মিল্লাত হোসেন:
রাষ্ট্রের ইচ্ছাই ন্যায়বিচার। রাষ্ট্র যতোটুকু সহ্য করবে, ততটুকুই ন্যায়বিচারের সীমানা। আন্তর্জাতিক স্তরে বিচারও কেবল তখনই সম্ভব হয় যখন রাষ্ট্রই তা অনুমোদন করে বা পরিত্যাগ করে কিংবা রাষ্ট্রই আর থাকে না। আর রাষ্ট্রের মুখপাত্র হলো সরকার। সার্বভৌম রাষ্ট্রের ইচ্ছাগুলোর সিংহভাগই সরকারের মুখ দিয়ে বের হয়। সরকারের বাইরে রাষ্ট্রের ইচ্ছা প্রকাশের ফোরাম ও সুযোগ নেই, এমন না হলেও খুব সংকীর্ণ।
তাই এর বাইরে যারা ন্যায়বিচারের প্রত্যাশী, তারা হয় ‘আদর্শ রাষ্ট্র'(Ideal state) নয় ‘কল্পরাষ্ট্র’ (Utopia)-র নাগরিক।
আয়রনি হলো, জনগণই রাষ্ট্র, তারপর সরকার তৈরি করে। জনগণ বলতে আসলে সংখ্যাগরিষ্ঠ কিংবা শক্তিশালী জনগণই বোঝায় সাধারণতঃ; সব জনগণ নয়! এরপর, বাকি জনগণকেও তা মেনে নিতে হয়। নইলে সেই “বাকি জনগণ”কে রাষ্ট্রই তাদেরই টাকায় কেনা বুলডোজার দিয়ে তাদের পিষে দেবে। আর, সেটা করতে ব্যর্থ হলে রাষ্ট্রই ভেঙে যাবে। রাষ্ট্রের চরিত্রই এমন।
এখন ‘সকল ক্ষমতার উৎস জনগণ’ এটা একটা ক্লিশে কথা হলেও সঠিকও আবার। জনগণ ভোট দেবে- এমনটা নয়। আগেকার দিনে যুদ্ধই ছিলো রাষ্ট্র, সমাজ, সরকার গঠনের শীর্ষ পথ। হাল আমলের নির্বাচন, ভোট দেয়া, জরিপ, এলগোরিদ্মিক এনালাইটিক্স এসবের বালাই তো ছিলো না তখনো। তবুও, তখনও সংখ্যাগুরু/শক্তিমানদেরই সরকার-রাষ্ট্র হতো। কোন একটা কৌম গড়ে উঠতো, সেই কৌমের অভ্যন্তরীণ ক্ষমতার লড়াইয়ের ভেতর দিয়ে নেতা গড়ে উঠতো। সেই নেতার বিরাট সমর্থক, সভাসদ গড়ে উঠতো। তারা সৈন্যসামন্ত-লোকলস্কর জোগাড় করে যুদ্ধে লিপ্ত হতেন। এই বিরাট কর্মযজ্ঞ সংখ্যাগুরু মানুষের সমর্থন ও সহযোগিতা ছাড়া সম্ভব ছিলো না। এখনকার তুলনায় তখনকার যুগের জনসমর্থন প্রকাশ বা ভোট করার পদ্ধতিই কিছুটা ভিন্ন ছিলো- এই যা!
কিন্তু রাষ্ট্রের হাতে তুরুপের টেক্কাটি চলে যায় এজন্যই যে, জনগণ একবার রাষ্ট্রটি গঠন করে ফেলার পর রাষ্ট্রটি এমনই লায়েক ও বাহাদুর হয়ে ওঠে যে জনগণই আর তার নাগাল পায় না; নিয়ন্ত্রণতো দূরের কথা! একেই কী বলে গহীনরাষ্ট্র (deep state)? অদৃশ্য অথচ watching Big Brothers। যারা নিজেরা রোজকার হরেদরের রাজনীতিতে না গলান না, কিন্তু রাজনীতির গ্র্যান্ড ন্যারেটিভগুলো ও পরিধিতে লাল পতাকা গেঁড়ে দেন।
এহেন রাষ্ট্র সর্বোচ্চ যতটুকু সহ্য করতে পারবে বলে মনে করে সেই মাত্রার আইন তৈরি করে তার সমমাত্রার আইনের শাসন অনুমোদন করে। কিন্তু মহাশয় নিজেও এতোই বাহাদুর হয়ে উঠেন যে, নিজেকেই মানতে চান না।
রাষ্ট্রকে বাহাদুর না হয়েও উপায় নেই। না হতে পারলে সে টিকেও থাকতে পারবে না! প্রথমতঃ নিজেকে রক্ষা, এরপর বিকাশের প্রয়োজনে নিজের আরেকটা আধিরাষ্ট্রিক সত্বা’ নির্মাণ করে নেয়, যা কারো কাছেই জবাবদিহি করে না। বরং জনগণসহ সবাইকেই “আধিরাষ্ট্রিক সত্তা”র কাছে জবাবদিহি করতে হয়।
পুঁজিবাদী, সমাজতন্ত্রী, গণতন্ত্রী, একনায়কতন্ত্রী, রাজতন্ত্রী, সামন্ততন্ত্রী, এসলামি, কেরেস্তানি, হিঁদু, বৌদ্ধ, ইউনিটারি বা কনফেডারেট – সব রাষ্ট্রের চরিত্র বা আকাঙ্ক্ষা একই। পার্থক্য স্রেফ মানুষের খাদ্যাভ্যাস, জিন আর আবহাওয়ায়!
নিজেদের যতোভাবেই মহিমান্বিত করুক না কেনো, রাষ্ট্রের কাছে মানুষ দু’পেয়ে জীব ছাড়া আর কিছুই না। দামে কম, ওজনেও কম, কাকলী ফার্নিচার মাত্র!
তাহলে উপায় কী মানুষের? একটাই, প্রতিনিয়ত ছোট ছোট লড়াই করা। নিজের যোগানো প্রতিটি পাইপয়সা ও সমর্থনের হিসাব নিতে হবে। সুসময়েও সজাগ থাকতে হয় দুঃসময়ের পাথেয় সঞ্চয়ের জন্য। কেউ শুনছে না, সে জন্যই কথাগুলো বারবার বলে যাওয়া যে- Injustice anywhere is a threat to justice everywhere!
লেখক : যুগ্ম মহানগর দায়রা জজ, সিলেট।