“ইশ্বরের পরবর্তী স্থানই পিতা-মাতার ” – ইউলিয়াম পেন যথার্থই বলেছিলেন।
সৃষ্টিকর্তার অধিকারের পর প্রথম অধিকার হচ্ছে পিতা-মাতার অধিকার। একটা সময় পর্যন্ত মাতা-পিতা সন্তানকে লালন-পালন করেন। পরবর্তীতে সন্তানের কর্মক্ষম হওয়ার পর থেকেই পিতা-মাতার প্রতি সন্তানের দায়িত্ব বর্তায়।
আমরা জানি নৈতিক বা ধর্মীয় দৃষ্টিকোন থেকে পিতা-মাতার দ্বারা সন্তানের কোনো ক্ষতি হলেও তাদের সাথে খারাপ ব্যবহার করা যাবে না। তা সত্ত্বেও পিতা-মাতার সাথে খারাপ ব্যবহার করার যথেষ্ট চিত্র রয়েছে বর্তমান সমাজে। অনেক সন্তানের সক্ষমতা থাকার পরও তারা সঠিক শিক্ষা অথবা সদিচ্ছার অভাবে পিতা-মাতা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। মাতা-পিতার ব্যয়ভার বহন না করে তাদেরকে বৃদ্ধাশ্রমে বা রাস্তায়, স্টেশনে ফেলে যাওয়ার অজস্র ঘটনা প্রতিনিয়ত সংঘটিত হচ্ছে আমাদের সমাজে, যা চরম অবক্ষয়ের ইংগিত বহন করে। এমন পরিস্থিতি অনুধাবন করে সরকার সন্তান কর্তৃক পিতা-মাতার ভরণ-পোষণ নিশ্চিত করার জন্য সরকার একটি আইন পাস করে। বর্তমানে এই আইন থাকা সত্ত্বেও দেখা যাচ্ছে- অনেক পরিবারেই বৃদ্ধ পিতা-মাতা তাদের সন্তানের কাছ থেকে ভরণ-পোষণ পাচ্ছেন না বরং প্রায় সময়ই লাঞ্চনা-বঞ্চনার শিকার হচ্ছেন। পিতা মাতাকে বৃদ্ধ বয়সে একাকীত্ব ও নানা ধরনের বঞ্চনা থেকে বাঁচাতে রক্ষাকবচ হিসেবে আমাদের দেশে পিতা মাতার ভরণপোষণ আইন,২০১৩ আইনটি চমৎকার ভুমিকা পালন করবে।
পিতা মাতার অধিকার নিয়ে এই আইনের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গূলো আলোকপাত করা হলো।
•পিতা-মাতার ভরণ-পোষণ নিয়ে কোন আইন আছে?
হ্যাঁ, পিতা-মাতার ভরণ-পোষণ নিয়ে বাংলাদেশে একটি আইন রয়েছে। সরকার একটি আইন পাস করে যার নাম “পিতা-মাতার ভরণ পোষণ আইন,২০১৩”। ২০১৩ সালের পূর্বে এ সম্পর্কিত কোনো বিধিবদ্ধ আইন ছিল না।
•ভরণপোষণ বলতে কি বুঝায়?
পিতা-মাতার ভরণ পোষণ আইন,২০১৩ এর ২ ধারায় “ভরণ-পোষণ” এর সুন্দরও একটি চমৎকার সংজ্ঞা প্রদান করেছে। খাওয়া -দাওয়ার খরচ, অন্ন, বস্ত্র, চিকিৎসা ও বাসস্থান ও আর্থিক বিষয়ের পাশাপাশি পিতা-মাতাকে সময় দেওয়া বা সঙ্গ প্রদানের বিষয়টিও ভরণ-পোষণের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। অর্থাৎ কেবল টাকা-পয়সা দিলেই দায়-দায়িত্ব শেষ নয়। এই আইন বলা হয়েছে, বয়স্ক পিতা-মাতাকে অবশ্যই সময় দিতে হবে।এবং এই সময় দেয়াও ভরন-পোষণ এর অন্তর্ভুক্ত।
• সন্তান যদি প্রতিবন্দী হয় বা কোনো কারণে উপার্জন করতে না পারে তাহলে সে কি পিতা মাতার ভরণপোষণের দিতে বাধ্য ?
এই আইনের ২ ধারায় বলা হয়েছে, সক্ষম এবং সামর্থ্যবান পুত্র বা কন্যা পিতা-মাতাকে ভরণ-পোষণ দিতে বাধ্য। অর্থাৎ সামর্থ্যহীন সন্তান বাধ্য এমন নয়।
• পিতা-মাতার ভরনপোষণ কিভাবে নির্ধারন হবে?
পিতা-মাতার ভরণ-পোষণ আইনের ৩ এর (৭) অনুযায়ী, কোনো পিতা বা মাতা কিংবা উভয়ে, সন্তানদের সাথে বসবাস না করতে চাইলে পৃথকভাবে বসবাস করলে, সেই ক্ষেত্রে উক্ত পিতা বা মাতার প্রত্যেক সন্তান তাহার দৈনন্দিন আয়-রোজগার, বা ক্ষেত্রমতো, মাসিক আয় বা বাৎসরিক আয় হতে যুক্তিসঙ্গত পরিমাণ অর্থ পিতা বা মাতা, বা ক্ষেত্রমতে, উভয়কে নিয়মিত প্রদান করবে। অর্থাৎ বর্তমান বাজারদর অনুযায়ী পিতামাতার সুন্দর জীবন-যাপন এর জন্য যা যা প্রয়োজন সেই অনুযায়ী নির্ধারণ হবে।
• পিতা-মাতা আর্থিকভাবে সচ্ছল, সামর্থ্যবান হলেও সন্তান কি বাধ্য পিতা মাতার ভরণপোষণের জন্য?
এই বিষয় স্পষ্ট যে, পিতা-মাতা আর্থিকভাবে সচ্ছল হলেও তাদের ছেলে বা মেয়ে অবশ্যই তাদেরকে ভরণ-পোষণ দিতে হবে। তবে সন্তান অবশ্যই সক্ষম এবং সামর্থ্যবান হতে হবে।
• পিতা মাতার যখন একের অধিক সন্তান থাকে তখন ভরণপোষণের পরিমান, কে কতটুকু দিবে তা কিভাবে নির্ধারন করা হবে?
যেহেতু একই পরিবারে সকল ভাই-বোনের উপার্জন ক্ষমতা সমান হয় না। তাই এই আইনের ৩ ধারার উপধারা ২ অনুযায়ী সন্তানেরা নিজেদের মাঝে
আলাপ-আলোচনা করে ভরণ- পোষণ এর পরিমাণ নির্ধারণ করবে। যাতে সন্তানরা তাদের সামর্থ্যের ওপর ভিত্তি করে বৃদ্ধ পিতা-মাতার ভরণ-পোষণের জন্য আনুপাতিক হার নির্ধারণ করতে পারে। অর্থাৎ ছেলে-মেয়ে একাধিক হলে আইনের বিধান হলো তারা নিজেদের মধ্যে আলাপ আলোচনা করে পিতা-মাতার ভরণ-পোষণ নিশ্চিত করতে পারবে।
• সন্তান চাইলেই কি তাদের বৃদ্ধ পিতা মাতাকে তাদের ইচ্ছার বাইরে বৃদ্ধাশ্রম বা অন্য কোথাও রাখতে পারবে?
না, পারবে না। পিতা-মাতার ভরণ-পোষণ আইনের অন্যতম অনন্য বৈশিষ্ট হলো এই আইনের মাধ্যমে পিতা-মাতার ইচ্ছাকেই প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। আইনের ৩ ধারায় বলা হয়েছে, সন্তান বা সন্তানরা চাইলেই পিতা-মাতা তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে বৃদ্ধাশ্রম বা অন্য কোথাও রেখে আসতে পারবে না। কিংবা আলাদাভাবে বাস করতে বাধ্য করতে পারবে না। তবে পিতা-মাতা চাইলে তাদেরকে পৃথকভাবে রাখার ব্যবস্থা করা যাবে। সেক্ষেত্রে সন্তান বা সন্তানদেরকে অবশ্যই পিতা-মাতার সঙ্গে নিয়মিত সাক্ষাৎ করতে হবে এবং মা-বাবার স্বাস্থ্য সম্পর্কে নিয়মিত খোঁজ-খবর রাখতে হবে, প্রয়োজনীয় চিকিৎসাসেবা ও পরিচর্যা করতে হবে।
• কোন বৃদ্ধ দম্পতির অথবা বৃদ্ধ তার মৃত সন্তানের সন্তান অর্থাৎ তার নাতি থেকে ভরণপোষণ দাবী করতে পারবে?
হ্যাঁ পারবে। যদিও আইনের নাম পিতা-মাতার ভরণ-পোষণ আইন তারপরও এই আইনের ৪ এর ক ও খ ধারা অনুযায়ী দাদা-দাদি এবং নানা-নানির অধিকারও নিশ্চিত করা হয়েছে। এই আইন অনুযায়ী সন্তান বা সন্তানেরা পিতা জীবিত না থাকলে দাদা-দাদি জীবিত থাকলে তাদেরকে পিতার মতোই ভরণপোষণ দিতে হবে। আর মাতা জীবিত না থাকলে নানা-নানি জীবিত থাকলে তাদেরকে মাতার মতোই ৩ ধারা অনুযায়ী ভরণপোষণ দিতে হবে। তার মানে, কারও যদি শুধু মাতা এবং পিতা মরণে দাদা-দাদি থাকে তাহলে তিনজনকেই ভরণ-পোষণ দিতে হবে।
• বৃদ্ধ সৎ মা অথবা সৎ পিতার ভরনপোষণ করতে সন্তান বাধ্য কি?
না, পিতা-মাতার ভরণ-পোষণ আইন অনুসারে কেবল জন্মদাতা পিতা এবং গর্ভধারিণী মা ভরণ-পোষণ পাবেন। সৎমা এবং সৎবাবাকে ভরণ-পোষণ দিতে সন্তান বাধ্য নয়। সন্তান দিতে পারে তবে আইনে কোন বাধ্যবাধকতা নাই।
• সন্তান পিতামাতাকে ভরণ-পোষণ না দিলে শাস্তির বিধান কী?
এই আইনের ধারা ৫ এ পিতা-মাতার ভরণ-পোষণ আইন অনুযায়ী পিতা-মাতা বা দাদা-দাদি বা নানা-নানিকে ভরণ-পোষণ না দিলে তা অপরাধ হিসেব গণ্য হবে। এই অপরাধের শাস্তি সর্বোচ্চ ০১(এক) লক্ষ টাকা অর্থদন্ড এবং জরিমানার টাকা অনাদায়ের অনূর্ধ্ব ৩মাস পর্যন্ত কারাদণ্ড হতে পারে।
• কোন সন্তানের স্ত্রী বা স্বামী অথবা ছেলেমেয়ে সহ অন্য কোন আত্মীয় যদি পিতা মাতার ভরণপোষণে বাঁধা দেয়, তবে শাস্তির বিধান আছে?
হ্যাঁ আছে। কোনো সন্তানের স্ত্রী, ছেলে-মেয়ে বা নিকটাত্মীয় যদি বৃদ্ধ মা-বাবার প্রতি সন্তানকে দায়িত্ব পালনে বাঁধা দেয় তাহলে তারাও একই অপরাধে অপরাধী হবে। ফলে তারাও একই শাস্তির মুখোমুখি হবে। অর্থাৎ
অভিযোগ প্রমাণিত হলে তাদের ১ লক্ষ টাকা জরিমানা অনাদায়ে তিন মাসের কারাদণ্ড প্রদান করা হবে।
• এই আইনের অপরাধ সমুহ:
পিতা মাতার ভরণ-পোষণ আইন ২০১৩ এর ৬ ধারা অনুযায়ী এই আইনের অপরাধ সমুহ আমলযোগ্য এবং পারিবারিক ব্যাপার বলে জামিনযোগ্য এবং আপোষযোগ্য। ভুক্তভোগী চাইলে আপোষের মাধ্যমে মিমাংসা করতে পারবে।
• অপরাধ বিচারার্থ গ্রহণ ও বিচার:
এই আইনের ৭ ধারায় বলা আছে
কোন সন্তান যদি আইন অনুযায়ী পিতা-মাতা বা দাদা-দাদি অথবা নানা-নানিকে ভরণ-পোষণ না দেয় তবে নিম্ন বর্নীত উপায়ে ভুক্তভোগী অভিযোগ দায়ের করতে পারবে। এই আইনের অধীনে সংঘটিত অপরাধ প্রথম শ্রেণির জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট বা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে বিচার যোগ্য হবে। এবং আদালত অপরাধ সংশ্লিষ্ট সন্তানের পিতা-মাতা বা ভুক্তভোগীর লিখিত অভিযোগ ব্যতীত আমলে গ্রহন করবে না।
• লিগ্যাল এইডে বিন্যমুল্যে আইনী সেবা গ্রহনের সুযোগ আছে কিনা?
হ্যাঁ, আছে। বৃদ্ধ পিতা-মাতা বা ভুক্তভোগী ব্যক্তি যদি আর্থিকভাবে অসচ্ছল হন তবে জেলা লিগ্যাল এইড অফিসার বরাবর লিখিত আবেদন করতে হবে। অফিসার তার জন্য সরকারি খরচে আইনজীবী নিয়োগ করে দেবেন।
• আপোষে নিস্পতির বিধান:
ধারা ৮ অনুযায়ী ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে অভিযোগ দায়ের বা মামলা শুরু হওয়ার পরও আদালত যে কোনো ব্যক্তির নিকট বিষয়টি আপোষ করিয়ে মীমাংসার জন্য পাঠাতে পারেন। আপোষ নিস্পত্তির জন্য সাধারণত সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বা মেম্বার, বা পৌরসভার মেয়র বা কাউন্সিলর বা যে কোন উপযুক্ত ব্যক্তি কে আপোষ মিমাংসার জন্য পাঠাতে পারে। আপোষ মিমাংসায় ব্যর্থ হলে তখন মামলা চলতে থাকবে এবং বিচারে দোষী সাব্যস্ত ব্যক্তির শাস্তি হবে।
• আমাদের দেশে পিতা মাতার ভরণপোষণ আইনের প্রয়োগ না হওয়ার কারন কি?
এর প্রধান কারণ হচ্ছে আইনের যথাযথ প্রয়োগের অভাব এবং আইন সম্পর্কে না জানা বা অজ্ঞতা। এটা নিশ্চিতভাবেই বলা যায় যে, যেসকল পিতা-মাতা সন্তানের কাছ থেকে ভরণ-পোষণ পাচ্ছেন না তারা এবং তাদের সন্তানরা এই আইন সম্পর্কে জানেন না। সন্তানরা এই আইন সম্পর্কে জানলে শাস্তির ভয়ে হলেও বৃদ্ধ পিতা-মাতার ভরণ-পোষণ বিষয়ে সচেতন হতো। আইন জানা থাকলে পিতা বা মাতা কোনো না কোনোভাবে হয়তো থানায় বা আদালতে হাজির হতেন। এই আইন সম্পর্কে যত জানানো যাবে ততই মানুষ সচেতন হবে।
পরিশেষে একটা কথা না বললেই নয়, পিতা-মাতার ভরণ-পোষণ আইনে বর্ণিত অধিকার ও কর্তব্যসমূহ সম্পর্কে প্রত্যেক নাগরিককে সচেতন হতে হবে। মানুষ আইনের বিধান সম্পর্কে সচেতন হলে আইনের বাস্তবায়ন সামাজিক দায়বদ্ধতায় পরিণত হবে। তখন সমাজের একজন আইন মানতে না চাইলে অন্যরা তাকে বাধ্য করবে আইন মানার জন্য।
লেখক: আইনজীবী ,জেলা ও দায়রা জজ আদালত ঢাকা ও খাগড়াছড়ি।