এক অপারেটরের নামে বরাদ্দ করা তরঙ্গ অন্য অপারেটরের কাছে বিক্রির অভিযোগে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) বিরুদ্ধে ১৯ হাজার কোটি টাকার মামলা হয়েছে। বেসরকারি ল্যান্ডফোন বা পাবলিক সুইচড টেলিফোন নেটওয়ার্ক (পিএসটিএন) অপারেটর ওয়ার্ল্ড টেল বাংলাদেশ লিমিটেডের নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ নাইম মেহতাব চৌধুরী ১৯ মার্চ যুক্তরাষ্ট্রের একটি আদালতে মামলাটি করেন। গণমাধ্যমের হাতে আসা নথিতে দেখা যায়, ২২ মার্চ নিউইয়র্কের জ্যাকসন হাইটস থেকে আমেরিকান শিপিং কোম্পানি ফেডএক্সের মাধ্যমে বিটিআরসির কাছে মামলার কাগজপত্র পাঠানো হয়েছে। ২৮ মার্চ কাগজপত্র গ্রহণ করে বিটিআরসি।
এ প্রসঙ্গে বিটিআরসির পরিচালক (লিগ্যাল) তারেক হাসান সিদ্দিকী বলেন, ‘এ ধরনের একটি মামলার কথা শুনেছি। কিন্তু এখনো অফিসিয়াল নোটিশ পাইনি। নোটিশ পাওয়ার পর আলোচনা সাপেক্ষে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। আগে বুঝতে হবে বাদীপক্ষ মামলাটি কেন যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে করেছে। কেনই বা তারা বাংলাদেশের আদালতে করেনি। বেনিফিট পেতে হলে তো মামলা বাংলাদেশের আদালতে করতে হবে।’
বিটিআরসির ভাইস চেয়ারম্যান সুভ্রত রায় মিত্র বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে মামলা হলে অবশ্যই বিটিআরসি সেটি মোকাবিলা করবে। বিটিআরসির লিগ্যাল বিভাগ যারা আছেন তারা এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেবেন।’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিটিআরসির একজন মহাপরিচালক গণমাধ্যমকে বলেন, বিষয়টি নিয়ে কমিশন সভায় আলোচনা হবে। সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মামলা মোকাবিলা করা হবে। ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, ওয়ার্ল্ড টেলের স্পেকট্রামের বিষয়ে বিটিআরসির পক্ষে দেশের শীর্ষ আদালতের রায় আছে। সেই রায় অনুযায়ী তরঙ্গ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। তাছাড়া বর্তমানে ওয়ার্ল্ড টেলের কোনো অপারেশন নেই। ভিওআইপিসহ নানা অভিযোগে তাদের অপারেশন বন্ধ করে দিয়েছে সরকার। নিয়ম অনুযায়ী কোনো প্রতিষ্ঠান তরঙ্গ বরাদ্দ নিয়ে তা যথাসময়ের মধ্যে ব্যবহার করতে না পারলে তা এমনিতেই বাতিল হয়ে যায়। ২০০১ সালে তরঙ্গ বরাদ্দ নিয়ে ওয়ার্ল্ড টেল গত ২০ বছরেও অপারেশনে যেতে পারেনি।
ওয়ার্ল্ড টেল বাংলাদেশের দাবি, বিটিআরসির কারণে বছরের পর বছর চেষ্টা করেও তারা অপারেশনে যেতে পারছে না। তরঙ্গ বরাদ্দ পেয়ে ২০০১ সালে তারা অপারেশন শুরু করে এবং ৪৫০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করে। দেশি-বিদেশি ১৮৩ জনবল নিয়োগ দেওয়া হয়। তৈরি করা হয় ৪৮টি টাওয়ার। বর্তমানে ৪২টি টাওয়ার চালু আছে। মহাখালীতে বিশাল সুইচ রুম তৈরি করা হয়। সেটি এখন চালু আছে বাড্ডায়। ২০১০ সালে লাইসেন্স নবায়ন করা হয়। ২০১১ সালে বিটিআরসি অবৈধ ভিওআইপির অভিযোগে তাদের অপারেশন বাতিল করে দেয়। সুইচ রুম বন্ধ করে দেয়। ২০১৪ সালে পুনরায় অপারেশন চালু করা হয়। ২০১৫ সালে আবারও বন্ধ করে দেওয়া হয়। সেই থেকে আর অপারেশনে যেতে পারেনি। বর্তমানে তাদের ৬ জন প্রকৌশলী কাজ করছেন। বিটিআরসি তাদের লাইসেন্স বাতিল করেনি, কিন্তু সব ধরনের অপারেশন বন্ধ রেখেছে। এ কারণে তাদের ৪৫০ কোটি টাকার বিনিয়োগ স্থবির হয়ে আছে।
ওয়ার্ল্ড টেলের নির্বাহী পরিচালক আল মাসুম আহম্মেদ বলেন, আমাদের সঙ্গে কোনো ধরনের আলোচনা ছাড়াই বিটিআরসি কিছুদিন আগে বরাদ্দ করা ১৮শ ব্র্যান্ডের ৭.৪ মেগাহার্জস তরঙ্গ একতরফাভাবে মোবাইল ফোন অপারেটরদের কাছে বিক্রি করে দেয়। এই পরিমাণ তরঙ্গের নিলামে দর উঠেছে সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা। এর সঙ্গে তাদের বিনিয়োগ এবং গত ২০ বছরের ব্যবসার সম্ভাব্য আয় যোগ করে ১৯ হাজার কোটি টাকার মামলা করেছি।
তিনি বলেন, এর আগে যেহেতু বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালতে মামলা করে হেরে গেছি সেহেতু মনে হয়েছে এই দেশে মামলা করে আর কোনো বেনিফিট পাব না। তাছাড়া আমাদের মাদার কোম্পানির দুই পরিচালক যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের নাগরিক। দুই দেশেই তাদের ব্যবসা রয়েছে। সে কারণে যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে মামলাটি হয়েছে।
তিনি বলেন, গত ১০ বছরে আমরা বিটিআরসিকে অসংখ্য চিঠি দিয়েছি। অপারেশন চালুর জন্য চিঠি দিয়েছি। লিগ্যাল নোটিশ দিয়েছি। কিন্তু বিটিআরসি কোনো চিঠির উত্তর দেয়নি।
জানা যায়, ওয়ার্ল্ড টেলের নামে বরাদ্দ করা তরঙ্গ বিটিআরসি ৮ মার্চ পুনরায় নিলামে তোলে। ওয়ার্ল্ড টেলের দাবি, এই নিলামটি সম্পূর্ণ অবৈধভাবে করা হয়েছে। নিলামের আগে ওয়ার্ল্ড টেলের পক্ষ থেকে বরাদ্দ করা তরঙ্গ অন্য কারও কাছে যাতে বিক্রি করা না হয় সেজন্য টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়, বিটিআরসি ও সংশ্লিষ্টদের লিগ্যাল নোটিশ দেওয়া হয়েছে। এরপরও বিটিআরসি বরাদ্দ করা তরঙ্গ নিলামে বিক্রি করে দেয়। বাধ্য হয়ে ওয়ার্ল্ড টেল বিটিআরসির বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রে ২৩৯ কোটি ডলার বা ১৯ হাজার কোটি টাকার ক্ষতিপূরণ মামলা করে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই মামলার ফলে আমেরিকাসহ বৈশ্বিক দরবারে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হবে। বিদেশি নতুন বিনিয়োগের পথও সংকুচিত হবে।
মামলার বিষয়ে জানতে যোগাযোগ করা হলে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানরত ওয়ার্ল্ড টেলের সিইও মোহাম্মদ নাইম মেহতাব চৌধুরী কথা বলতে রাজি হননি। তবে দেশে অবস্থানরত প্রতিষ্ঠানের নির্বাহী পরিচালক আল মাসুম আহম্মেদ বলেন, বিটিআরসি ২০১০ সালে একযোগে সব পিএসটিএন অপারেটরদের অপারেশন বন্ধ করে দেয়। এতে হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করা অপারেটরের সুইচ ও অন্যান্য যন্ত্রাংশের ব্যাপক ক্ষতি হয়।
তিনি বলেন, দেশে এখন ৫জি অপারেশন চালু হয়ে গেছে। এই মুহূর্তে ১৮শ ব্র্যান্ডের তরঙ্গ খুবই কাজে আসবে না মোবাইল ফোন অপারেটরদের। তারপরও তাদের দেওয়া হয়েছে এই তরঙ্গ। তার মতে, ১৮শ ব্র্যান্ডের তরঙ্গ দিয়ে খুবই কম খরচে অপারেশন চালু করতে পারছে বিদেশি মোবাইল ফোন অপারেটররা। এতে বিনিয়োগ কম, কিন্তু লাভ বেশি। সরকারের রাজস্ব আয়ও কম হয়। তারপরও বিটিআরসি কৌশলে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কাছে এই তরঙ্গ বিক্রি করছে।
প্রসঙ্গত, ওয়ার্ল্ড টেল ২০০১ সালে দেশের প্রথম বেসরকারি ল্যান্ডফোন অপারেটর হিসেবে লাইসেন্স গ্রহণ করে। দেশে মোবাইল ফোনের মতো ফিক্সড ফোন সেবায় প্রতিযোগিতা বাড়ানোর মাধ্যমে উন্নত সেবা নিশ্চিত করতে বেসরকারি খাতে পিএসটিএন লাইসেন্স দেওয়া হয় ২০০৪ সালে। ২০০৫ সালে ওয়ার্ল্ড টেলকে ৭ দশমিক ৪ মেগাহার্টজ তরঙ্গ বরাদ্দ দেওয়া হয় এবং একমাত্র ওয়ার্ল্ড টেলের কাছেই ১৮০০ ব্যান্ডের স্পেকট্রাম ছিল। ২০১৭ সালে কমিশনের ২০৩তম বৈঠকে ওয়ার্ল্ড টেল বাংলাদেশ লিমিটেডের তরঙ্গ বাতিল করে বিটিআরসি।