শফিকুল ইসলাম:
ধরুন একজন ব্যক্তি একটা কিছু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট করলেন। এবার একজন কমেন্ট করে সেই পোস্টকারীকে গালাগাল কিংবা অশ্লীল কিছু বললো অথবা কোন হুমকি দিল। ধরে নিন ইনি হলেন প্রথম কমেন্টকারী। তার এই কাজটি সাইবার আইনে একটি অপরাধ এবং এটি সাইবার বুলিং। এবার দ্বিতীয় এবং তৃতীয় আরো দুইজন কমেন্টকারী এলেন এবং তারা পোস্টদাতাকে সমর্থন দিলেন এবং তারা দেখলো যে প্রথম কমেন্টকারী পোস্টদাতাকে বুলিং করে কিছু বলেছে এবং দেখার পর তারা সেই প্রথম কমেন্টকারীকে যাতা বললো, গালাগাল, হুমকি-ধামকি ইত্যাদি দিলো। দেখুন এখানে দ্বিতীয় ও তৃতীয় জন কিন্তু প্রথম কমেন্টকারীর বুলিং দেখে ক্ষিপ্ত হয়ে পোস্টদাতার পক্ষে প্রতিবাদ করেছে। কিন্তু প্রতিবাদটা করতে গিয়ে তারা নিজেরাও গালাগাল, অশ্লীল বাক্য বা হুমকি ধামকি দিল। এদিক থেকে ভেবে দেখলে বলতে হয় তারা একটি সাইবার বুলিংয়ের প্রতিবাদ আরেকটি সাইবার বুলিং দিয়ে করলো।
আরো আলোচনায় যাওয়ার আগে সাইবার বুলিং বিষয়টা কি সেটা একটু বলা দরকার। বুলিং শব্দের আভিধানিক অর্থ হল অপ্রত্যাশিত আক্রমণ বা সামাজিক ভাবে হেয় করা। বুলিং শব্দটি এসেছে বুলিজম শব্দ থেকে যা অর্থ হল তর্ক বা কথাকাটাকাটির কারণে কোন একজনকে সামাজিকভাবে হেয় করা। তাহলে সাইবার বুলিং হল অনলাইনে বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম অথবা ইলেক্ট্রনিক কোন মিডিয়া ব্যবহার করে কোন ব্যক্তিকে সামজিকভাবে হেয় করার প্রচেষ্ঠা। তবে আরো ব্যাপক অর্থে সাইবার বুলিং হল তথ্য প্রযুক্তির অপব্যবহার করে কাউকে ভীতি প্রদর্শণ করতে বা হেয় প্রতিপন্ন করতে কিংবা হুমকি প্রদান অথবা মানসিক আঘাত করার জন্য কোন বার্তা প্রেরণ, পোস্ট করা, কমেন্ট করা ইত্যাদিকে বোঝায়। ইউনিসেফ সাইবার বুলিংয়ের কয়েকটি উদাহরণ দিয়েছে। যেখানে তারা বলছে কোন ব্যক্তির মিথ্যা পরিচয় নিয়ে কোন বার্তা প্রেরণ , কাউকে আঘাত করে বার্তা প্রেরণ, কারো ব্যাপারে কোন মিথ্যা তথ্য বা গুজব ছড়ানো, অথবা কারো এমন কোন ছবি পোস্ট বা এমন কিছু পোস্ট করা যা তাকে লজ্জ্বায় বা বিব্রতকর অবস্থায় ফেলবে।
সাইবার বুলিং এখনকার ইন্টারনেটের দুনিয়ায় একটি নতুন সমস্যা। যদিও পূর্বেও বুলিং ছিল তবে সেটা অফলাইনে। ইন্টারনেটের বদৌলতে এখন শুরু হয়েছে অনলাইন বুলিং বা সাইবার বুলিং। সাইবার বুলিং অফলাইন বুলিংয়ের চেয়ে অনেক বেশী মারাত্মক। কেননা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বা ইন্টারনেটে কোন ওপেন পাবলিক সাইট ব্যবহার করে একজন ব্যক্তিকে নিমিষের মধ্যে তার পরিচিত ব্যক্তিদের বাইরেও অসংখ্য মানুষের কাছে হেয় করা যায়। কিন্তু অফলাইনে সেটা নিমিষেই চেনা-অচেনা অসংখ্যজনের কাছে পৌছানো অনেকক্ষেত্রেই দূরহ ব্যাপার। অনলাইন বুলিংয়ের কারণে আত্মহত্যার ঘটনাও ঘটে থাকে। এ-থেকে বোঝা যায় এটা কোন সাধারন বিষয় নয়। যেকোন অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে হবে। যেকোন অন্যায় বা অপরাধের প্রতিবাদ করা অত্যন্ত ভাল কাজ। তবে প্রতিবাদও করতে হবে সুনির্দিষ্ট নিয়মে। প্রতিটি কাজেরই সুনির্দিষ্ট নিয়ম রয়েছে। কেউ সাইবার বুলিংয়ের স্বীকার হলে আইনি সহায়তা নেওয়ার জন্য কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইমের সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন ডিভিশন, সাইবার পুলিশ সেন্টার, হ্যালো সিটি অ্যাপ, রিপোর্ট টু র্যাব অ্যাপ, ৯৯৯ এবং প্রতিটির ফেসবুক পেজেও অভিযোগ জানানো যায়। কিন্তু অনেকক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে কেউ বুলিং করলে তাকে পাল্টা বুলিং করা হয়। যার কারণে সাইবার আইনের যে উদ্দেশ্য ব্যক্তির নিরাপত্তা ও অনলাইনের পরিবেশকে সুন্দর রাখা দুটিই বিঘ্ন হয়। মনে করুন একজন লোক খুন করেছে। এটি একটি সর্বোচ্চ অপরাধ। এখন সেই লোকটি হত্যার আসামী বলে তাকে কি যেকোন সাধারণ লোক হত্যা করতে পারে? আর এই যুক্তি কি দিতে পারে যে সে যেহেতু খুনের আসামী তাই তাকে হত্যা করা যেতেই পারে? উত্তর অবশ্যই না হবে। সে এমনটি করতে পারেনা। কেননা সেই লোকের বিচারের জন্য দেশে নির্দিষ্ট নিয়ম রয়েছে। এখানে যে লোকটি হত্যার আসামীকে মেরে ফেললো বরং এবার তারই উক্ত আসামীর হত্যার দায়ে বিচার করতে হবে; তাই-নয় কি?
এই উদাহরণের উদ্দেশ্য হল এটাই পরিষ্কার করে বোঝানো যে সাইবার বুলিং একটি অপরাধ এবং সাইবার বুলিংয়ের প্রতিবাদ করতে হবে নিজে সেই অপরাধ না করে। যে ব্যক্তি বুলিং করছে তাকে বোঝানো যেতে পারে, বা চূড়ান্তভাবে আইনি সহায়তা নেওয়া যেতে পারে। অন্যায়ের প্রতিবাদ কখনো আরেকটি অন্যায় কাজ হতে পারে না।
আবার অনেকক্ষেত্রে এমনটি হয়ে থাকতে পারে যে, কোন একজন ব্যক্তি কোন কিছু মজার ছলেকিছু বলেছেন। কিন্তু অনলাইন হওয়ায় ঐ কথাটির দুইরকম মানে করা যেতে পারে। নিছক মজা হিসাবে নেওয়া যেতে পারে আবার বুলিংও ধরা যেতে পারে। এসব ক্ষেত্রে ভুক্তভোগীকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে বিষয়টিকে তিনি কিভাবে দেখছেন বা এটি তার জীবনে কেমন প্রভাব ফেলছে। অনেকক্ষেত্রে অনেক কিছু মজার ছলে বলা হয়, সেসব জিনিস খুব গুরুতরভাবে না নেওয়ায় ভাল। তবে যেহেতু অনলাইন প্লাটফর্মে অনেক শ্রেনীর মানুষের দেখার বা যুক্ত হওয়ার সুযোগ থাকে তাই বেশী গুরুতর মজা অনলাইনে পাবলিক সেকশনগুলিতে না করাই ভাল। কোন ক্ষেত্রে এরকম মজা করা হলে হয়তো যার সাথে মজা করা হচ্ছে, এবং যিনি করছেন তারা খুব কাছের হতে পারেন এবং দুইজনই বিষয়টা একটা ফান হিসাবেই হয়তো নিচ্ছেন। কিন্তু তৃতীয় একজন মনে করলেন যে এখানে হয়তো বুলিং করা হচ্ছে এবং তিনি গিয়ে সেখানে না জেনে বুঝে প্রতিবাদ করে বসলেন। এরূপ কাজও একটি বিব্রতকর পরিস্থিতি তৈরী করতে পারে। অতএব, আপনার কাছে যদি মনে হয় যে বুলিং হচ্ছে তবে যাকে ভুক্তভোগী ভাবছেন তার সাথে কথা বলুন ও দেখুন তিনি বিষয়টি কিভাবে দেখছেন। যদি আসলেই বুলিং হয় ভিক্টিমের পাশে দাঁড়ান, সাহস দিন ও নিয়মতান্ত্রিকভাবে ব্যবস্থা নিন ও প্রতিবাদ করুন।
লেখক- এলএলবি (অনার্স), ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়।