সাব্বির এ মুকীম:
গত প্রায় এক যুগে ভারতের সবচে পরিচিত ও জনপ্রিয় দুজন আইনজীবী হলেন জগদীশ ত্যাগী জলি এবং কে ডি পাঠক- অন্তত বাংলাদেশে অনেকের কাছেও। আমাদের আজকের আলাপ এডভোকেট জলি কে নিয়ে। জলি এলএল বি মুক্তি পায় ২০১৩ সালে আর তার সিকুয়্যল জলি এলএল বি ২০১৭ সালে মুক্তি পায়। বলিউডি কোর্টরুম-ড্রামা সিনেমা বর্গে এই ২টি ছবি ই সবচে জনপ্রিয় তখমা পায়। দুই সিনেমাতেই নায়ক তথা আইনজীবীর নাম এডভোকেট জগদীশ ত্যাগী জলি।
২০১৩ সালের সিনেমাটি পুরোপুরি আমাদের দেশের এমপি পুত্র শাবাব চৌধুরীর বিরুদ্ধে আনা মদপ্যবস্তায় গাড়ী চালিয়ে পথিক হত্যার অভিযোগের ঘটনার প্রায় হুবহু চিত্রনাট্য নিয়ে। অন্যদিকে ২০১৮ সালের সিনেমাটি আমাদের দেশের শিল্পপতি পুত্র তাহমিদ হাসান খানের বিরুদ্ধে আনা হলি আর্টিজানে জংগীপনা করে হত্যার অভিযোগের ঘটনার প্রায় হুবহু চিত্রনাট্য নিয়ে। আমাদের দেশের বাস্তব ঘটনার সাথে বড়ো দাগে দুই সিনেমায় একটাই তফাৎ, উভয় সিনেমায় দর্শক দেখে অভিযুক্তের অপরাধ প্রমান হয়।
এই দুটি সিনেমা নিয়ে ভারতীয় বিচার বিভাগ থেকে এ পর্যন্ত ৪টি রায় প্রকাশ হয়েছে।
জলি এলএল বি সিনেমা নিয়ে প্রথম মামলা হয় দিল্লীর সদর মুখ্য মহানগর হাকিম এর আদালতে, করেন দিনেশ ভাট , পরিচালক সুভাষ কাপুর সহ আরও অনেক কে অভিযুক্ত করে। দিনেশ ভাট একজন কবি। কবির নালিশ ছিলো- কবির লেখা ‘লক-আপের কবিতা’ নামের কবিতার বই এর “থানার ভেতর” কবিতার কপিরাইট ভঙ্গ হয়েছে। কিভাবে? কবির কবিতায় কবি দেখিয়েছেন থানার ভেতর পুলিশ কতো দূর্ণীতি করে। আর প্রথম জলি এলএল বি সিনেমার ১ঘন্টা ১২ মিনিট ৫৯ তম সেকেন্ড হতে ১ ঘন্টা ১৫ মিনিট ৪৬ তম সেকেন্ড পর্যন্ত অংশে দেখানো থানার ভেতরে পুলিশ অফিসারেরা মামলা তদন্তভার সংক্রান্ত দায়িত্ব নিয়ে অবৈধ নিলাম করছেন। কবি দাবী করেন এই অবৈধ নিলাম দুর্ণীতির আইডিয়া তাঁর কবিতা থেকে টুকলিফাই করা হয়েছে। বিজ্ঞ আদালত কবিতার সাথে সিনেমার কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যায়নি মর্মে নালিশটি খারিজ করেন।
প্রথম জলি এলএল বি সিনেমা নিয়ে দ্বিতীয় মামলাটি ছিলো দিল্লী হাইকোর্টের ২০১৩ সালের ১৪৯২ নম্বরটি ছিলো জনস্বার্থে রিট । তখনও সিনেমাটির কেবল টিজার মুক্তি পেয়েছে। সেই টিজারের বেশ কিছু সংলাপ শুনে ও দৃশ্য দেখে দেখেই কয়েকজন উকিল সাহেব এই সিনেমাটি মুক্তি না দিতে আদেশ চেয়ে রিটটি করেন- কারন সিনেমার অভিযুক্ত অসংলগ্ন এসব সংলাপের ফলে উকিলদের মানহানী হয়েছে ও আরও হবে। বিজ্ঞ আদালত কেবল টিজার দেখে দেখেই সিনেমাটিকে মানহানীকর বলার জন্য পরিপক্ক নয় এবং টিজারে কোনো জনস্বার্থহানীর উপাদান নাই মর্মে রিটটি খারিজ করেন। একই রকম আরও যা ছিলো ২০১৩ সালের ৬৮০১ নং রিট মাদ্রাজ হাইকোর্টেও হয়- তা ২০২০ সনে হিয়ারিং এর পর্যায়ে এসে ইনফ্র্যাচুয়াস হয়ে যায়।
তৃতীয় মামলাটি হয় যখন সিনেমার সিক্যুয়েল জলি এলএলবি-২ সিনেমাটি সেন্সর বোর্ডে ছিলো, রিটটি হয় বোম্বে হাইকোর্টের আওরংগাবাদ বেঞ্চে। সিনেমার ১৪তম মিনিটের দিকে একটি র্দশ্য ছিলো বিচারকের আদেশে ক্ষুব্ধ হয়ে আসামী তার উকিলের চোখের ইশারা পেয়ে ডায়াসে জুতা ছুড়ে মারে, হতাশার মন্তব্য করে, গালি দেয়। রিটের পর বিজ্ঞ আদালত ১টি কমিটি করে দেন সিনেমার কেবল আলোচ্য দৃশ্য বিশ্লেষণে। কমিটির প্রতিবেদন পেয়ে বিজ্ঞ আদালত সেন্সর বোর্ড কে নির্দেশ দেন কেবল জুতা কে এবং গালি কে কর্তনের আদেশ প্রদান করতে তবে হতাশা কর্তন করা যাবে না। তবে সিনেমায় খুব বড়ো করে লিখে দিতে হবে যে এটা সম্পূর্ণ রূপে কাল্পনিক এবং কেবলমাত্র বিনোদনের জন্য প্রস্তুতকৃত। সংশ্লিষ্ট সকলে বিচারব্যবস্থার পূর্ণ আস্থা ও সন্মান পোষণ করেন।
এ পর্যন্ত জলি এলএলবি -২ নেমা নিয়ে সর্বশেষ রায় এসেছে এ মাসের ৪ তারিখ তথা ০৪ঠা আগষ্ট, ২০২১ এ। বলিউডের নায়ক অক্ষয় কুমার সহ কয়েকজন রাজস্থান হাইকোর্টের জয়পুর বেঞ্চে ২০১৭ সালের ৬১৬৫ নম্বর ফৌজদারি বিবিধ মামলাটি করেন।
কিন্তু কেনো?
কারন রাজস্থানের কয়েকজন উকিল অক্ষয়কুমার সহ জলি এলএল বি ২ সিনেমার পরিচালক, প্রযোজক সহ জনা কয়েক কে আসামী করে জয়পুরের অতিরিক্ত মূখ্য মহানগর হাকিম আদালত নং ২০ এ উক্ত আদালতের ২০১৭ সালের ৬৬১ নং সি আর মামলায় এই নালিশ দায়ের করেন যে এই জলি এলএল বি -২ সিনেমায় উকিলদের ভয়ানক রকম অপমান করা হয়েছে। ফরিয়াদী কে পরীক্ষান্তে বিজ্ঞ নিম্ন আদালত নালিশটি দণ্ডবিধির ৫০০ ধারায় মানহানির সে অভিযোগ আমলে নিয়েছেন।
বিজ্ঞ নিম্ন আদালতের আমলী আদেশের বিরুদ্ধে অক্ষয় কুমার গং আলোচ্য ফৌজদারি বিবিধ মামলাটি করেন।
বিজ্ঞ হাইকোর্ট বিভাগের বিচারক বিচারপতি সতীশ কুমার সিনহা চারটি প্রেক্ষিত বিবেচনায় বিজ্ঞ নিম্ন আদালতের আমলী আদেশ বাতিল করে ফরিয়াদীর নালিশটি খারিজ করেন।
১ম গ্রাউন্ড ছিলো যে বিষয়টি চতুর্থ মামলায় সম-মর্যাদার আদালতে নিস্পত্তি হয়েছে, সেখানে সে বিজ্ঞ আদালতের কমিটি অভিযুক্ত কোনো উপাদান পেলে অবশ্যই তাদের রিপোর্টে বলতো। আর যেটুকুও সমস্য ছিলো তা সেন্সর বোর্ডের নির্দেশনা মোতাবেক কর্তন করেই সেন্সর সার্টিফিকেট দেয়া হয়।
২য় গ্রাউন্ড ছিলো, আমলী আদেশে স্পষ্ট যে – কেবল সিনেমার ট্রেলার বিবেচনায় নিয়ে আমলী আদেশ হয়েছে ; কিন্তু এমন যেকোনো আদেশের ক্ষেত্রে পুরো সিনেমা বিবেচনায় নিতে হবে।
বিজ্ঞ আদালত এই ২য় গ্রাউন্ডেরে বিপরীতে আমলী আদালতের আমল শুনানীকালে বিস্তারিত পুংখানুপুংখভাবে বিবেচনার দরকার নেই যুক্তি মেনে নিয়েই ৪র্থ গ্রাউন্ড এই আকারে লিপি করেন যে, আদালতের সামনে উপস্থাপিত নথীতে আমলে নেয়ার মতো পর্যাপ্ত উপাদানের অস্তিত্ব আছে কিনা তা অবশ্যই আমলী পরীক্ষায় বিবেচনায় আনতে হবে যা আলোচ্য আমলী নথীতে ছিলো পুরোপুরি অনুপস্থিত।
বিজ্ঞ আদালতের ৩য় গ্রাউন্ড ছিলো শিল্পীর স্বাধীনতা। বিজ্ঞ আদালত মনে করেন যে, অক্ষয় কুমার একজন শিল্পী। সিনেমাটিতে তার নিজের কোনো ব্যক্তিগত মত দেখানো হয় নাই। এমন কোনো কিছু খুঁজে সিনেমায় পাওয়া যায় না যাতে উকিলদের প্রতি অক্ষয় কুমারের কোনো ধরণের অসূয়া প্রকাশ পায়। বরং আলোচ্য নালিশ আমলে নিয়ে শিল্পীর বাক স্বাধীনতা এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতার লংঘন ঘটেছে। উল্লেখ্য ভারতীয় সংবিধোনের ১৯ (১) (এ) অনুচ্ছেদে বাক স্বাধীনতা কে এবং ১৯(১) (জি) অনুচ্ছেদে মত প্রকাশে স্বাধীনতা কে নাগরিকের মত মৌলিক সাংবিধানিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে।
জলি এলএল বি আর জলি এলএলবি -২ সিনেমা দুটিকে ঘিরে এই ভারতীয় সাংবিধানিক আলাপগুলো তুলনামূলক সাংবিধানিক আইনের প্রেক্ষাপটে আমাদের দেশের সাংবিধানিক হাল ফ্যাশনের বাস্তবতায় বিবেচনার দাবী রাখে।
লেখক- অ্যাডভোকেট, কুমিল্লা জজ কোর্ট।