এমি জান্নাত:
নারীর এগিয়ে চলার উদ্যম সময়ের সাথে সাথে বেড়ে চলেছে। যেহেতু দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক নারী, তাই সমাজ ও রাষ্ট্রের উন্নয়নের স্বার্থে প্রতিটি ক্ষেত্রে তাদের অংশগ্রহণ সমানভাবে আবশ্যক। শিক্ষা, মেধা ও মননে তারা এগিয়ে গিয়েছে বহুদূর। আজ দেশে নারী উদ্যোক্তা, ব্যবসায়ীরাও এগিয়ে চলেছে একইভাবে। নিজেদের প্রমাণ করতে আজ তারা নিজেই নিজের প্রতিযোগী। কারণ প্রতিটি দিন তারা নতুন করে ভিন্নরুপে প্রকাশ করছে নিজেকে। ঘর সামলে তাই বাইরে বেরোতে হচ্ছে কর্মক্ষেত্রে তাদের নিজের অবস্থানকে আরও দৃঢ় করতে। কিন্তু প্রতিনিয়ত নারীকে ঘরে-বাইরে, কর্মক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের প্রতিবন্ধকতার শিকার হতে হচ্ছে। রাস্তা, শপিংমল, গণপরিবহন থেকে শুরু করে নগরে যেমন নারীর একা চলাচলে নিরাপত্তার অভাব, তেমনি কর্মক্ষেত্রে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানেও নারীরা নানা রকম হয়রানির শিকার হচ্ছে। তাই ভালো শিক্ষাগত যোগ্যতা থাকার পরও কর্মক্ষেত্রে নিজেকে উপস্থাপন করার আগেই এখনো নিজেকে গুটিয়ে নেয় অনেকেই শুধুমাত্র নিরাপত্তার কথা ভেবে। কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর বেশির ভাগেই নারী নিরাপদ নয়। অনিরাপদ বলতে শুধুমাত্র যৌন হয়রানিকেই আমরা অভিহিত করতে পারি না, বরং যৌন হয়রানিমূলক ইঙ্গিত, ইভটিজিং, অশালীন মন্তব্য এসব কিছুই নারীর জন্য অনিরাপত্তা নিশ্চিত করে। এরকম নানা বিভ্রান্তির শিকার হওয়ার ভয়ে অনেকেই নিজেকে কর্মক্ষেত্র থেকে দূরে রাখেন আর কেউ কেউ এসবের শিকার হয়েও চক্ষুলজ্জা, সমাজের অপ্রত্যাশিত দৃষ্টিভঙ্গি অথবা আয়ের উৎস হারানোর আশংকায় চুপ করে যায়।
কিন্তু এসব অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি তো নিত্য ঘটনা হতে পারে না। নারীর নিরাপত্তায় কঠোর আইন রয়েছে। বাস্তবায়নটুকুই সন্দিহান।
সংবিধানের ২৯ (১) অনুচ্ছেদে আছে, “প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ বা পদ লাভের ক্ষেত্রে সকল নাগরিকের জন্য সমান সুযোগের সমতা থাকবে।”
সংবিধানের ২৯ (৩) অনুচ্ছেদে আছে, “কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ নারীপুরুষ ভেদ বা জন্মস্থানের কারণে কোন নাগরিক প্রজাতন্ত্রের কর্মের নিয়োগ বা পদলাভের অযোগ্য হইবেন না কিংবা সেই ক্ষেত্রে তাহার প্রতি বৈষম্য প্রদর্শন করা যাইবে না।”
১৯৯৫ সালে নারী ও শিশু নির্যাতন আইন পাস করা হয়। এ আইন পাসের পর নারী নির্যাতন কিছুটা বন্ধ হয়। পরে আইনটি বাতিলক্রমে ২০০০ সালে নতুন করে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন প্রণয়ন করা হয়। আইনটিকে আরো শক্তিশালী করতে ২০০৩ সালে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন (সংশোধন) আইন প্রণয়ন করা হয়।
অর্থাৎ সংবিধানের ও আইনের প্রতি সম্পুর্ণ বিশ্বস্ত থাকলে কোনও ক্ষেত্রে নারীর প্রতি কোনও রকম অবমাননাকর আচরণ, বৈষম্য বা বৈষম্যমূলক কোনও আচরণ করার সুযোগ নেই। এমনকি, নারী উন্নয়নের স্বার্থে বিশেষ বিবেচনায় কোনও উদ্যোগ নিলেও তা সংবিধান সমর্থন করে, কিন্তু এসব আইন থাকা সত্ত্বেও এখনো অনেক নারী বিভিন্নভাবে লাঞ্চিত ও নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন।
নারী অধিকার মানবাধিকার থেকে আলাদা কোনো বিষয় নয়। মানবাধিকারের প্রতিটি বিষয়েই নারী অধিকার ও নিরাপত্তাকে জোর দেওয়া হয়। সেই সাথে নারীদের জন্য আছে রয়েছে কিছু অধিকার যা একান্তভাবে নারীকে তার নিজস্ব মর্যাদা ও আত্মসম্মান নিয়ে বাঁচতে শেখায়। নারী অধিকার এমন একটি বিষয় যা সব বয়সের নারীর জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য। কিছু বিশেষায়িত অধিকার অন্তর্ভুক্ত রয়েছে তাতে। বিশেষায়িত অধিকারগুলো আইন, কিছু আঞ্চলিক সংস্কৃতি, শিক্ষা বা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, জাতি, বর্ণ ও রাষ্ট্রভেদে ভিন্ন হতে পারে। আবার কিছু ক্ষেত্রে এ অধিকারগুলো সামাজিক কর্মকান্ড, মূল্যবোধ ও রীতি দ্বারা সিদ্ধ হতে পারে। তবে, যেভাবেই আমরা দেখে থাকি না কেন, নারীর এই অধিকারগুলো তাকে তার নিজ সত্ত্বায় প্রস্ফুটিত করে তোলে, আত্মবিশ্বাসী করে তোলে।
কিন্তু সমাজের কিছু নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে নারী তার প্রাপ্য অধিকার ও সম্মান থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। সংবিধান এবং আইনে থাকলেও নারীর প্রতি বৈষম্য বিরাজ করছে সমাজের সর্বক্ষেত্রেই।
তাই শুধু আইনের অপেক্ষা নয়, আইনকে সামনে রেখে নিজেকেই নিজের হাতিয়ার করতে হবে। কোন অবমাননাকেই চুপ করে মেনে নেওয়াটা কোনো সমাধান নয়, বরং প্রতিহত করাটা গর্বের। যেকোনো কিছু শুরু না করলে শেষ হওয়ার তো অবকাশই নেই! একজন প্রতিবাদ করলে বাকি দশজনের জন্য সেটা অনুপ্রেরণা। অপ্রত্যাশিত কিছু ঘটলে প্রথমে নিজে ব্যক্তিগতভাবে প্রতিহত করতে হবে এবং প্রয়োজনে সকল বিশ্বস্ত সহকর্মীর সাথে আলোচনা করতে হবে অথবা আস্থাশীল ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে বলতে হবে। তাতে নারীর প্রতি যারা সহিংস মনোভাব পোষণ করে তারা হয়তো নিজেকে শোধরাবে নয়তো নিজের স্বরূপ প্রকাশ থেকে বিরত থাকবে। কারণ সবাই বিকৃত মস্তিষ্কের হয় না। তারা প্রশ্রয় পায় শুধু প্রতিবাদ না করে সহ্য করে গেলে।
এসব অপ্রত্যাশিত ঘটনাকে ঘিরে সবার ইতিবাচক ভাবনাগুলোর সমন্বয় সাধন এবং সর্বসাধারণের মধ্যে সচেতনতা জাগ্রত হওয়াটাই সব প্রতিবন্ধকতা কাটানোর প্রধান ধাপ।
লেখক: এমি জান্নাত, সাংবাদিক ও লেখক।