নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলায় বালুবাহী নৌযানের (বাল্কহেড) চার শ্রমিক হত্যা মামলায় দুই আসামিকে মৃত্যুদণ্ড ও নয় জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। একই সঙ্গে যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত নয় জনের প্রত্যেককে ৫০ হাজার টাকা করে অর্থদণ্ড অনাদায়ে আরো এক বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।
এছাড়াও একটি ধারায় ১১ জনকে ১০ বছরের কারাদাণ্ড ও ১০ হাজার টাকা করে জরিমানা অনাদায়ে আরো ছয় মাসের কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত।
রোববার (২৮ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে এক যুগ পর নারায়ণগঞ্জ অতিরিক্ত দায়রা জজ ২য় আদালতের বিচারক বেগম সাবিনা ইয়াসমিন এ রায় ঘোষণা করেন। রায় ঘোষণার সময় ১১ আসামির মধ্যে সাত জন আদালতে উপস্থিত ছিলেন।
নিহতরা হলেন-কিশোরগঞ্জ বাজিতপুর কুকরাইর এলাকার ছেতু মিয়ার ছেলে নাছির মিয়া (৩৫), একই এলাকার ইব্রাহিম মিয়ার ছেলে মঙ্গল মিয়া, গুনু মিয়ার ছেলে হান্নান মিয়া (২৪) ও হাসান মিয়ার ছেলে ফয়সাল মিয়া (১৫)।
মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত দুই আসামি হলেন- তাজুল ইসলাম ওরফে তাজু ফিটার (৫০) ও মহিউদ্দিন ওরফে মহী ফিটার (৪৮)। যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা হলেন- চান মিয়া, দুলাল মিয়া, মজিবর, আব্দুল মান্নান, আরিফ ও পলাতক জলিল, সাইফুল ইসলাম, দুলাল ও শফিকুল। এ মামলার ইব্রাহিম নামে এক আসামি মারা গেছেন।
মামলার বরাত দিয়ে নারায়ণগঞ্জের অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর (এপিপি) কে এম ফজলুর রহমান বলেন, ‘২০০৮ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর বালুবাহী নৌযান (বাল্কহেড) ‘শাহপরান’ সিলেট থেকে পাথর বোঝাই করে মুন্সিগঞ্জের মুক্তারপুর সিমেন্ট কারখানায় আসে। পাথর খালাস করে দেওয়ার পর বাল্কহেডটির মেশিন নষ্ট হয়ে যায়। বাল্কহেডের মেশিন ঠিক করার জন্য মহী ফিটার ও তাজু ফিটারকে খবর দেন চালক নাসির। তারা এসে বাল্কহেডটি ঠিক করে টেস্ট করতে গিয়ে নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার বক্তাবলীর চরে লাগিয়ে দেয়। ওইসময় বাল্কহেডে নাসির মিয়া, মঙ্গল, ফয়সাল ও হান্নান ছিল। পরে যখন বক্তাবলী চর থেকে বাল্কহেডটি পরিত্যক্ত অবস্থায় পাওয়া যায় তখন ওই চার জন নিখোঁজ ছিল। তিন দিন পর মেঘনা নদীর চরে হাত পা বাঁধা অবস্থায় নাসির মিয়া ও মঙ্গলের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। কিন্তু অন্য দুইজন তখনও নিখোঁজ ছিল। পরে ২২ সেপ্টেম্বর শাহপরান বাল্কহেডের মালিক এরসাদ মিয়া ফতুল্লা থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন। পরে পুলিশ তদন্ত করে জলিল, দুলাল, ইব্রাহিম, দুলাল মিয়া, মজিবর, শফিকুল ইসলাম, তাজুল ইসলাম ও আরিফকে গ্রেফতার করে। তাদের মধ্যে সাত জন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। তারা স্বীকার করে চার জনকে গলা কেটে হত্যা করে মরদেহ নদীতে ফেলে দেয়।
তিনি আরো বলেন, ‘তদন্ত শেষে ২০০৯ সালের ২৬ মার্চ ১২ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করা হয়। এ মামলায় ১৮ জন সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়েছে। বিচার চলাকালীন ইব্রাহিম নামে এক আসামি মারা যায়। অপরাধ প্রমাণিত হওয়ায় আদালত আসামিদের মধ্যে মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত ফাঁসির দড়িতে ঝুলিয়ে দুই জনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর ও নয় জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছেন। একই সঙ্গে নয় জনের প্রত্যেককে ৫০ হাজার টাকা করে অর্থদণ্ড অনাদায়ে আরো এক বছরের কারাদণ্ড দেন। বাল্কহেড ডাকাতির অপরাধে ১১ জনকে ১০ বছরের কারাদণ্ড ও ১০ হাজার টাকা জরিমানা অনাদায়ে আরো ছয় মাসের কারাদণ্ড দেন আদালত। আর পলাতক আসামিদের দ্রুত গ্রেফতারের নির্দেশ দিয়েছেন।
নিহত শ্রমিকদের পরিবারের পক্ষে বাংলাদেশ কার্গো ট্রলার বাল্কহেড শ্রমিক ইউনিয়ন (রেজি নং বি ২১১২) এর সভাপতি জাহাঙ্গীর আলম বেপারী বলেন, এ রায়ে আমরা সন্তুষ্ট। দ্রুত রায় কার্যকর করার দাবি জানাচ্ছি।
এ রায়ে অসন্তোষ প্রকাশ করে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত মহী ফিটারের ছেলে মো. জুয়েল বলেন, ‘আমার বাবা কাউকে হত্যা করেনি। আমার বাবা বিএনপির রাজনীতি করতো। জাতীয়তাবাদী নৌযান শ্রমিক দলের কর্মী। এজন্য প্রতিপক্ষের লোকজন তাদের ফাঁসিয়েছে। আমরা উচ্চ আদালতে আপিল করবো। যাদের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি নেওয়া হয়েছে তারা মিথ্যা বলেছে। তাদের চাপ দিয়ে জবানবন্দি নেওয়া হয়েছে। তারা জবানবন্দি প্রত্যাহার করেছে।