হাসান তারিক পলাশ :
বাংলাদেশের মুসলমানদের পারিবারিক আইনের মুল উৎস পবিত্র কোরান এবং সুন্নাহ। মুসলিমদের পারিবারিক আইনের সকল বিধিবিধান পবিত্র কোরান এবং সুন্নাহ থেকেই নেয়া হয়েছে এবং পরবর্তীতে সেটা রাস্ট্রীয় আইনে “Adopt” করা হয়েছে। মুসলিম পরিবারের বিবাহ, তালাক ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো “মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ ১৯৬১” নামক আইনে রাস্ট্রীয় স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে।
আজ আমরা আলোচনা করব, দেনমোহরের সাথে বিবাহ এবং তালাকের ক্ষেত্রে ইসলামের আইন এবং রাস্ট্রীয় আইনের বিধিনিষেধ নিয়ে।
প্রথমেই বলে নেয়া ভালো, মুসলিম আইনে দেনমোহর বিবাহের একটা গুরুত্বপূর্ণ শর্ত, তালাকের নয়। দেনমোহর প্রদান ইসলামি আইনে “ফরজ” এবং বিবাহের অত্যাবশকীয় শর্ত। এই প্রসঙ্গে পবিত্র কোরানে বলা হচ্ছে…
‘হে নবী! আমি তোমার জন্য বৈধ করেছি তোমার স্ত্রীদেরকে, যাদের দেনমোহর তুমি প্রদান করেছো।’ (সুরা আল-আহজাব, আয়াত-৫০)
অর্থাৎ যেসকল স্ত্রীদের সঠিকভাবে দেনমোহর পরিশোধ করা না হয়, তাদেরকে একজন মুসলিম পুরুষের জন্য “বৈধ” করা হয়নি।.. দেনমোহর পরিশোধ ব্যাতিত স্ত্রী মিলন, ইসলামের চোখে ব্যাভিচার এবং সম্পুর্ন অবৈধ। এই প্রসঙ্গে পবিত্র হাদিসে বলা হচ্ছে….
“যে ব্যক্তি কোনো মেয়েকে দেনমোহর দেওয়ার ওয়াদায় বিয়ে করেছে, কিন্তু তা দেওয়ার ইচ্ছে নেই, সে কিয়ামতের দিন আল্লাহর নিকট ব্যাভিচারী হিসেবে দাঁড়াতে বাধ্য হবে।”- মুসনাদে আহমাদ
অর্থাৎ দেনমোহর পরিশোধ না করে “ছলচাতুরীর আশ্রয়” নিয়ে প্রতারণা করলে, স্ত্রী সহবাস ব্যাভিচার হিসেবে গন্য হবে এবং ব্যভিচারের মাধ্যমে কোন সন্তান জন্ম নিলে সে সন্তানও ধর্মীয় দৃস্টিতে “অবৈধ সন্তান” হিসেবে গন্য হবে।
পবিত্র কোরান এবং হাদিসের উপরোক্ত বিধানই বাংলাদেশের আইন গ্রহণ করেছে। বাংলাদেশে বিবাহ বিচ্ছেদ সংক্রান্ত যেকোনো মামলায় জজ কোর্ট এবং সুপ্রিম কোর্ট সবার আগে নিশ্চিত করেন যে, স্বামী স্ত্রীর প্রাপ্য দেনমোহর পরিশোধ করেছেন।… যদিও দেনমোহর তালাকের কোন শর্ত নয়, এটি বিবাহের প্রাথমিক শর্ত।
দেন-মোহর স্বামীর ঋণ, যা স্বামী তাঁর স্ত্রীকে পরিশোধ করতে বাধ্য। এমনকি স্বামীর মৃত্যুর পরেও স্ত্রী স্বামীর উত্তারাধিকারদের বিরুদ্ধে দেনমোহর পরিশোধের জন্য মামলা দায়ের করতে পারবেন এবং ডিক্রি পাবেন। বাংলাদেশ এবং ভারতে এই সংক্রান্ত প্রচুর মামলা রয়েছে।
“মোজাহেদুল ইসলাম বনাম রওশন আরা (২২ ডি.এল.আর ৬৭৭ পৃষ্ঠা)” মামলায় বলা হয়েছে, দেনমোহর কখনো মাফ হয় না। স্বামী যদি মারাও যায় তার সম্পদ হতে দেনমোহর আদায় করা যাবে। স্বামীর আর্থিক সঙ্গতি না থাকলেও আদালত স্বামীকে দেনমোহরের দায় থেকে মুক্তি দিবে না। মোহরানা একবার নির্ধারিত হয়ে গেলে আর কমানো যায়না তবে স্বামী ইচ্ছা করলে এর পরিমাণ বাড়াতে পারেন।
অনেক সময়ে বিবাহের সময়ে স্ত্রীকে যে উপহার সামগ্রী দেয়া হয়, অনেকে সেটি দেনমোহরের অংশ হিসেবে মিলিয়ে নেন। কিন্তু ইসলামি আইন অনুযায়ী উপহার সামগ্রী কখনো দেনমোহরের অংশ হতে পারবেনা। এমনকি বিবাহ বিচ্ছেদ হলেও উক্ত উপহার সামগ্রী ফিরিয়ে আনা যায়না।… উপহার মানে উপহার। যাকে উপহার দেয়া হয়, দেয়ার সাথে সাথেই সেটি তার নিজস্ব সম্পদে পরিনত হয়। পরবর্তীতে উপহারদাতা বা অন্যকেউ সেটি দাবী করতে পারেন না।
(আ: কাদের বনাম সালিমা, ১৮৮৬, ৮ অল. পৃষ্ঠা-১৪৯) মামলায় সুপ্রিম কোর্ট সিদ্ধান্ত প্রদান করেছেন, “বিয়ের সময় দেয়া শাড়ি, গয়না ইত্যাদি কখনো দেনমোহরের অংশ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে না। অনেক ক্ষেত্রে বিয়ের সময় গয়না, শাড়ি ইত্যাদির মূল্য দেনমোহরের একটি অংশ ধরে ‘উসুল’ লিখে নেয়া হয়। আসলে বিয়েতে দেয়া উপহার বা উপঢৌকন দেনমোহর নয়। এগুলো দেনমোহরের অংশ বলে ধরা যাবে না এবং উসুল বলা যাবে না।”
ইসলামে দেনমোহরকে এতটাই গুরুত্ব দেয়া হয়েছে যে, মদিনায় হিজরতের পরে সাহাবিদের হাতে যখন কোনই টাকা পয়সা ছিলনা, তখন একজন সাহাবীর বিয়ের প্রস্তাব এলে মহানবী হজরত মুহাম্মদ (স) “কোরান শিক্ষাকে” দেনমোহর হিসেবে নির্ধারণ করেছিলেন। এই প্রসংগে পবিত্র হাদিস হল, ‘কোরআনের যা কিছু তোমার জানা আছে, তা স্ত্রীকে শিক্ষা দেবে এর বিনিময়ে আমি মেয়েটিকে তোমার কাছে বিয়ে দিলাম।’ -মুসনাদে আহমদ
দেনমোহর বিষয়ে সমাজে চরম অজ্ঞতা ও উদাসীনতা বিরাজমান। ধর্মকে ভালোবাসেন, নিয়মিত নামাজ-রোজা করেন; এমন অনেক মানুষও মোহরের বিষয়ে সচেতন নন। এ বিষয়ে উদাসীনতা এতটাই প্রকট যে, অনেকে নফল নামাজকে যতটা গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন, মোহর আদায়কে তার সিকিভাগও মনে করেন না। অথচ তা একটি ফরজ বিধান ও বান্দার হক, যা আদায় করা ছাড়া মানুষ প্রকৃত দ্বীনদার হতে পারে না। এজন্য প্রথমে দরকার মোহরের গুরুত্ব উপলব্ধি করা। এরপর তা আদায়ে সচেষ্ট হওয়া।
লেখক- অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট।