খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার ভদ্রা ও হরি নদীসহ বিভিন্ন নদীর বুক দখল করে গড়ে তোলা ইটভাটা নির্মাণ কাজের ওপর তিন মাসের স্থিতাবস্থা জারি করেছেন হাইকোর্ট। এর ফলে ওইসব এলাকায় নদী দখল করে ইটভাটার বিস্তৃতি বাড়ানোর যে কাজ চলছিল সেটি বন্ধ থাকবে বলে জানিয়েছেন রিটকারীদের আইনজীবী মনজিল মোরসেদ।
এ বিষয়ে আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে খুলনার পরিবেশ অধিদফতরের প্রধান, খুলনা জেলা প্রশাসক (ডিসি), খুলনা জেলা পুলিশ সুপার (এসপি), পানি উন্নয়ন বোর্ড খুলনার এক্সিউটিভ ইঞ্জিনিয়ার, ডুমুরিয়া উপজেলা নির্বাহী অফিসারকে হাইকোর্টে একটি প্রতিবেদন জমা দেয়ার জন্য বলা হয়েছে।
একই সঙ্গে আদালত রুল জারি করেছেন। রুলে খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার ভদ্রা ও হরি নদীসহ বিভিন্ন নদীর বুক দখল করে মাটি ভরাট, দখল, নির্মাণ, বাঁধ দেয়া বন্ধ ও অপসারণে বিবাদীদের নিষ্ক্রিয়তা কেন অবৈধ ও বেআইনি ঘোষণা করা হবে না তা জানতে চাওয়া হয়েছে। রুলে মাটি ভরাট, দখল, নির্মাণ, বাঁধ দেয়া বন্ধ ও অপসারণে কেন নির্দেশ দেয়া হবে না তাও জানতে চাওয়া হয়েছে।
আগামী চার সপ্তাহের মধ্যে খুলনা-৫ আসনের সংসদ সদস্য, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সচিব, পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব, বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের সচিব, পরিবেশ অধিদফতরের মহাপরিচালক (ডিজি), খুলনার পরিবেশ অধিদপ্তরের প্রধান, ডুমুরিয়া উপজেলা চেয়ারম্যান, জেলা প্রশাসক (ডিসি) ও জেলা পুলিশ সুপার এসপিসহ সংশ্লিষ্টদের সংশ্লিষ্ট ১৪ জনকে এই রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে।
অপর এক আদেশে, সিএস এবং আরএস অনুযায়ী ভদ্রা ও হরি নদীর সীমানা নির্ধারণ করে আগামী তিন মাসের মধ্যে হাইকোর্টকে জানাতে খুলনার জেলা প্রশাসক (ডিসি) এবং ডুমুরিয়া সদর উপজেলার এসিল্যান্ডকে নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।
আইনজীবী মনজিল মোরসেদ শনিবার (২৭ ফেব্রুয়ারি) গণমাধ্যমকে আদেশের বিষয়টি নিশ্চিত করে জানান। তিনি বলেন, বৃহস্পতিবার (২৫ ফেব্রুয়ারি) হাইকোর্টের বিচারপতি মো. মজিবুর রহমান মিয়া ও বিচারপতি মো. কামরুল হোসেন মোল্লার সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ রুল জারিসহ এসব আদেশ দেন।
আদালতে রিটের পক্ষে শুনানি করেন অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ। তার সঙ্গে ছিলেন সঞ্জয় মণ্ডল। অন্যদিকে রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল ব্যারিস্টার নওরোজ মো. রাসেল চৌধুরী।
এর আগে গত ১২ ফেব্রুয়ারি বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন সংযুক্ত করে মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের (এইচআরপিবি) পক্ষে আইনজীবী ছারোয়ার আলম চৌধুরী, একলাছ উদ্দিন ভূঁইয়া এবং রিপন বাড়ৈ গত ২২ ফেব্রুয়ারি এই রিট দায়ের করেন। ওই রিটের শুনানি নিয়ে রুল জারিসহ এসব আদেশ দেন হাইকোর্ট।
পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার ভদ্রা, হরি ও ঘ্যাংরাইল নদী, রূপসার আঠারোবাকী নদী, বটিয়াঘাটার কাজিবাছা নদী, পাইকগাছার শিপসা নদী, কয়রার কপোতাক্ষ নদসহ বিভিন্ন নদীর পাড়ে ইটভাটা গড়ে তোলা হয়েছে। এসব ভাটা মালিকরা প্রতি বছর নদীর বুক দখল করে ভাটার বিস্তৃতি বাড়াচ্ছেন।
স্থানীয় লোকজনের অভিযোগ, কেবি ব্রিকস নামের একটি ইটভাটা ভদ্রা নদীর সীমানা নির্ধারণকারী পিলার থেকে আরও ভেতরে ইট-সুরকি ও বালু দিয়ে নদী ভরাট করে ইটভাটা বানিয়েছে। ভাটায় শুধু কয়লা দিয়ে ইট পোড়ানোর নিয়ম থাকলেও এখানে গাছের গুঁড়ি ও কাঠ দিয়ে ইট পোড়ানো হচ্ছে। স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সঙ্গে সুসম্পর্ক থাকায় মালিকদের বিরুদ্ধে কেউ কিছু বলার সাহস পায় না।
‘কেবি ব্রিকসের’ মতো ভদ্রা ও হরি নদীর চার কিলোমিটারের মধ্যে গড়ে তোলা হয়েছে প্রায় ১৮টি ইটভাটা। ইটভাটার মালিকরা জায়গা দখল করায় নদীর গতিপথ পরিবর্তন হচ্ছে। কোথাও কোথাও নদী প্রায় মরে গেছে। এতে ভাঙনের হুমকির মুখে পড়েছে সেতু ও বাজার। ভাটাগুলোর অধিকাংশ বসতবাড়ির ১০ থেকে ১০০ গজের মধ্যে। বসতবাড়ির কাছে হওয়ায় ভাটার ধোঁয়া-বালিতে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছেন বাসিন্দারা।
ডুমুরিয়ার খর্ণিয়া গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, ইটভাটার চারপাশে মাটি ফেলে ভদ্রা নদীর চর ভরাট করে পুরো জমি উঁচু করা হয়েছে। খননযন্ত্র (এস্কেভেটর) দিয়ে বড় বড় গর্ত করে মাটি তুলে ইট তৈরি করা হচ্ছে। আর কাঠ পুড়িয়ে তৈরি করা হচ্ছে ইট। ভাটার পাশে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহারের জন্য কয়েকশ’ মণ কাঠ স্তূপ করে রাখা।
জানতে চাইলে কেবি ব্রিকসের মালিক ও ডুমুরিয়া সদর ইউপি চেয়ারম্যান হুমায়ুন কবির বুলু বলেন, ‘বেশিরভাগ জমিই স্থানীয় মালিকদের কাছ থেকে নন জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে একটি চুক্তি করে নেয়া হয়েছে। আর কিছু জমি পানি উন্নয়ন বোর্ডের। সেখানে আমরা শুধুমাত্র মাটি কেটে ফেলে রাখি।’
পরিবেশ অধিদফতর ও জেলা প্রশাসনের কোনো অনুমোদন আছে কিনা, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘সবকিছুর অনুমোদন নিয়ে ইটভাটা পরিচালনা করছি।’
কৃষিজমিতে কীভাবে অনুমোদন পেলেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘২০ বছর আগে থেকে এই ভাটার কার্যক্রম চলে আসছে। তখন কৃষিজমি বোঝার উপায় ছিল না। এখন যারা ভাটা নির্মাণ করছে তারাই নদী ও কৃষি জমি ব্যবহার করতে পারে বলে মন্তব্য করেন তিনি।’
প্রসঙ্গত, ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইনের ২০১৩ অনুচ্ছেদ ৮-এর (গ) ধারা অনুযায়ী, সরকারি বা ব্যক্তিমালিকানাধীন বন, অভয়ারণ্য, কৃষিজমি, বাগান ও জলাভূমি এলাকায় ইটভাটা স্থাপন দণ্ডনীয় অপরাধ।