এম. এ সাঈদ শুভ :
যারা ক্রসফায়ার-বিচারে বিশ্বাস করেন তারা এখন সাবেক পুলিশ সুপার বাবুল আক্তারের স্ত্রী মাহমুদা খানম মিতু হত্যাকান্ডের ঘটনায় নতুন মোড় নেয়ার অধ্যায়কে কি বলবেন? এবার মিতু হত্যাকান্ডে তার স্বামী বাদী বাবুল আক্তার নতুন মামলায় প্রধান আসামী! আপনাদের কি এই হত্যাকান্ডের পর ঘটনাপ্রবাহ সব মনে আছে? একটু স্মরণ করিয়ে দেই।
২০১৬ সালের ৫ জুন সকালে চট্টগ্রাম নগরের জিইসি মোড়ে ছেলেকে স্কুলের বাসে তুলে দিতে যাওয়ার সময় মাহমুদা খানম মিতুকে কুপিয়ে ও গুলি করে হত্যা করা হয়। ওই সময় পুলিশ সুপার বাবুল আক্তার ঢাকায় অবস্থান করছিলেন। চট্টগ্রামে ফিরে তিনি পাঁচলাইশ থানায় অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিদের আসামি করে হত্যা মামলা করেন।
মামলায় তিনি বলেছিলেন, তাঁর জঙ্গিবিরোধী কার্যক্রমের জন্য স্ত্রী হামলার লক্ষ্যবস্তু হয়ে থাকতে পারেন। এরপর দেশব্যাপী জঙ্গিবিরোধী সাঁড়াশি অভিযান চালায় পুলিশ। ওই সময় বেশ কয়েকজন কথিত জঙ্গি বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়।
বাবুল আক্তারের কান্নায় ভেঙ্গে পড়া ছবি অনেকেরই মনে আছে যা আবারো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে রীতিমতো ভাইরাল হয়েছে ভিন্নভাবে। আমরা এখনই বলছিনা বাবুল আক্তারই হত্যাকারী; তবে যেহেতু তার বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা দায়ের হয়েছে তাকে অভিযুক্ত বলতে পারি। বিচারিক আদালতের রায়ের পরেই আমরা সিদ্ধান্তে আসবো কে হত্যাকারী।
তবে আমরা শুধু কিছু ঘটনাপ্রবাহ দেখে নিই। এখন পুলিশ বলছে, কামরুল ইসলাম শিকদার ওরফে মুসাকে মিতু হত্যার ঘটনাস্থলে দেখা গেছে। তিনি বাবুল আক্তারের সোর্স ছিলেন এবং পলাতক। এই সমস্ত ঘটনাপ্রবাহের এক পর্যায়ে ২০১৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর বাবুলকে চাকরীচ্যুত করা হয়।
পুলিশের খাতায় মুসা পলাতক হলেও মুসার স্ত্রী পান্না আক্তার বলেন, কাঠঘর তিন রাস্তার মোড় থেকে তাঁর চোখের সামনে দিয়ে পুলিশই মুসাকে ধরে নিয়ে যায়। এরপর থেকে মুসা নিখোঁজ। নতুন মামলায় বাবুল আক্তার ১ নম্বর আসামি, মুসা ২ নম্বর।
পান্না আক্তার বলেন, পুলিশ সাঁড়াশি অভিযান শুরু করেছিলো। তাঁদের পরিবারে আর কোনো পুরুষ ছিল না। এ অবস্থায় মুসা ২২ জুন আদালতে আত্মসমর্পণের সিদ্ধান্ত নেন। ওই দিনই পুলিশ তাঁর হাতে হাতকড়া পরিয়ে নিয়ে চলে যায়। তারপর প্রচার করে মুসা পলাতক। পান্নার কথা হলো, যদি মুসা দেশ ছেড়ে পালাতেন, তাহলে পাসপোর্ট নিয়ে যেতেন।
পাসপোর্ট এখনো তাঁদের বাসায়। সন্তানদের খোঁজ নিতেন। নেননি। তাঁর দাবি, মুসা অন্যায় করলে বিচার হোক, তবু যেন তিনি কোথায় আছেন, সে তথ্য প্রকাশ করা হয়। (প্রথম আলো, ১৩ মে ২০২১)
এখন সাধারণ মানুষেরও প্রশ্ন, তাহলে মুসা কোথায়?
এ সমস্ত ঘটনা থেকে কয়েকটা প্রশ্ন করি। ক্রসফায়ার বিচারে কি ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হয়? এই হত্যাকান্ডে সন্দেহভাজন হিসেবে বন্দুকযুদ্ধে যারা মারা গেলো তারা যদি এই ঘটনায় জড়িত না থাকে? এই প্রশ্নগুলো এখন সামনে আসবে। আসলে ক্রসফায়ার কোনো সমাধান নয়। বিচারিক আদালতে সাক্ষ্য প্রমাণের মাধ্যমে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হয়।
তাহলে স্বাভাবিক প্রশ্ন আসবে, বিচারব্যবস্থার দীর্ঘসূত্রীতা, তদন্তে ধীরগতি ইত্যাদি নিয়ে মানুষ কি সন্তুষ্ট? মানুষ এখানেও সন্তুষ্ট নয়। একারণে মূল জায়গা সনাক্ত করতে। ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য রাষ্ট্রকে চাপ প্রয়োগ করতে হবে। রাষ্ট্র তার ফৌজদারি ও দেওয়ানি বিচারব্যবস্থাকে যুগোপযোগী করুক। তদন্ত ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করুক। দ্রুত ও নিরপেক্ষ বিচার পাওয়া প্রত্যেক নাগরিকের সাংবিধানিক অধিকার।
কেউ যত বড় অপরাধীই হোকনা কেনো আত্মপক্ষ সমর্থন করে ন্যায়বিচার পাওয়া তার সাংবিধানিক অধিকার। হোক সে জঙ্গী বা আরো বড় অপরাধী। বিচারিক আদালতের মাধ্যমে একটা ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হলে তার দৃশ্যমান ইতিবাচক প্রভাব সমাজে প্রতিফলিত হয়। অপরাধীদের নিকটও স্পষ্ট বার্তা যায়।
একটা সমাজ বা রাষ্ট্রে যদি ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা না যায় সে সমাজ বা রাষ্ট্র মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবেনা। টেকসই উন্নয়নের জন্য শক্তিশালী ও কার্যকরী বিচারব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা না গেলে আমাদের বারবার হোঁচট খেতে হবে। জনগণকেও তাদের বিচারব্যস্থা সম্পর্কে খোঁজখবর রাখতে হবে। কিভাবে চলে তাদের বিচারবিভাগ? বিচারবিভাগের জন্য কতটুকু বাজেট বরাদ্দ হয়? এই প্রশ্নগুলোর উত্তরও খুঁজতে হবে তাদের।
এদেশের আপামর জনসাধারণের মধ্য থেকে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার একটা জোড়ালো তাগিদ আসতে হবে। এগুলো নিজেদের প্রয়োজনেই করতে হবে। এই মূল জায়গা ঠিক করতে না পারলে ক্রসফায়ার বিচারে অধিকাংশ অবিচার ও ন্যায়বিচারের অপলাপই হবে; সমাজে আরো নতুন অন্যায়ের বীজই বপন হবে। সুতরাং আমাদের বিদ্যমান সমাজ মনস্তত্ত্ব থেকে ক্রসফায়ারের ভূত তাড়িয়ে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার দিকে মনোযোগী হতে হবে, আদালতসমূহ তথা বিচারবিভাগকে শক্তিশালী করতে হবে।
লেখক: বিচারক, বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিস।