নজরুল ইসলাম:
ভোরে জেগে উঠার পর থেকেই নানন রকম শব্দে বাড়িটাকে উল্লাসমুখর করে রাখতো আজমির। বিরতিহীন অর্থহীন কখনো মায়াবী সেসব কথা- সবই অনবদ্য রং দিয়ে তৈরি। তবু সেসবের ভিতর দিয়ে জীবনের অনেক অকথিত আকুতি আর খুশি আজমির ও তার বাবা মারুফ ইসলাম অগোচরে প্রকাশ করে। অদ্ভুতভাবে আদর কাড়তে পারে আজমির। যখন একটানা অনেকক্ষণ ওর গালের সঙ্গে গাল লাগিয়ে ওর ভেতরকার প্রদীপ্ত শিশুটাকে নিজের মধ্যে টেনে নিতে চেষ্টা করে বাবা মারফ ইসলাম, তখন আজমির এমন অপরূপভাবে চুপ করে থাকে যেন গভীর পরিতৃপ্তির সঙ্গে পুরো আদরটুকু পেয়ালেভরে পান করে নিচ্ছে।
সে আদরে আজ ছেদ পড়েছে। বাবা মারুফ ইসলাম আদরের আজমিরকে নিয়ে ছুটছে হসপিটালে। হৃদয়হীন(?) ডাক্তার ইতিমধ্যেই বলে দিয়েছেন আজমির ডান চোখে আর কখনোই দেখতে পাবে না। আহ! কি কষ্টটানাই হয়েছে যখন পাথরটি ছোট আজমিরের নরম চোখে এসে পড়ে। খবরেই প্রকাশ আজমিরকো নিয়ে নীলফামারি থেকে সৈয়দপুর আসার পথে চলন্ত ট্রেনে পাথর ছুঁড়ে মারা হলে তা আজমিরের চোখে এসে লাগে। রক্তে ভেসে যায় ট্রেনের কম্পার্টমেন্ট।
এটা বিচ্ছিন্ন কোন ঘটনা নয়। প্রায়ই চলন্ত ট্রেনে পাথর ছোঁড়ার ঘটনা ঘটছে। এর মধ্যে রেলের টিটিই সহ অনেকে মৃত্যুবরণ করেছে। জীবনের তরে মূল্যবান অঙ্গ হারিয়েছে কতজন তার কোন হিসাব নাই। রাষ্ট্রীয় সম্পদ রেলের সীমাহীন ক্ষতিতো আছেই। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের ঘটতে পারে এমন আশু বর্বতায় আমাদের বেশ উদ্বিগ্ন হতে দেখা যায় অথচ এমন পৈশাচিক আনন্দঘন বর্ববতার কোন বিহিত করতে পারলাম না আজও। সারাদেশে তিন হাজারের উপর রেল- লাইনে তিনশত পঞ্চাশেরও অধিক ট্রেন ও এর যাত্রীরা চলছে এ গুপ্ত আতংককে সঙ্গী করে। বিশেষ করে রাতের আঁধারে ছোঁড়া এ পাথর প্রচন্ড গতি নিয়ে আছড়ে পড়ে নিরীহ যাত্রীদের জীবন- মৃত্যুর সামনে দাঁড় কটিয়ে দিচ্ছে। রেলে না হলেও আমার ব্যাক্তিগত অভিজ্ঞতা- ছোট বেলায় একদা বাসে বড় ভাইয়ের সাথে ভ্রমানকালে এরূপ ছোঁড়া পাথরে আমার মাথা ফেটে চৌচির হয়ে গিয়েছিল। বাতাস ও গাড়ির গতি মিলিয়ে কতটা জোরে এসে এ পাথর পড়ে তা ভুক্তভোগী হওয়ায় বেশ বুঝতে পারি।
রেল আইনের ১২৭ ধারার এ অপরাধের শাস্তি দশ বছর জেল এবং এতে কারো মৃত্যু হলে মৃত্যুদন্ডের বিধান থাকলেও অপরাধিরা ধরা না পড়ায় এ পর্যন্ত এ আইন প্রয়োগের সুযোগ হয়নি ।
অনতিবিলম্বে যাত্রীদের জীবনের নিরাপত্তা বিধান ও চলাচল নির্বিঘ্ন করাসহ রাষ্ট্রেীয় সম্পদের সুরক্ষা নিশ্চিত কল্পে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষকে কাযর্করী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। রেললাইনের ধারে টহলের ব্যবস্থা করা, নিরাপত্তা চৌকি স্থাপন , দূরবর্তী আলোর ব্যবস্থা, রেল লাইনের ধারে বস্তিতে সচেতনতা মূলক কার্যক্রম পরিচালনা সর্র্বোপরি টেলিভিশনে সতর্কবার্তা প্রচারের মাধ্যমে এ জঘন্য অপরাধের লাগাম টানতে হবে এখনই। তবেই আর কোন আজমির পাঁচ বয়সে তার সুন্দর চোখটি হারাবে না বরং সে বাবার কোলে বসে শরতের নির্মেঘ আকাশের অয়ুত লক্ষ তারার পানে চেয়ে রাজকুমারের গল্প বলতে বলতে হৃদয়হরা চোখদুটিতে নামিয়ে আনবে রাজ্যের ঘুম।
লেখকঃ বিচারক, নোয়াখালী।