোন ও তার স্বামী। ফাতেমা তাদের কাছেই কন্যা পরিচয়ে বড় হতে থাকে।
ঐ ঘরে থেকে ফাতেমা জে এস সি ও এস এস সি পাশ করেন। বর্তমানে তিনি উচ্চ মাধ্যমিকে পড়ছেন। এখন ফাতেমার আসল পিতা মাতা কন্যার পিতামাতা হিসেবে আইনানুগ স্বীকৃতি চান। কারণ জে এস সি ও এসএসসির সনদে ফাতেমার পিতা মাতার নাম হিসেবে ভদ্রমহিলার নিঃসন্তান বোন ও বোনের জামাইয়ের নাম দেয়া আছে। এখন যখন প্রকৃত পিতা-মাতা কন্যাকে প্রকৃত সত্য বলে নিজেদের কাছে নিয়ে এসেছে তখন ভবিষ্যৎ জটিলতা এড়াতে পিতা মাতার নামের সংশোধন চায়।
আগের দুই সনদের ত্রুটি সংশোধন করতে কুমিল্লা শিক্ষাবোর্ডে আবেদন করেন। নিয়মানুযায়ী কুমিল্লার সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক স্বাক্ষরিত হলফনামা ও পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দিয়ে আবেদন করলেও শিক্ষাবোর্ড সংশোধন করে দিতে অস্বীকৃতি জানানোয় কন্যার পিতার আদালতে আগমন।
উল্লেখ করা প্রয়োজন ভদ্রলোকের কন্যার পালিত পিতা মাতা ইতোমধ্যে জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের সম্মুখে হলফনামা সম্পাদন করে তারা যে এ কন্যার পিতা মাতা নন এ ব্যাপারে স্বীকৃতি দিয়েছেন৷তবু কুমিল্লা শিক্ষাবোর্ড জেএসসি ও এসএসসির সনদে পিতামাতার নাম সংশোধন না করায় বাদী আদালতের দ্বারস্থ হয়েছেন।
এ মামলায় মূল বিবাদী করা হয়েছে কুমিল্লা শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যান, পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক ও সংশ্লিষ্ট বোর্ডের সেক্রেটারিকে। মোকাবেলা বিবাদী হলেন ফাতেমাকে ছোটবেলা থেকে লালন পালন করা খালা খালু।
শিক্ষাবোর্ড জানে এ মোকদ্দমা একটা আনুষ্ঠানিকতা মাত্র আর কন্যাকে লালন পালন করা খালা খালু হয়তো রবি ঠাকুরের কথাই মেনে নিয়েছেন “অধিকার ছাড়িয়া দিয়া অধিকার রাখিতে যাইবার মত এমন বিড়ম্বনা আর নাই।” তাই বিবাদীপক্ষের কেউই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন না।
কন্যার পিতা কন্যার পক্ষে ও নিজ পক্ষে জবানবন্দি দিতে এসে জানালেন মামলার বিস্তারিত বিবরণ। আমি ফাতেমাকে ডাক দিলাম। জিজ্ঞেস করলাম তিনি কবে জেনেছেন এ সত্য? এখন কোথায় থাকেন? যারা লালন পালন করেছেন তাদের সাথে দেখা করেন কিনা?
তার উত্তর শুনে বললাম “আপনার খালা-খালুর সাথে যোগাযোগ রাখবেন। তাদের পিতামাতার মর্যাদা দেবেন। আপনার পিতামাতার দুঃসময়ে তারা যে পরম মমতায় আপনাকে রেখেছিল তা ফিরিয়ে দেয়ার সামর্থ্য দুনিয়ার কারো নেই তবে অকৃতজ্ঞ এ সমাজে আপনিও অকৃতজ্ঞ হবেন না।”
এ কথাগুলো যখন বলছি তখন আমি কন্যার চোখে পানি দেখেছি৷এ পানি ভালোবাসার, এ পানি আপনজনকে পেছনে ফেলে আসার বেদনার কিংবা নিজের জন্মদাতাদের আইনানুগভাবে পাওয়ার আনন্দের বহিঃপ্রকাশ। আমি জানি মুসলিম আইনে দত্তক নেই, আমি জানি আইনানুগভাবেই কন্যার পিতামাতার স্বীকৃতি পাচ্ছেন আসল পিতামাতা।
তবু আমার চোখেও জমে গেলো একফোঁটা জল। মুহুর্তেই চোখের সামনে ভেসে উঠলো ওই নিঃসন্তান দম্পতির মুখ যারা পেলেপুষে এত বড় করে কন্যার মা বাবা হতে পারলো না! সম্ভবত সন্তান না হওয়ার কষ্ট থেকে বুকের মানিক ছিনিয়ে নেয়ার কষ্ট ঢের বেশি। এরমাঝেই পেশকার সাহেব অন্য একটা নথি তুলে দিলেন। তার আওয়াজে ফিরে এলাম স্বাভাবিক কাজে।
সব আগের মত হয়ে যাবে। মেয়েটি তার মা বাবার নামসহ সনদ পাবে, কন্যার মা বাবা কন্যাকে জড়িয়ে ধরে ভালোবাসার ওম খুঁজবে। এ বিচারক নতুন নতুন নথিতে নতুন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হবে। শুধু থাকবেনা দেড়যুগ ধরে লালন পালন করে ফাতেমাকে পেয়ে মাতৃত্ব ও পিতৃত্বের স্বাদ পাওয়া এক নিঃসন্তান দম্পতির জীবনের আনন্দ, উচ্ছলতা।
আদালত শুধু ডিক্রি আর ডিসমিসের জায়গা নয়। এটা আমাদের নতুন নতুন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি করে। প্রতিনিয়ত নতুন গল্পের চাপে পুরনো গল্প রঙ হারায়। কিছু গল্প তবু মনে রয়ে যায় বহুদিন। কিছু গল্প কেড়ে নেয় চোখের ঘুম। ফাতেমাকে কন্যাসম স্নেহে লালন পালন করা মা বাবার জন্য দোয়া। পরম করুণাময় ও অসীম দয়ালু আল্লাহ তায়ালা তাদের হেফাজতে রাখুক।
কাজী শরীফ: সহকারী জজ, নোয়াখালী।