রীনা পারভিন মিমি :
বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশ আর উন্নয়নশীল দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হলে সরকারকে বিভিন্ন সময়ে জনস্বার্থে এবং দেশের সার্বিক উন্নয়নের লক্ষ্যে শিল্প-কারখানা, বিদ্যুৎকেন্দ্র, রেলপথ, সড়ক বা সেতুর প্রবেশপথ বা এ জাতীয় অন্য কিছুর জন্য বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন স্থানে জমি অধিগ্রহণ করতে হয়। বর্তমানে বাংলাদেশে শতাধিক উন্নয়নশীল প্রকল্পের কাজ চলছে।তবে নতুন আইন স্থাবর সম্পত্তি অধিগ্রহণ ও হুকুম দখল আইন, ২০১৭ এর ধারা (১৩) অনুযায়ী ধর্মীয় উপাসনালয় (Mosque, temple), কবরস্থান (graveyard) ও শ্মশান (Cremator) অধিগ্রহণ করা যাবেনা। তবে শর্ত সাপেক্ষে এগুলো অধিগ্রহণ করা যাবে যদি তা জনপ্রয়োজনে বা জনস্বার্থে অধিগ্রহণ করা একান্ত প্রয়োজন হয়। সেক্ষেত্রে প্রত্যাশিত ব্যক্তি বা সংস্থার অর্থে স্থানান্তর ও পুনঃনির্মাণ করে দেওয়ার নিয়ম রয়েছে।
ভূমি অধিগ্রহণকৃত সম্পত্তির ক্ষতিপূরণের টাকা কে পাবে
ভূমি অধিগ্রহণ সম্পর্কে জ্ঞান না থাকার কারণে অনেকেই জানেন না, অধিগ্রহণের ফলে সম্পত্তির ক্ষতি পূরণ কে পাবে বা কোন ক্ষতিপূরণ পাওয়া যাবে কিনা? অনেকে আবার ভেবে থাকেন সরকার জমি নিবে তাই বলে কি আমাদের ক্ষতিপূরণ দিবে? জমির মালিক অবশ্যই ক্ষতিপূরণ পাবে। বর্তমান আইন অনুযায়ী তা জমির মূল্যের তিনগুণ করা হয়েছে। Aquisitionand Requisition of Immovable Property Ordinance, 1982 (Ordinance No. II of 1982) রহিত ক্রমে যুগোপযোগী করে বর্তমানে স্থাবর সম্পত্তি অধিগ্রহণ ও হুকুম দখল আইন, ২০১৭ প্রণয়ন করা হয়েছে আর যার ফলেই মূলত সরকারি ভাবে জমি অধিগ্রহণে ক্ষতিপূরণের পরিমাণ জমির দামের দেড়গুণ থেকে বাড়িয়ে তিনগুণ এবং বেসরকারিভাবে জমি অধিগ্রহণে ক্ষতিপূরণের পরিমাণ চারগুণ করা হয়েছে। একটি জমির মূল্য যদি এক কোটি টাকা হয় তাহলে আরও দুই কোটি টাকা যুক্ত হয়ে তিন কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ (সরকারি অধিগ্রহণে) পাবেন । তাহলে দেখা যাচ্ছে জমির প্রকৃত মালিক জমির মূল্যের ৩ গুণ ক্ষতিপুরন পাবে।
ক্ষতিপূরণ আদায় করতে গিয়ে সাধারন জনগনের মনে প্রশ্নের সঞ্চার হয় এই ক্ষতিপূরণ কীভাবে পাবে বা জমির মুল্য কি হিসেবে ধরা হবে।এই সকল বিষয়ে অনেকেরই ধারণা নেই বলে তারা ন্যায্য ক্ষতিপূরণ পেতে পারে না বা পায় না ।
অধিগ্রহণকৃত সম্পত্তির ক্ষতিপূরণের মূল্য কীভাবে আরোপিত হবে?
অধিগ্রহণকৃত সম্পত্তির ক্ষতি পূরণের মূল্য কীভাবে আরোপিত হবে সেই বিষয়ে স্থাবর সম্পত্তি অধিগ্রহণ ও হুকুম দখল আইন, ২০১৭ তে বলে দেওয়া আছে। নোটিশ জারির সময় সংশ্লিষ্ট সম্পত্তির বাজার মূল্য নির্ধারণের সময় উক্ত স্থাবর সম্পত্তির পারিপার্শ্বিক এলাকার সমশ্রেণির এবং সমান সুবিধাযুক্ত স্থাবর সম্পত্তির নোটিশ জারির পূর্বের ১২ (বার) মাসের গড় মূল্য হিসাব করা হয়, আর সেই হিসাবের উপর ভিত্তি করে ক্ষতিপূরণ কত পাবে নির্ধারিত হয়ে থাকে। তবে যে বিষয়গুলো সরকার পক্ষ থেকে বিবেচনা করা হয় সেগুলো নিম্নরূপ:
ঘরবাড়ী/অবকাঠামোর মূল্য নির্ধারণ :-
ঘরবাড়ী/অবকাঠামোর বাজার দর নির্ধারণের ক্ষেত্রে গণপূর্ত বিভাগ এলজিইডি কর্তৃক নির্ধারিত রেট সিডিউল অনুসরণ করা হয়। ঘরবাড়ী নির্মাণের সময় ও অবস্থার উপর ভিত্তি করে বর্তমান নির্মাণ খরচের উপর অবকাঠামো বয়স অনুসারে ১-৫ বছর ১%, ৫- ১০ বছর ২%-৩%, ১০- ১৫ বছর ৩%- ৫% ততোর্ধ ১০% কমে মূল্য নির্ধারণ করা হয়।
পুকুরের মূল্য নির্ধারণ :
পুকুর সংলগ্ন বা নিকটবর্তী নাল (বিলান) জমির মূল্যহারে পুকুরের জমির মূল্য নির্ধারণ হবে। তবে পুকুর সংলগ্ন নাল জমি না থাকলে- পুকুরের পাড়ের মূল্য “চালা” শ্রেণীর জমির মূল্য হারে মূল্য নির্ধারণ হবে।
গাছপালার মূল্য নির্ধারণ :
বন বিভাগ থেকে গাছপালার মূল্য হার সংগ্রহ করে ক্ষতিগ্রস্থ গাছপালার মূল্য নির্ধারণ করতে হবে। তবে পেপে, কলাগাছ ইত্যাদি অজ্বালানী গাছের মূল্য প্রদান করতে হবে না।
দন্ডায়মান ফসলের মূল্য নির্ধারণ :
মোট যে উৎপাদন হতে পারে তার মূল্য হার নির্ধারণ করে দন্ডায়মান ফসলের ক্ষতিপূরণ হিসাব প্রস্তুত করতে হবে। ফসলের একর প্রতি উৎপাদন হার সংশ্লিষ্ট কৃষি বিভাগ থেকে এবং মূল্য হার সংশ্লিষ্ট জেলা বাজার পরিদর্শকের নিকট থেকে সংগ্রহ করে মোট মূল্য নির্ধারণ করতে হবে। জমির বর্গাদার থাকলে নিয়মানুসারে তার জন্য ভিন্নভাবে ক্ষতিপূরণের রোয়েদাদ তৈরী করতে হবে।
ব্যবসায়িক ক্ষতিপূরণ :
যদি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানটি আয়কর প্রদানকারী হয় তবে বার্ষিক আয়ের ১/৪ অংশ; আয়কর প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান না হলে বার্ষিক আয়ের ১/৪ অংশ অথবা ঐ বছরের যে পরিমান আয়ের জন্য আয়কর প্রদানযোগ্য নয় তার ১/৪ অংশ এই দুইয়ের মধ্যে যে হিসাব কম হবে সেই পরিমান অর্থ ক্ষতিপূরণ হিসাবে প্রদান করা হবে।
ঘরবাড়ী স্থানান্তর ব্যয় :
কোন ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি ঘরবাড়ীর ক্ষতিপূরণ না নিয়ে স্থানান্তরযোগ্য ঘরবাড়ী স্থানান্তর করলে গণপূর্ত বিভাগের সাথে পরামর্শ পূর্বক যুক্তিসঙ্গত স্থানান্তর ব্যয় নির্ধারণ করতে হবে।
উল্লিখিত সকল ক্ষেত্রে নির্ধারিত মূল্যের উপর ৫০% অতিরিক্ত যোগ করে ক্ষতিগ্রস্ত মালিকদের জন্য প্রদেয় ক্ষতিপূরণ নির্ধারণ করতে হবে।
ক্ষতিপূরণের টাকা কীভাবে আদায় করতে হয়
ক্ষতিপূরণ আদায় করার সময় আমাদের নানাধরনের সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। ভূমি অধিগ্রহণের পূর্বে যেমন একটি নোটিশ যায় তেমনি জমি অধিগ্রহণের পরে ক্ষতিপূরণের টাকার নোটিশ যায় ডিসি অফিসের রেকর্ড বই অনুযায়ী। যখন ৭ ধারায় নোটিশ জারি করা হয় তখন ভূমির মালিক জেলা প্রশাসক তখন জমির মালিককে তার জমি সংক্রান্ত সকল কগজপত্রাদি নিয়ে হাজির হতে হয়।
ক্ষতিপূরণ আদায়ের জন্য যেসব প্রমাণাদি বা কাগজপত্র প্রয়োজন হয়;
১। স্থানীয় চেয়ারম্যান কর্তৃক সত্যায়িত ছবি
২। নাগরিকত্ব সনদ,
৩। খতিয়ান মূল/সার্টিফাইড কপি,
৪। হাল সনের খাজনা দাখিল,
৫। ওয়ারিশ সনদপত্র,
৬। রোয়েদাদনামা, ক্ষমতাপত্র (না-দাবিপত্র),
৭। বণ্টননামা, হস্তান্তরিত সকল দলিল
৮। ধারা ৭ এর নোটিশে উল্লেখিত ক্ষতিপূরণের প্রমাণাদি।
উপরে উল্লিখিত যাবতীয় কাগজপত্রাদি সহ ফাইল প্রস্তুত করে ক্ষতিপূরণ পাওয়ার জন্য ভূমি অধিগ্রহণ শাখার এলএ সেকশনে জমা দিতে হয় এবং প্রয়োজনীয় কাগজপত্রের সাথে ক্ষতিপূরণ আদায়ের একটি আবেদন ফর্ম পূরণ করে জমা দিতে হবে। ফাইলটি জমা হওয়ার পর সেখানকার রেজিস্টার বইতে ক্ষতিপূরণ গ্রহণকারীর নাম, খতিয়ান নম্বর, ৮ ধারা নোটিশের রোয়েদাদ এবং জমির পরিমাণ লিখে একটি নম্বর পড়ে, এই সিরিয়াল নম্বর অনুযায়ী পরবর্তী কার্যক্রম পরিচালিত হয়। ধারা-৮ (২) বাধ্যতামূলক অধিগ্রহণ প্রকৃতি বিবেচনা করে জেলা প্রশাসক (১) উপধারায় বর্ণিত বাজার দরের উপর অতিরিক্ত শতকরা ৫০% ক্ষতিপূরণ দিবেন।
উপরোক্ত ক্ষতি পূরণ টাকা নির্ধারণের পরে ক্ষতি পূরণের টাকা মূলত প্রাপকের খাতে প্রদেয় এলএ চেকের মাধ্যমে বিতরণ করতে হয়।
যখন ক্ষতিপূরণ গ্রহিতা সনাক্ত সম্ভবনা হয় ভূমি অধিগ্রহণ কৃত সম্পত্তির ক্ষতিপূরণের টাকা নেওয়ার মূল মালিক পাওয়া না যায় বা যদি জমির মালিকানা বা অংশের বিষয়ে সমস্যার সৃষ্টি হয় বা আদালতে কোন মামলা থেকে থাকে তবে সেই ক্ষেত্রে ক্ষতিপূরণের টাকা বা অর্থ প্রজাতন্ত্রের সরকারি হিসাব ভুক্ত জমা হিসাব খাতে (Deposit account of the public account of the Republic)গচ্ছিত রাখতে হবে। তবে জমি সংক্রান্ত সমস্যা সমাধানের পরে এই টাকা যে যার মালিকানায় রয়েছে তার কাছেই প্রদান করা হবে এবং জমিসংক্রান্ত যে মামলা রয়েছে অত্র মামলাটি নিষ্পত্তি হবার পরে আদালত যার পক্ষে মামলাটির রায় দিবে সেই ব্যক্তি ক্ষতিপূরণ পাওয়ার দাবিদার।
ক্ষতিপূরণের টাকা অন্য কেউ যদি নিয়ে থাকে অনেকসময় দেখা যায় যে ভূমি কর্মকর্তা এক বা একাধিক মালিককে NOTICE করে থাকে যেমন যিনি খতিয়ানে মালিক তাকেও NOTICE দিচ্ছেন আবার যিনি ক্রয়সূত্রে জমির মালিক তাকেও NOTICE দিচ্ছেন সমস্যা মূলত তখনি দেখা দেয়। অনেক সময় দেখা যায় খতিয়ানের মালিক বিক্রয়ের বিষয়টি না জানিয়ে ক্ষতিপূরণের অর্থ নিয়ে যায় বা কোন ভাবে তাকে বেশী অর্থ দেওয়া হয় তখন এই অর্থ সরকারি দাবি Public Demand হিসাবে সরকারি দাবি আদায় আইন The Public Demand Recovery Act 1913 অনুযায়ি আদায় করা সম্ভব।
উন্নয়নের ধারা এবং সকল গৃহীত উন্নয়ন কর্মকাণ্ড অব্যাহত রাখতে হলে ভূমি অধিগ্রহণের প্রয়োজন হয় বা প্রয়োজনীয়তা দেখা দিবে, দিচ্ছে বা ভবিষ্যতেও দিবে। আর এর ফলে অনেকে ভূমিহীন হয়ে পড়বে,অনেক সময় দেখা যায় এমনও অনেকে আছেন যার শেষ সম্বল ওইটুকু জমি অধিগ্রহণকৃত সম্পত্তি । তাই নতুন করে সংশোধিত আইন অনুযায়ী ক্ষতি পূরণ বাড়িয়ে ৩ গুণ ৪ গুন করার সিদ্ধান্ত। ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য ফলপ্রসূ হয়েছে কিন্তু এই ক্ষতিপূরণ পাওয়া যে কতটা কঠিন তা যিনি তুলতে গিয়েছেন তিনি ভালো জানেন।তাই অধিগ্রহণের ক্ষতিপূরণ পাওয়া সহজসাধ্য করতে হবে এবং যথাযথ ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা নিশ্চিত করে ভূমি মালিকদের হয়রানি রোধ করা অতীব জরুরী ।পাশাপাশি ভূমি মালিক তথা ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসন সঠিক হচ্ছে কি না তা আইনের মাধ্যমে সুনিশ্চিত করা আবশ্যক। প্রত্যকে জমির মালিকদের উচিত তার জমির সকল কাগজপত্র সংগ্রহে রাখা আর যদি তা বর্তমান খতিয়ান অনুযায়ী (MUTATION) বা নামজারি করা না থাকলে তা করে খাজনাদি পরিশোধ করে রাখা।
লেখক- অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট ও সহযোগী সম্পাদক, ল’ ইয়ার্স ক্লাব বাংলাদেশ ডটকম।