রীনা পারভিন মিমি:
মানুষ মরণশীল। আজ হোক কাল হোক একদিন না একদিন মৃত্যু হবে। আর বর্তমানে করোনার এই সময়ে অনিয়ন্ত্রিতহারে মৃত্যু ঘটে চলেছে আমাদের দেশে। আমরা কেউ বলতে পারবো না কখন আমাদের দ্বারে মৃত এসে হানা দিবে? আর হঠাৎ মৃত্যুর কারণে আমরা অনেক সময় পরিবারের জন্য যা গুছিয়ে রেখে যেতে চাই তা গুছিয়ে রেখে যেতে পারি না। ‘মৃত্যু নিশ্চিত’ আমরা অস্বীকার করতে না পারলেও বিশ্বাস করি না। তাই যেকোনো সময় মৃত্যুর জন্য আমরা কেউই প্রস্তুত নই। ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলার সময়ও অনেকেই ভেবে থাকেন ব্যাংকের নিয়মের জন্য নমিনি দেওয়া হয়েছে কিন্তু টাকাগুলো আমিই উত্তোলন করবো। তাই নমিনি করার ব্যাপারে সচেতনেতাও দেখা যায় না। আবার অনেকের অ্যাকাউন্টে বেশী টাকা থাকে না তাই ভেবে থাকেন যেকোন একজন নমিনি হলেই হল কিন্তু মানুষের ভাগ্যে কখন কি হয় আল্লাহ্ ভাল জানেন। এখন কথা হল মৃত ব্যাক্তির ব্যাংকে রেখে যাওয়া টাকা কে পাবে, নমিনি পাবে না উত্তরাধিকারী পাবে।
যে আইন অনুযায়ী অর্থ পাবে:
এই সংক্রান্ত বিভিন্ন আইনে বিভিন্ন ব্যাখ্যা রয়েছে। সাধারণত মৃত ব্যক্তি জীবিত থাকাবস্থায় তার সংশ্লিষ্ট একাউন্টের কোন নমিনি নির্ধারণ করে থাকলে তার মৃত্যুর পর বর্তমান প্রচলিত আইন অনুযায়ী উক্ত নমিনিই পাবে। আর যদি নমিনি উল্লেখ না থাকে তাহলে মৃত ব্যক্তির ওয়ারিশগণ উত্তরাধিকার আইন অনুযায়ী পাবেন। সেক্ষেত্রে আদালত হতে রেখে যাওয়া আমানত বা অর্থের বিষয়ে সাকসেশন সার্টিফিকেট সংগ্রহ করতে হবে। যে আইন অনুযায়ী উত্তরাধিকারীই মৃত ব্যক্তির ব্যাংকে রেখে যাওয়া অর্থ পাবে- মৃত ব্যাক্তির ব্যংকে রেখে যাওয়া টাকা বা সম্পত্তির মালিক তার উত্তরাধিকারীরা হবে বা হওয়া উচিৎ। আর এই সম্পদ বা টাকা বন্টিত হবে The Muslim Personal Law (Shariat) Application Act, 1937 অনুযায়ী। শরিয়াত অ্যাপ্লিকেশান এ্যাক্ট ১৯৩৭ এর ধারা ২ এ বলা হয়েছে, বাংলাদেশে মুসলমানদের জন্য উত্তরাধিকার বন্টনের ক্ষেত্রে মুসলিম শরিয়া আইন প্রযোজ্য হবে।The Succession Act, 1925 এ বলা হয়েছে যে মৃত ব্যক্তির টাকা বন্টন করতে হবে তার ওয়ারিশদের মধ্যে। নমিনি যদি মৃত ব্যক্তির উত্তরাধিকারী না হন তবে কোন অবস্থায় তিনি সম্পত্তির দাবিদার হতে পারবেন না। সাকসেসন আইন অনুযায়ী নমিনি যদি কোন টাকা পাওয়ার অধিকারী হন তবে তিনি তা পাবেন। নমিনি হয়েছেন বলে টাকা পাবেন বা বিশেষ কোন সুবিধা বা টাকা বেশী পাবেন এমন নয়।
সুপ্রিম কোর্টের রায়:
সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের রায়- আমরা যারা নমিনির অধিকার সম্পর্কে অবগত আছি তারা একান্ত আপনজনকেই নমিনি করে রাখি। কিন্তু যারা এই সম্পর্কে অবগত নয় তারা দেখা যায় অন্য কাউকে নমিনি করে রেখে যান। আবার অনেকেই নমিনির ভূমিকা সম্পর্কে পুরোপুরি না বুঝেই যাকে-তাকে নমিনি করেন। মাঝেমধ্যে দেখা যায়, ব্যবসার প্রয়োজনে ভিন্ন জেলায় বসবাসরত অনেকেই নিজের রুমমেট বা পরিচিত কাউকে নমিনি হিসেবে দেন। বিয়ের আগে অনেকেই বাবা বা মায়ের নামে করেন, ভাই বা বোনের নামে করেন। দেখা যায় অনেক সময় বিয়ের পরে সেই নমিনি পরিবর্তন করেন না।
আবার অনেকের একাধিক স্ত্রী থাকে সে ক্ষেত্রে একজনকে নমিনি করে রেখে গিয়েছেন ঝামেলা তখনি শুরু হয়। তেমন এক ঘটনা নিয়ে মামলা হয়েছিল। অত্র মামলায় সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ মৃত ব্যক্তির ব্যাংকে রেখে যাওয়া টাকা উত্তরাধিকারের ভিত্তিতে বণ্টনের নির্দেশ দেন। রায়ে বলা হয়, আমানতের অর্থ নমিনি নয়, আইনসঙ্গত উত্তরাধিকারীরা পাবেন। নমিনি সংশ্লিষ্ট ব্যাংক হিসাবের হেফাজতকারী মাত্র।
এরপর নমিনি হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে আবেদন করেন। হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে করা লিভ টু আপিল গ্রহণ করা হয়েছে। সেটি এখন আপিল বিভাগ স্থগিত রেখেছেন পরবর্তীতে শুনানি হবে। তাই এখনও ব্যাংক কোম্পানি আইন ১৯৯১ এর ১০৩ ধারা অনুসারে নমিনিই গচ্ছিত অর্থ পাচ্ছেন।
কোম্পানি আইনে নমিনির ব্যাখ্যায় যা বলা আছে:
আগে ব্যাংক কোম্পানি আইন ১৯৯১ অনুযায়ী নমিনি মৃত ব্যক্তির টাকা পেত বা ব্যাংক প্রদান করত কিন্তু হাইকোর্ট এর অত্র রায়ের ফলে অনেক জটিল হয়ে যায় এই টাকা উত্তলন এবং মালিকানা নিয়ে। ব্যাংক কোম্পানি আইন ১৯৯১ (২০১৩ পর্যন্ত সংশোধিত) ১০৩ ধারায় আমানতী অর্থ পরিশোধের জন্য মনোনয়ন দান বিষয়ে বলা হয়েছে, ব্যাংক-কোম্পানির নিকট রক্ষিত কোন আমানত যদি একক ব্যক্তি বা যৌথভাবে একাধিক ব্যক্তির নামে জমা থাকে, তাহলে উক্ত একক আমানতকারী এককভাবে বা যৌথ আমানতকারীগণ যৌথভাবে এমন একজন বা একাধিক ব্যক্তিকে মনোনীত করতে পারবেন যাকে বা যাদেরকে, একক আমানতকারী বা যৌথ আমানতকারীগণের সকলের মৃত্যুর পর, আমানতের টাকা প্রদান করা যেতে পারে। এই আইন অনুযায়ী এটা সুস্পষ্ট বোঝা যায় যে একমাত্র নমিনি মৃত ব্যক্তির রেখে যাওয়া টাকার মালিক এবং ব্যাংক নমিনির কাছে টাকা দিবেন।
প্রশ্ন হল, বর্তমানে কোন আইন কার্যকর তাহলে:
Zia Uddin Vs. Arab Bangladesh Bank Ltd., 6 MLR (AD) P.188 এবং 52 DLR (HC), P. 36-এ উল্লেখ আছে, মৃত ব্যক্তির টাকা নমিনিই পাবে। প্রশ্ন হল, বর্তমানে কোন আইন কার্যকর তাহলে? যখন প্রশ্ন আসে বা আইনের জটিলতা দেখা দেয় যে কোন আইনটি কার্যকর হবে বা কোন আইন বলবৎ থাকবে তখন এই জটিলতার সমাধান পাওয়া সম্ভব হয় General Clauses Act, 1897 আইনের মাধ্যমে। এই আইন অনুযায়ী, যে বিশেষ আইনটি সর্বশেষ পাশ হয়েছে সেই আইনটি কার্যকর হবে। তাহলে দেখা যাচ্ছে যে, The Muslim Personal Law (Shariat) Application Act, 1937 এবং ব্যাংক-কোম্পানী আইন দুটিই স্পেশাল আইন। কিন্তু ব্যাংক-কোম্পানী আইন ১৯৯১ হল সর্বশেষ আইন। আর সে কারনে এই আইনের কার্যকারিতা বহাল থাকবে। অন্য কোন আইনে যাহা কিছু থাকুক না কেন। তার মানে বর্তমানে মৃত্যুর পর নমিনিই মৃত ব্যাক্তির গচ্ছিত অর্থ পাবেন।
বাংলাদেশ ব্যাংক প্রজ্ঞাপনে যা বলছে:
বাংলাদেশ ব্যাংক, গত ০৬ আগস্ট, ২০১৭ ইং তারিখে Application of Interest on Deposit and Loan Accounts of Deceased Individuals বিষয়ে জারিকৃত বিসিডি সার্কুলার নং ১৮/১৯৮৪ এর পতিপালন প্রসঙ্গে বিআরপিডি সার্কুলার নং ১১ -এ দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে এই নির্দেশনা দিয়েছেন যে, ব্যাংকে টাকা রেখে কোনো গ্রাহকের মুত্যু হলে তার নমিনি ছাড়া অন্য কারও কাছে টাকা দেয়া যাবে না । সৃষ্ট জটিলতার প্রেক্ষিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিপত্রে স্পষ্ট জানিয়ে দেওয়া হয়, কোনো ব্যক্তি মারা গেলে ব্যাংকে রেখে যাওয়া টাকা তার নমিনি (মনোনীত ব্যক্তি) পাবেন।
যদি নমিনি নাবালক হয়?
অনেক সময় দেখা যায় যে, পিতা বা মাতা তার নাবালক সন্তানকে নমিনি করেন সেক্ষেত্রে আমাদের মনে প্রশ্ন আসতে পারে নাবালক নমিনি কি ব্যাংকের টাকা উঠাতে পারবে? উত্তর হল অবশ্যই পারবে। তবে এই নাবালকের একজন অভিভাবক তার হয়ে টাকা উঠাবে কিন্তু এই অভিভাবক নিযুক্ত হতে হবে আদালতের মাধ্যামে। নমিনি নাবালক হলে সেক্ষেত্রে তার পক্ষে বিজ্ঞ আদালত হতে অভিভাবক নিযুক্ত হবেন। নিযুক্তিয় অভিভাবক নাবালকের পক্ষে ব্যাংক থেকে টাকা উত্তোলন ও খরচ করবেন। তবে আদালতে হিসাব দেবেন। নাবালক ১৮ বছরে সাবালক হয়। তবে আদালতে অভিভাবক নিযুক্তির ক্ষেত্রে তাকে ২১ বছর অপেক্ষা করতে হবে। তাই আমাদের সকলের উচিৎ যেকোন নমিনি করার আগে ভেবে চিন্তে বুঝে করা।
লেখক : আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট এবং সহযোগী সম্পাদক, ল’ইয়ার্স ক্লাব বাংলাদেশ ডটকম।