এ টি এম মোরশেদ আলম:
: কীরে ঝড়ু! তুই এখানে কেন?
: ঝড়ে উড়ে এসেছি।
: তো, মূলা তুললি কেন?
: যেটা ধরি সেটাই উপড়িয়ে যায়।
: তাহলে,আঁটি বাঁধলি কেন?
: সেটাই তো আমার দোষ।
গল্পে ঝড়ু নামক একব্যক্তি প্রচণ্ড ঝড়ের কবলে পড়ে অন্য একজন ব্যক্তির মূলা ক্ষেতে উড়ে এসেছে। মূলা গাছ আঁকড়িয়ে ধরে প্রান রক্ষার চেষ্টা করেছে কিন্তু যেটা ধরে সেটাই উপড়িয়ে যাচ্ছে। অতঃপর ঝড়ু উপড়িয়ে যাওয়া সকল মূলা একত্র করে আঁটি বেঁধেছে। এখন প্রশ্ন হলো ঝড়ু কি মূলা চুরির জন্য দায়ী হবে?
আইন অনুসারে কোন ঘটনাকে তখনই চুরি বলা যাবে যখন সেই ঘটনায় কিছু উপাদান বিদ্যমান থাকবে। বাংলাদেশে প্রচলিত আইন অনুসারে চুরির সংজ্ঞা বিশ্লেষণ করলে ৫ টি বৈশিষ্ট্য বা উপাদান পাওয়া যায়।
(১) মালিকের দখলভুক্ত সম্পত্তি হতে হবে।
(২) মালিকের সম্মতি ব্যতিরেকে হতে হবে।
(৩) অস্থাবর সম্পত্তি হতে হবে।
(৪) দ্রব্যটি নেয়ার পেছনে অসৎ উদ্দেশ্য থাকতে হবে।
(৫) দ্রব্যটিকে অপসারণ করতে হবে।
আলোচ্য ঘটনায় প্রায় সবগুলোই বিদ্যমান আছে। শুধু অসৎ উদ্দেশ্য ছিল কিনা সেটা অন্যান্য সাক্ষ্য-প্রমানের ভিত্তিতে আদালত নির্ধারণ করবেন। যদি প্রামাণিত হয় তাহলে ঝড়ুকে চুরির দায়ে দোষী করা যাবে।
তাহলে, ঝড় এবং প্রাণ রক্ষার্থে মূলা উপরানোর বিষয়টির কী কোন মূল্য নেই? আছে। আইনি পরিভাষায় এগুলোকে বলা হয় মিটিগেটিং ফ্যাক্টর (প্রশমনকারী উপাদান)। কোন ব্যক্তি যদি কোন অপরাধের দায়ে দোষী হয় তখন এই মিটিগেটিং ফ্যাক্টরগুলো বিবেচনায় নিয়ে আদালত শাস্তির পরিমান নির্ধারণ করতে পারবেন। যেমন, আইনে চুরির শাস্তি আছে সর্বোচ্চ ৩ বছর বা জরিমানা অথবা দুটোই হতে পারে। মিটিগেটিং ফ্যাক্টর গুলোতে আদালত সন্তুষ্ট হলে ঝড়ুর শাস্তি এখানে সর্বোচ্চ ৩ বছর না হয়ে কমও হতে পারে।
সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন ঘটনায় দেখা যাচ্ছে, আমরা মিটিগেটেং ফ্যাক্টরগুলো নিয়েই বেশী মাতামাতি হচ্ছে। দোষী ব্যক্তি অপরাধ করেছে কিনা সেই বিষয়ের তুলনায় তিনি কেন এমন অপরাধ করেছেন সেই বিষয়গুলোই বেশী প্রধান্য পাচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে শুরু করে মূলস্রোতের সংবাদমাধ্যমগুলোতেও এই প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। বিষয়টি যদি নারী সম্পর্কিত হয় তাহলে তো কথাই নেই। নারী চরিত্র হনন করাই যেন আমাদের একমাত্র উদ্দেশ্যে পরিণত হয়। তার পরিবার বা আত্নীয়স্বজনের চরিত্র নিয়ে কথা বলতেও আমরা পিছপা হই না। ধরে নিলাম কোন নারীর চরিত্র খারাপ ছিল, এমন কি তার পরিবার, আত্নীয়-স্বজনও চরিত্রহীন ছিল, এর মানে কি সেই নারীকে হত্যা করা যাবে?
হত্যা বা আত্মহত্যার জন্য উদ্বুদ্ধ করা একটা সম্পূর্ন ভিন্ন অপরাধ। নারী বা তার পরিবারের চরিত্রের বিষয়টি হলো মিটিগেটিং ফ্যাক্টর, আদালত ইচ্ছে করলে শাস্তির মাত্রা নির্ধারণের সময় এগুলো বিবেচনায় নিতেও পারেন বা নাও নিতে পারেন, সেটা আদালতের স্বীয় বিবেচনাধীন ক্ষমতা। কিন্তু এই মিটিগেটিং ফ্যাক্টরগুলো মূল অপরাধের উপর কখনোই প্রাধান্য পাবেনা।
লেখক: আইনজীবী।