সাব্বির এ মুকীম: বাংলাদেশে আইনজীবীরা পেশাগত ক্ষেত্রে ১টি দিক দিয়ে যতোটা স্বাধীন, আর কোনো পেশা ততোটা স্বাধীনতা নয়- হলফ করে বলা যায়। সে স্বাধীনতা হলো- সোজা ভাষায় সিনিয়রদের সমালোচনা করার স্বাধীনতা আর কঠিন ভাষায় পেশাগত মানসিক স্বাধীনতা তথা স্বনামে নিজ পেশার সংক্রান্ত সমালোচনা জনসমক্ষে প্রকাশ্যে করতে পারার স্বাধীনতা, আমি আবারও লিখি- সমালোচনা জনসমক্ষে প্রকাশ্যে করতে পারার স্বাধীনতা।
উদাহরণ স্বরুপ:– বার কাউন্সিলের চেয়ারম্যান, সুপ্রীম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি এবং বাংলাদেশের অ্যাটর্নি জেনারেল জনাব এম আমিন উদ্দিন স্যার এর যে পরিমান আক্রমন বিক্ষুব্ধ শিক্ষানবীশ আইনজীবীরা করেছেন তার হাজার ভাগের একভাগ সমালোচনা অন্য কোনো পেশায় অসম্ভব। সম স্তরের লোক দূরে থাক, অন্য পেশায় একজন সর্বোচ্চ সিনিয়রও পেশায় তাঁর সর্বোচ্চ জুনিয়রের সমালোচনা প্রকাশ্যে জনসমক্ষে প্রকাশ করার সাহস রাখেন না। আর নিজ পেশার সমালোচনা তো আরও অসম্ভব। এটার পাল্টা জবাবও আছে বহু- কিছু ইতিবাচক, বেশীরভাগই নেতিবাচক। কিন্তু মূল ফ্যাক্ট টা বহাল থেকেই যায় যে, প্রকাশ্যে আমরা আইনজীবীরা আমাদের পেশার প্রতি আমাদের সমালোচনা প্রকাশ করতে পারি। একইভাবে জুম্মন সিদ্দিকির সনদ নিয়ে সিনিয়র আইনজীবী ব্যারিষ্টার আমিরুল ইসলাম যে সমালোচনার শুনেছেন, তা করার সুযোগ অন্য কোনো পেশায় নাই। এমন আরও আরও উদাহরণ টানা যাবে।
জুরিসপ্রুডেন্স এর বড়ো একটি পাঠ হলো, যেহেতু স্বাধীনতা একটি অধিকার আর প্রত্যেকটা অধিকার এর বিপরীতে এক বা একাধিক দায়িত্ব তৈরী হয়, তাই আলোচ্য স্বাধীনতাও আইনজীবীদের জন্য দায় তৈরী করে। তেমন ই ২টি দায়- এজলাস চলাকালীন একজন আইনজীবীর আচরণ কেমন হবে সে সংক্রান্ত বিধান মেনে আচরণ করা এবং কর্মকালীন পোষাক বিধি মেনে চলার দায়।
এজলাস চলাকালে আইনজীবীগণের আচরণ বিধি
“ব্যবহারে বংশের পরিচয়” প্রবাদ এর আইনপেশায় (আমি আবারও লিখি) আইন পেশায় অনুবাদ হলো- এজলাস চলাকালীন ব্যবহারে আইনপেশাজীবীর (আমি আবারও লিখি) আইনপেশাজীবীর ব্যবহারই সে পেশাজীবীর পেশার পরিচয়। সে বাটখারায়–আমার এজলাসে আমার ব্যবহার, আমার পেশার ভাবমূর্তি তৈরী করে- আইনপেশা সমূহের অন্যতম একটি পেশা আইনজীবীদের এ কথা মাথায় রেখে এজলাসে আচরণ করা বাঞ্চনীয়। এ সংক্রান্ত সর্বস্তরে প্রযোজ্য কোনো সুস্পষ্ট বিধান নেই। কেবল হাইকোর্ট ডিভিশন ১৯৭৩ (সংশোধণী) ২০১২ কিছু কথা বলা আছে। সাধারণ আইনের অভাবে বিশেষ আইন সাধারণ আইনের কাজ করে। তাই হাইকোর্ট ডিভিশন রুলসের ১৬এ অধ্যায়ের ১নং বিধানের ১নং, ২নং ও ৩নং উপবিধান সমূহ অনুয়ায়ী আইনজীবীগিণ এজলাস চলাকালে যে আচরণ করতে বাধ্য তা নীচে বাংলা অনুবাদ করে হলো:-
(১) এজলাস চলাকালে আইনজীবীগণ এমনভাবে আচরণ করবে যাতে কোনোভাবেই আদালতের কার্যক্রমে বিঘ্ন না ঘটে।
(২) এজলাস চলাকালে ব্যবহার নিষিদ্ধ।
(৩) এজলাস চলাকালে মোবাইল ফোন বন্ধ করে রাখতে হবে।
(৪) এজলাস চলাকালে কোনো কিছু খাওয়া , পান করা, চিবোনো, ধোঁয়া নেয়া, ধূমপান করা নিষিদ্ধ।
(৫) এজলাস চলাকালে কারও সাথে কথা বলা বা আড্ডা দেয়া নিষিদ্ধ।
(৬) এজলাস চলাকালে আদালতে ব্যবহৃত মাইক্রোফন ব্যতীত কোনোধরণের শব্দ তৈরী করে এমন ডিভাইস ব্যবহার করা নিষিদ্ধ।
ব্যাখ্যা
(i) তবে ল্যাপটাপ বা কাজের সুবিধার্থে অন্যকোনো ডিভাইস ব্যবহার করা যাবে।
(ii) কেবল বিজ্ঞ আদালত নিজে অথবা তাঁর অনুমতি সাপেক্ষে কেবল কোর্ট স্টাফ ভয়েস রেকর্ডার ব্যবহার করতে পারবে।
(৭) নিরাপত্তা জনিতকারণে আদালত প্রশাসন ব্যাতীত আর কারও কোনোও ধরণের ডিভাইস ব্যবহার করে ছবি তোলা [সেল্ফি তোলা সহ], ভিডিও করা নিষিদ্ধ।
(৮) কোনো ধরণের ব্যাগ, ছাতা, ডান্ডা, ভারী বস্তু বা যেকোনো ধরণের অস্ত্র বহন করা নিষিদ্ধ।
(৯) শব্দ তৈরী করে এমনধরণের যেকোনো জুতা পরিধান করা নিষিদ্ধ।
(১০) এজলাস চলাকালে ঘুমানো, নাকডাকা নিষিদ্ধ।
(১১) বিজ্ঞ আদালত কে যথাযোগ্য মর্যাদার সম্বোধন করা।
এজলাস চলাকালে আইনজীবীগণের পোষাক বিধি
কর্মকালীন পোষাক বা ইউনিফর্ম নিয়ে আইনজীবী পেশার জন্য সুস্পষ্ট বিধান রয়েছে। আবার তা সংখ্যায় এতো রকম ফের এর যে, তা আবার আরেক ধরণের অস্পষ্টতা তৈরী করে। আইনজীবীদের এজলাস চলাকালীন পোষাক নিয়ে বিধানে ক্রিমিনাল রুলস এন্ড অর্ডাস এ এমন অস্পষ্টতা তৈরী হয়েছে তা আন্দাজ করতে বাধ্য করে যে এটি লেখার সময় বোধহয় প্রচন্ড তাড়াহুড়া করা হয়েছিলো। বিভিন্ন বিধান মিলিয়ে প্রায় ১৭ রকম পোষাক বিধি আছে যার ফলাফল হচ্ছে প্রায় ই দেখা যায় লাল শার্ট পরে, নীল জিন্স পরে, হলুদ কোর্ট পরে, কমলা টাই পরে কোনো কোনো আইনজীবী আদালতে সাবমিশন রাখছেন। তদুপরী এই ১৭/১৮/১৯ রকমের পোষাক বিধিতে কোথাও পরিধেয় জুতা সংক্রান্ত বিধান নাই। অথচ উপরের আচরণ বিধিতে স্পষ্ট, এজলাস চলাকালে পেন্সিল হিল টাইপ শব্দ করা জুতা পরা নিষিদ্ধ। এছাড়াও ছেলেদের ক্ষেত্রে চুল-গোঁফ-দাড়ি সংক্রান্ত বিধান নাই। আমরা এখনও এতোটা উন্নত দার্শনিক সমাজে পৌঁছতে পারিনি যেখানে পোষাক এর মর্যাদাকে অস্বীকার করা যায়।
আশা করি বিজ্ঞ আইনজীবীগণ সকলে, সকলের জন্য প্রার্থনা করবেন যেনো আমরা সকল আইনজীবী এজলাস চলাকালে বিধি মোতাবেক আচরণ করতে ও পোষাক পরতে পারি।
সাব্বির এ মুকীম: অ্যাডভোকেট; জজ কোর্ট, কুমিল্লা। ই-মেইল: samukim1@gmail.com