রীনা পারভিন মিমি :
প্রথমেই জানা যাক মানহানি কি?
প্রতিটি মানুষ চায় মানসম্মান, ইজ্জত নিয়ে পৃথিবীতে বেঁচে থাকতে, কেউ চাননা তার মানসম্মান কেউ ক্ষুন্ন করুক বা কোনভাবে তা ক্ষুন্ন হোক। মানসম্মান, আত্মমর্যাদা নিয়ে বেঁচে থাকা তার অধিকার, আর এই অধিকার রক্ষা করা একটি রাষ্ট্রের দায়িত্ব।
মানহানি ইংরেজেতে যাকে বলা হয়, Defamation, libel, loss of honor or respectability, insult বাংলায় যার অর্থ অবমাননা বা মর্যাদাহানি। কলঙ্ক দেওয়া, কুৎসা রটানো, লজ্জাকর অনুভূতি, মর্ম পীড়াদায়ক অনুভূতি, মিথ্যা অপবাদ দেওয়াকেই মানহানি বলা যেতে পারে। একজন ব্যক্তির সম্মানের প্রতি অসম্মান করা হলে বা সম্মান বিষয়ে হানিকর কিছু বলা হলে সেটিকে সাধারণ অর্থে মানহানি বলা হয়; তবে আইনের ভাষায় মানহানির সংজ্ঞা ভিন্ন। দন্ডবিধির ৪৯৯ ধারা যে ব্যক্তি অন্য ব্যক্তির খ্যাতি বা সুনাম নষ্ট করার উদ্দেশ্যে বা এমন হবে জেনেও উদ্দেশ্য মূলক শব্দাবলি বা চিহ্নাদি বা দৃশ্যমান প্রতীকের সাহায্যে কোনো ব্যক্তি সম্পর্কে এমন ভাবে কোনো নিন্দা প্রণয়ন বা প্রকাশ করে, তা হলে ওই ব্যক্তির মানহানি করেছে বলে ধরা হবে। এমনকি মৃত ব্যক্তি সম্পর্কে বললেও তা মানহানি হবে। আইনে এমন কিছু ব্যতিক্রম অবস্থা বর্ণনা করা হয়েছে, যখন কোনো ব্যক্তি অন্য ব্যক্তির নামে মানহানিকর কিছু বললে, লিখলে বা প্রচার করলেও মানহানি হবে না।
মানহানি মামলার উপাদান :
১।অভিযোগ অর্থাৎ বক্তব্যটি অবশ্যই মানহানিকর হতে হবে।
২।বক্তব্যটির দ্বারা কোন ব্যক্তির সামাজিক মর্যাদার ব্যঘাত ঘটবে।
৩।বক্তব্যটি বিদ্বেষমূলক হতে হবে।
কে মানহানির মামলা করতে পারবেন?
সাধারণত মানহানিকর উক্তি দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি মানহানির মামলা দায়ের করতে পারে। তবে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৯৮ ধারা অনুসারে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি ছাড়াও নিমোক্ত ব্যক্তিগন এই মামলা করতে পারবে। মানহানির মামলা ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি ছাড়া মামলা করলে আদালত তা আমলে নিবেন না। তবে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি মহিলা হলে সেক্ষেত্রে নিন্মের শর্তসাপেক্ষে আদালতের অনুমতি নিয়ে অন্যকেউ মামলা করতে পারেন যদি-
(ক) উক্ত মহিলা দেশের রীতিনীতিও প্রথানুসারে জনসমক্ষে হাজির হতে বাধ্য করা উচিত হবে না।
(খ) উক্ত মহিলার বয়স ১৮ বছরের নীচে বা উন্মাদ বা আহাম্মক বা পীড়া বা অক্ষমতার কারণে নালিশ করতে অসমর্থ।
তবে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তির সংজ্ঞা তা নির্ভর করে পারিপার্শ্বিক অবস্থার উপর। যেমন স্ত্রীর ক্ষেত্রে স্বামী চাইলে মামলা করতে পারেন। উক্ত ধারা অনুযায়ী, কুৎসাজনক অপবাদগ্রস্থ কন্যা তার পিতামাতার সাথে বসবাস করলে উক্ত পিতামাতা ১৯৮ ধারা অনুযায়ী ক্ষতিগ্রস্থ ব্যক্তি হিসাবে বিবেচিত হবেন এবং কন্যার জন্য পিতা বা মাতা মামলা করতে পারেন। কারণ কন্যার অপমানে পিতা বা মাতা ক্ষুদ্ধ।
দেওয়ানী আইন অনুযায়ী প্রতিকার :
কোন ব্যক্তি যদি মনে করেন যে তার মানহানিকর কোন কাজ কারও দ্বারা হয়েছে তবে তিনি মানহানির জন্য দেওয়ানী আদালতে ক্ষতিপূরণ চেয়ে মামলা করতে পারেন। যদিও মানহানি হলে তা ক্ষতিপূরণ পাওয়ার মাধ্যমে সন্তুষ্ট থাকা সম্ভব নয়। তবে অত্র মামলা করতে হলে যে পরিমান ক্ষতিপূরণ চাওয়া হবে তার মূল্যের উপর হিসেবে দাবিকৃত অর্থের ওপর প্রদান করে সেই মামলা দায়ের করতে হবে এবং কতটা কাতিনি চাইবেন তা সম্পূর্ণভাবে নির্ভর করবে বাদীর সামাজিক মানমর্যাদার উপর। এখন কথা হল Court Fee এর পরিমাণ কেমন হবে তা নির্ভর করবে ক্ষতিপূরণ হিসেবে দাবিকৃত অর্থের ওপর। যেমন কেউ যদি ৫ কোটি টাকা দাবী করে তবে তার Court Fee হবে প্রায় অর্ধ লক্ষ টাকা। কোর্ট ফি এক ধরনের প্রত্যক্ষ কর। আর এইটা মামলা দায়ের করার সময় আরজির সাথে জমা দিয়ে মামলা ফাইল করতে হবে। দেওয়ানী আদালতে মামলা করার পর বাদিপক্ষ মানহানি হয়েছে তা প্রমাণ করতে পারলে বিবাদীপক্ষ থেকে ক্ষতিপূরণ হিসেবে অর্থ আদায় করতে পারেন।
মানহানির অভিযোগে ফৌজদারি প্রতিকার :
একজন ব্যক্তির মানসম্মানের মূল্য অর্থ দ্বারা পরিমাপ করা না গেলেও মানহানিকর উক্তি দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি বিভিন্ন অঙ্কের ক্ষতিপূরণ দাবি করে ফৌজদারি মামলা রুজু করে থাকেন। ক্ষতি পূরণের বিষয়টি দেওয়ানি প্রতিকার বিধায় ফৌজদারি মামলায় ক্ষতিপূরণ চাওয়ার কোনো সুযোগ নেই।
কেউ যদি কারো বিরুদ্ধে মানহানিকর বক্তব্য প্রকাশ করে তখন যে ব্যক্তির বিরুদ্ধে প্রকাশ করেছে সে ফৌজদারি আদালতে নালিশি মামলা হিসেবে অভিযোগ দায়ের করতে পারবে। অত্র মানহানির মামলাটি করতে হবে আদালতে অভিযোগ দায়ের করে জবানবন্দি প্রদানের মাধ্যমে। ২০১১ সালের ১ নম্বর আইনে ফৌজদারি কার্যবিধির ২ নম্বর তফসিলের ৪ নম্বর কলামে যে পরিবর্তন আনা হয় তাতে মানহানির অভিযোগের ক্ষেত্রে ওয়ারেন্টের পরিবর্তে সমন পদ্ধতি প্রবর্তন করা হয়। আদালত সমন জারি করবেন অভিযুক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে। মানহানি মামলায় সরাসরি গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয় না তবে,সমন দিলে আদালতে হাজির না হলে, সে ক্ষেত্রে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়।
ফৌজদারি কার্যবিধির ২০০ এর অভিযুক্ত ব্যক্তি যদি দোষী হয় তবে বা পেনাল কোড এর দণ্ডবিধির ৫০০ ধারায় মানহানির শাস্তি হিসাবে দোষী সাব্যস্ত হলে দুই বছর বিনাশ্রম কারাদণ্ড বা অর্থদণ্ড বা উভয়বিধ দণ্ড হতে পারে। তবে দণ্ডবিধির অধীন সংঘটিত মানহানির ক্ষেত্রে ফৌজদারী কার্যবিধির ৩২ ধারা অনুযায়ী ম্যাজিস্ট্রেটের প্রকার ভেদে অর্থদণ্ডের ক্ষমতা সর্বোচ্চ ১০ হাজার, ৫ হাজার ও ২ হাজার টাকা হওয়ার কারণে কোন ম্যাজিস্ট্রেট নির্ধারিত অর্থদণ্ডের অতিরিক্ত অর্থদণ্ড আরোপ করতে পারেনা।
কোন ব্যক্তির বিরুদ্ধে মানহানির মামলা দায়ের করার আগে প্রয়োজনীয় কিছু অপরিহার্য বিষয়গুলি জানা গুরুত্বপূর্ণ। মন্তব্য বা মন্তব্য করা সত্য, অপ্রকাশিত এবং যোগ্যতা সম্পন্ন হয় তবে মানহানির মামলা দায়ের করা যাবে না। অত্র মামলা দায়ের করার আগে এই বিষয়ে আপনার অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার জন্য এবং অন্যান্য সম্পর্কিত আইনগুলো সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা নেওয়ার জন্য একজন আইনজীবীর মতামত গ্রহণ করা যুক্তিযুক্ত। যে কোনও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নাগরিকদের সম্মান ও সুনাম অটুট রাখা জরুরি।
লেখক- অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট এবং সহযোগী সম্পাদক, ল’ইয়ার্স ক্লাব বাংলাদেশ ডটকম।