চৌধুরী তানবীর আহমেদ ছিদ্দিক: গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৯ নাম্বার অনুচ্ছেদে চিন্তা, বিবেক, বাক, ভাব এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে। রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, বিদেশী রাষ্ট্রসমূহের সহিত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, জনশৃঙ্খলা, শালীনতা বা নৈতিকতার স্বার্থে কিংবা আদালত অবমাননা, মানহানি বা অপরাধ সংঘটনের প্ররোচনা সম্পর্কে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ সাপেক্ষেই কেবল উক্ত স্বাধীনতাগুলো একজন নাগরিক উপভোগ করতে পারবেন।
কিন্তু, দৈনন্দিন জীবনে দেখা যায় উপরিউক্ত শর্তগুলো না মেনেই আমরা স্বাধীনতার জন্য গলা ফাটাই। শর্তগুলো মেনে চললে আবার স্বাধীনতার পরিধিটাও যে অনেক কমে যায় তাও কিন্তু অনস্বীকার্য। তাই, Cut you coat, according to your cloth অনুসারে ততটুকুই স্বাধীনতা চর্চা করতে হবে যতটুকু স্বাধীনতা সংবিধান এবং পাশাপাশি অন্যান্য আইনগুলো দিচ্ছে। কিন্তু আমরা যারা স্বাধীনতার পরিধি অতিক্রম করে মুক্ত চিন্তার চর্চা করার নামে স্বাধীনতা চর্চা করি, তারা তখন বিভিন্ন আইন ভঙ্গ করছি এবং হয়ে যাচ্ছি অপরাধী যেসব অপরাধের শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড পর্যন্ত;এমনি একটি অপরাধ হচ্ছে রাষ্ট্রদ্রোহিতা। কেবল কিছু শব্দ বলে, লিখে বা প্রতীকের মাধ্যমে যদি এমন কোন অপরাধ হয় এবং যার শাস্তি যাবজ্জীবন পর্যন্ত হতে পারে, তবে সেই কিছু শব্দ বলার বা লিখার পূর্বে আমাদেরকে অবশ্যই রাষ্ট্রদ্রোহিতা সম্বন্ধে পরিপূর্ণ জ্ঞান অর্জন বাঞ্ছনীয়।
রাষ্ট্রদ্রোহিতা সম্বন্ধে জানার আগে, রাষ্ট্রদ্রোহিতা আমাদের আইনে কীভাবে এলো, তার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস জানা যাক। ভারতীয় উপমহাদেশকে শাসনের উদ্দেশ্যে ব্রিটিশরা প্রথমেই দণ্ডবিধি তৈরি করে, ১৮৬০ সালে। সেই আইনটির নাম ছিল ভারতীয় দণ্ডবিধি ১৮৬০ যাতে এই রাষ্ট্রদ্রোহিতার ধারাটি ছিল না। কেন ছিল তা স্পষ্ট নয়, হয়ত রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কোন আন্দোলন হতে পারে তা ব্রিটিশ আইনপ্রণেতাদের মাথায় ছিল না।
কিন্তু ক্রমেই যখন দুই একটি ঘটনায় রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ঘটতে লাগল তখনই আইনটি সংশোধনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়, যার ফলশ্রুতিতে প্রথমে ১৮৭০ সালে এবং পরে আবার ১৮৯৮ সালে দণ্ডবিধি সংশোধন হয় এবং তখনই এই ধারাটি যোগ করা হয়।
যখন একজন লোক তার কথায় বা তার কোন লেখায় বা তার দ্বারা ব্যবহিত কোন প্রতীক/ইঙ্গিত/চিহ্ন দ্বারা সরকারের বিরুদ্ধে ঘৃণা, বিদ্বেষ বা বৈরিতা সৃষ্টি করে বা করার উদ্যোগ গ্রহণ করে অর্থাৎ চেষ্টা করে তখন সেই লোক রাষ্ট্রদ্রোহিতা করেছে বলে আইনত ধরে নেওয়া হবে। আর কোন ব্যক্তি রাষ্ট্রদ্রোহিতা করেছেন বলে প্রমাণিত হলে তার শাস্তি যাবজ্জীবন বা এমন যেকোনো নিম্ন মেয়াদের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবে যার সঙ্গে জরিমানা যোগ করা যেতে পারে বা এমন কারাদণ্ড যা তিন বছর পর্যন্ত হতে পারে এবং সাথে জরিমানা যোগ করা যেতে পারে বা জরিমানা দণ্ডে দণ্ডিত করা হবে। দণ্ডবিধির ধারা ১২৪ক তে রাষ্ট্রদ্রোহিতা সম্বন্ধে ঠিক এইভাবেই বলা আছে। তবে উক্ত ধারায় সরকার বলতে আইনবলে সরকারকে বুঝানো হয়েছে। অর্থাৎ বাংলাদেশের আইনবলে প্রতিষ্ঠিত সরকার।
ধারা ১২৪ক তে তিনটি ব্যাখ্যা রয়েছে, যাতে বিদ্বেষের সংজ্ঞায় অনানুগত্য ও সর্বপ্রকারের শত্রুতারভাবকে সংযুক্ত করা হয়েছে। পাশাপাশি আইনসম্মত উপায়ে সরকারী ব্যবস্থাদির পরিবর্তন আনয়নকল্পে সরকারী ব্যবস্থা ও সরকারের প্রশাসনিক বা অপরবিধ ব্যবস্থা অসমর্থনমূলক অভিমত বা মন্তব্য করলে তা রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হবে না। তবে শর্ত হচ্ছে, ঘৃণা, বিদ্বেষ বা বৈরিতা তৈরির কোন চেষ্টা থাকতে পারবে না।ধারা ১২৪ক তে অপরাধের ধরন এবং শাস্তির মাত্রা দেওয়া থাকলেও সাধারন জনগণের পক্ষে রাষ্ট্রদ্রোহিতা সম্বন্ধে পরিপূর্ণ ধারণা পোষণ করা কষ্টসাধ্য। কেননা, এখানে কেবল সরকারের বিরুদ্ধে ঘৃণা, বিদ্বেষ বা বৈরিতার কথা বলা আছে, যা কিনা স্পষ্ট করে বলে দেওয়া নেই যা পড়ে সাধারন জনগণ অপরাধটাকে আঁচ করতে পারে।
ঠিক কোন কাজ গুলো ঘৃণা, কোন কাজে বিদ্বেষ প্রকাশ প্রায় অথবা বৈরিতাও বা কীভাবে কথা কিংবা লেখায় সরকারকে আঘাত করে, এই বিষয়গুলো অনেকাংশেই অস্পষ্ট। আইনতত্ত্ব অনুসারে, ফৌজদারি আইন হতে হবে সুনির্দিষ্ট এবং বোধগম্য, যাতে সাধারন জনগণ কোন প্রকার জটিলতা ছাড়াই অপরাধের ধরন বুঝতে পারে এবং তা থেকে দূরে সরে থাকতে পারে। কিন্তু আইন যখন অস্পষ্ট হয় তখন মানুষ অপরাধের মাত্রা ধরতে ব্যর্থ হয় এবং নিজের অজান্তেই অপরাধ করে বসে। যেমন ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনে, যেখানে অপরাধের ধরন ঠিক আছে কিন্তু মাত্রা অস্পষ্ট, রেঞ্জ না বুঝতে পারলে মানুষ যেমন সচেতনতা অবলম্বন করতে পারে না ঠিক একইসময়ে ভীতিতে থাকে।
অপরাধ বিজ্ঞানে আমরা যতগুলো কারণ দেখি অপরাধীর অপরাধ করার, তার মধ্যে এই একটি কারণও কিন্তু নীরবে উপস্থিত। আইন যখন অপরাধের রেঞ্জ বেঁধে দিতে ব্যর্থ, তখন একে যেমন কিছু লোক না বুঝে অপরাধ করবে, অন্য দিকে কিছু লোক ভীতিতে থাকবে এবং সবচেয়ে বড় সমস্যা করবে এক শ্রেণীর সুবিধাবাদী যারা প্রতিনিয়ত আইনের ফাঁকফোকরকে পুঁজি করে রাজনীতি করে।
রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলার সবচেয়ে বড় অধ্যায় হচ্ছে এই রাজনীতি রাষ্ট্রদ্রোহিতাকে যদি আমরা ব্যবসা শিক্ষার দৃষ্টিকোণ থেকে পণ্য মনে করি, তবে এর সবচেয়ে বড় মার্কেট হচ্ছে রাজনীতি। দণ্ডবিধি যেহেতু আমাদের উপমহাদেশের তিন দেশেই প্রায় একই, সেহেতু উপমহাদেশের রাজনীতির ইতিহাস নিয়ে পড়াশুনা করলেই দেখা যাবে যে, রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যেই সবচেয়ে বেশী বার ব্যবহৃত হয়েছে।
সুতরাং বলা যায়, রাজনীতির দাবা ঘরের সবচেয়ে বেশী ব্যবহৃত গুঁটি হয়ত এই রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা। তবে সব মামলাই যে মিথ্যে মামলা বা সবাই যে নির্দোষ তা কিন্তু নয়। অপরাধীকে শাস্তি পেতেই হবে এবং নির্দোষকে কোন প্রকার হেনস্তা করা যাবে না এটাই হচ্ছে আইনের ধর্ম। তাই আইন পড়ে জানতে হবে কি করা যাবে এবং কি করা যাবে না।
যেহেতু আমাদের দণ্ডবিধির ১২৪ক ধারায় অপরাধের মাত্রা সম্বন্ধে কিছু স্পষ্ট করে বলা নাই, তাই আমরা কেস স্টাডি করেই এর সমাধানের পথে হাঁটলে কিছুটা উপলব্ধি করা যাবে যে, কি কি বললে বা লিখলে বা কি ধরনের চিহ্ন বা প্রতীক প্রকাশ করলে রাষ্ট্রদ্রোহিতা হবে এবং কি কি করলে রাষ্ট্রদ্রোহিতা হবে না।
প্রথমেই জানা দরকার, সরকার বলতে কাকে বুঝাচ্ছে, দণ্ডবিধির ধারা ১৭ অনুসারে সরকার বলতে বুঝায় বাংলাদেশ বা এর কোন অংশে কার্যনির্বাহী সরকার পরিচালনা করার জন্য আইন মোতাবেক কর্তৃত্বপ্রদত্ত ব্যক্তি বা ব্যক্তিবৃন্দ। এর মানে হচ্ছে শুধু সরকার পরিচালনার জন্য এবং তা আইন মোতাবেক। তবে ১৯৫৪
সালের জেড এ সুল্লেরি বনাম ক্রাউন মামলার রায়ে বলা হয়, ‘মন্ত্রীগণ সরকার গঠন করেন বটে কিন্তু তারাই সরকার নয়’। সুতরাং, কোন মন্ত্রীকে সমালোচনা করে লোকচক্ষে তাকে হেয় প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করা মানহানিজনক হতে পারে কিন্তু রাষ্ট্রদ্রোহিতা নয়। মন্ত্রী সম্বন্ধে উল্লেখ করলে তা সরকার সম্বন্ধে উল্লেখ বুঝায় না। মন্ত্রিত্ব ছাড়াও মন্ত্রীর অন্য পরিচয় আছে। মন্ত্রীকে ব্যক্তিগতভাবে কিংবা তার অন্য পরিচয়ে আঘাত করলে তাদ্বারা সরকার আহত হন না। অর্থাৎ, মন্ত্রীর বিরুদ্ধে মানহানি হবে, রাষ্ট্রদ্রোহিতা নয়। তবে পুলিশের বিরুদ্ধে বললে বা লিখলে রাষ্ট্রদ্রোহিতা হতে পারে। ১৯২৯ সালের কলকাতার এক মামলা অনুসারে, পুলিশকে আক্রমণ করে যে প্রবন্ধ লেখা হয় তা দণ্ডবিধির ১২৪ক ধারার আওতায় পড়ে। কারণ পুলিশের মাধ্যমে সরকার তার কাজ পরিচালনা করে। সুতরাং, পুলিশ সরকারের সংজ্ঞার আওতাভুক্ত।
ঘৃণা, বিদ্বেষ এবং বৈরিতা বাদ দিয়ে সরকারের সমালোচনা করা একেবারেই যৌক্তিক এবং আইনেও এর কোন বাধা নেই। আপনি বাংলাদেশ ক্রিকেটের কোন খেলোয়াড়ের খেলার সমালোচনা করে কিছু বলেছেন সেটাকে খুঁটিয়ে দেখলেই বুঝা যায় আপনার কথায় বা লিখায়ই গঠনমূলক সমালোচনা ছিল নাকি ঘৃণা, বিদ্বেষ এবং বৈরিতা ছিল। আপনি সরকারের গঠনমূলক সমালোচনা করতেই পারেন, কেননা গঠনমূলক সমালোচনাই গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি।
PLD 1958 (Pesh) 15 মতে ‘সরকারের সমালোচনা গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি হলেও সমালোচনা অবশ্যই গঠনমূলক হতে হবে’। আবার, AIR 1941 (All) 156 মামলায় বলা হয়েছে, ‘সরকারের কোন কাজকে সদবিশ্বাসে সমালোচনা করা যদি দ্রোহিতা হয় তবে সরকারের মানহানিজনক কোন কথা বললেই তা দ্রোহিতা হয়ে যায়। তাই, ১২৪ক ধারার সংকীর্ণ অর্থই গ্রহণযোগ্য, অন্যথায় সরকারের যথাযথ সমালোচনার পথও রুদ্ধ হয়ে যেতে পারে’। অর্থাৎ, রাষ্ট্রদ্রোহিতা অপরাধটির রেঞ্জ এত বড় করে দেখা দরকার নেই, যার ফলে যথাযথ সমালোচনার পথই বন্ধ হয়ে যায়। সরকারকে সমালোচনার মুখোমুখি করার পথে রাষ্ট্রদ্রোহিতা যাতে বাঁধা না হয়ে দাঁড়ায় তারই ইঙ্গিত এই মামলায় পাওয়া গেছে। 26 DLR 87 মামলায় আরও স্পষ্ট করে বলে দেওয়া হয়েছে, ‘সরকারের উপর জনকল্যাণমূলক কর্মের কর্তব্য ন্যস্ত হয়েছে। সরকার এ কর্তব্য পালনে ব্যর্থ হলে বিরোধী দলের তিরস্কার সহ্য করার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকতে হবে’।
আরেক মামলা PLD 1967 (Sc) 78 তে ‘কঠিন ভাষায় সরকারকে সমালোচনা করলেই তা অপরাধ হয় না। যখন লিখিত কিংবা উচ্চারিত কথা বিশৃঙ্খলার উদ্ভব করে তখনই কেবল আইন তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়’।
অর্থাৎ, সমালোচনা করার লাইসেন্স আছে, কিন্তু তার মানে এই নয় যে আপনি বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করবেন। সরকারের বিরুদ্ধে জনগণকে খেপিয়ে দেওয়া কোন মতেই শৃঙ্খলাধর্মী কার্যক্রম নয়। সরকার গঠনই হয় জনগণের ভোটে, সেখানে সরকারের বিরুদ্ধে জনগণকে উস্কে দেওয়া, জনগণের মনে সরকারের প্রতি বিদ্বেষ তৈরি করে দেওয়াও জন বিশৃঙ্খলা।
PLD 1965 (Dhaka) 478 মামলার রায়ে বলা হয়, ‘বিদ্বেষ অর্থে অনানুগত্য ও শত্রুতামূলক ভাব বুঝায়। সরকারকে শত্রু ভাবতে প্ররোচনা দেওয়াই বিদ্বেষমূলক কাজ মানুষের ভিতর সরকারের বিরুদ্ধে শত্রুতার ভাব জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করাই রাষ্ট্রদ্রোহিতা’।
বক্তৃতার বিষয়বস্তু সত্য কিনা তা অপ্রাসঙ্গিক, শ্রোতাদের মনে সরকারের প্রতি বিদ্রোহভাব জাগ্রত হয়েছিল কিনা তা বিবেচ্য বিষয়। সরকারের কঠোর সমালোচনা নিষিদ্ধ না হলেও তা গঠনমূলকভাবে প্রকাশ করতে হয়। বক্তৃতার মাধ্যমে সরকারের বিরুদ্ধে হিংসা জাগ্রত করা অপরাধ। -19 DLR (SC) 185;
আমরা জানি সত্য কিছু বললে মানহানি হয় না, তবে এই রায়ের ভিত্তিতে বলা যায় বক্তব্য সত্য হলেও তা রাষ্ট্রদ্রোহিতা হবে। এই থেকে উপলব্ধি করা যায় যে, সত্য-মিথ্যা মূল বিষয় নয়, মূল বিষয় হচ্ছে সরকারের বিরুদ্ধে হিংসা, ঘৃণা, বিদ্বেষ, বৈরিতা সৃষ্টি করে এমন কোন কিছুই করা যাবে না।
তবে, রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলাসহ যেকোনো মামলায় অপরাধীকে শাস্তি দেওয়া সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হচ্ছে, অপরাধীর ইচ্ছে ছিল কিনা তা প্রমাণ করা। সরকারের প্রতি ঘৃণা, বিদ্বেষ বা বৈরিতা সৃষ্টি করা বা সৃষ্টির চেষ্টা করার কোন অভিপ্রায় বা ইচ্ছা না থেকে থাকলে, কোন ব্যক্তি যাই বলুক না কেন তা রাষ্ট্রদ্রোহিতার মধ্যে পড়বে না।
PLD 1954 (Sind) 80 মামলায় ‘দ্রোহিতার মূল কথা হচ্ছে অভিপ্রায়। কোন অভিপ্রায়ে বক্তব্য রাখা হচ্ছে তাই বিবেচ্য। তবে বক্তার অভিপ্রায় বক্তব্যের ভাষা হতে গ্রহণ করতে হয়। যে বক্তব্য জনগণকে প্রতিষ্ঠিত সরকারের স্বীকৃতি না দিয়ে সংবিধান বহির্ভূত পদ্ধতি গ্রহণ করতে উত্তেজিত করে সে বক্তব্য রাষ্ট্রদ্রোহিতার উপাদানসমূহ যেমন বিদ্বেষ, ঘৃণা কিংবা অবজ্ঞার পর্যায়ে পড়ে’। আবার, PLD 1958 (Pesh) 15 মামলায়, ‘কোন লোক যদি সরকারের বিরুদ্ধে ঘৃণা কিংবা অবজ্ঞার ভাব মনের ভিতর পোষণ করে তবে আইন তাকে কিছু করতে পারে না। কিন্তু তিনি যখন অন্যের ভিতর তার এ মনোভাব ছড়াতে শুরু করেন তখন এ আইনের আমলে এসে যায়। যে শব্দ সরকারকে তার কার্য সম্পাদনে দুর্নীতিপূর্ণ কিংবা হিংসাত্নক আখ্যা দেয়, সে শব্দাগুলি ঘৃণা ও অবজ্ঞার উদ্ভব করে’।
এ থেকে উপলব্ধি করা যায়, যখনই সরকারের প্রতি ঘৃণা, বিদ্বেষ ছড়িয়ে দেওয়া হয়, তখনই রাষ্ট্রে এক ধরণের বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়। তাই এই ধরণের কার্যকলাপকেই রাষ্ট্রদ্রোহিতা নামে আখ্যায়িত করা হয়েছে। রাষ্ট্র একটা বিশাল জনগোষ্ঠীকে একসাথে একটি পরিবারের মত করে রাখার সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছে, অথচ সেই রাষ্ট্রে বসে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বক্তব্য দেওয়া এবং তার ফলশ্রুতিতে রাষ্ট্রে জনবিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করা, যে মায়ের দুধ খেয়ে বড় হয়েছে সেই মায়ের বুকে লাথি মারার সমতুল্য। তাই, রাষ্ট্রদ্রোহিতার শাস্তি হওয়া অবশ্যম্ভাবী।
রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলায় সংবাদপত্র সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ বিশেষ করে সাংবাদিকরাই বেশী অভিযুক্ত হতে দেখা যায়। এর কারণও অবশ্য আছে, একজন সাধারন নাগরিক সরকারের বিরুদ্ধে একা বলে লিখে যতটা না ঘৃণা, বিদ্বেষ বা বৈরিতা সৃষ্টি করতে পারে, তারচেয়ে হাজার গুণ বেশী ঘৃণা সৃষ্টি করতে পারেন একজন সাংবাদিক। কেননা, একজন সাংবাদিকের একটি রিপোর্টই পড়ে থাকে প্রায় লক্ষাধিক মানুষ। ফলে, ঘৃণার স্রোত খুব দ্রুতই বইবে তাই স্বাভাবিক। মানুষ মাত্রই ভুল, তবে যে ভুলে রাষ্ট্রের জনশৃঙ্খলার বিঘ্ন ঘটে তা নিশ্চয়ই সমালোচিত হবে তাই স্বাভাবিক। তাছাড়া, মিডিয়াকে এখন আনঅফিসিয়ালি রাষ্ট্রের চতুর্থ অর্গান বলা হয়ে থাকে। সুতরাং, মিডিয়া কভারেজের সময় মাথায় রাখতে হবে মিডিয়াকে ততটাই দায়িত্বশীল হতে হবে যতটা বাকি তিনটি অর্গান করে আসছে। তবে, একটি পরিপূর্ণ গঠনমূলক সমালোচনা একটি সরকারকে যত না বিপদে ফেলে তারচেয়ে বেশী সঠিক পথে চলতে শেখায়। যার সমালোচক নেই, তার যেমন নেই নিখুঁত গন্তব্য, তেমনি নেই পথচলায় আনন্দ। তাই, সমালোচনা থেকে নিজের ভুল শিখে নিতে হবে পাশাপাশি সমালোচনাকে তিরস্কার না ভেবে বরং যেই কাজ হচ্ছে তার স্বীকৃতি দেওয়া এবং কিছু ত্রুটি ধরিয়ে দেওয়া হচ্ছে বলে ধরে নিতে হবে। তাই, সবশেষে খেয়াল রাখতে হবে যাতে কোন ব্যক্তির বক্তব্যকে বিকৃত করা না হয়। তার অভিপ্রায় বিচার বিশ্লেষণ করে দেখা উচিত যাতে কোন নির্দোষ ব্যক্তি এমন কোন কঠিন অপরাধে ফেঁসে না যায়।
PLD 1967 (SC) 78 মামলার রায়ে বলা হয়েছে যে, ‘যে বক্তৃতা দ্রোহমূলক বলে অভিযুক্ত হয়েছে, সে বক্তৃতাটি সম্পূর্ণভাবে পড়ে তবে তৎসম্পর্কে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হয়। অংশ বিশেষ পড়ে বক্তার অভিপ্রায় উদ্ধার করা যায় না। বক্তৃতার কিছু অংশ নিরীহ বলে সামগ্রিকভাবে তা আপত্তিজনক হতে পারে। যে সময় ও যে জায়গায় বক্তৃতা দেয়া হয়েছিল, এসব পরিস্থিতি বিবেচনা করতে হবে’।
শেষ করার আগে আরও একবার আইন প্রণেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি, যাতে এই ধারাটি আরও সংশোধন করে সুনির্দিষ্ট করা হয়। AIR 1962 (SC) 655 কেসের রায় পড়লেই আমরা বুঝতে পারি রাষ্ট্রদ্রোহিতার পরিধি সত্যিকার অর্থে অনেক ছোট। অর্থাৎ রাষ্ট্রদ্রোহিতা একটি গুরুতর অপরাধ এবং সেটা সরাসরি সরকারের ক্ষমতার সাথে সম্পৃক্ত।
উক্ত মামলার রায়ে বলা হয়েছে, ‘সরকারের পতন ঘটানো কিংবা অবৈধ পন্থায় সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার যে পরিকল্পনা তা ১২৪ক ধারা মোতাবেক অপরাধ বলে বিবেচিত হবে’। এই থেকে বুঝা যায়, রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা করার আগে একটু যত্নসহকারে দেখা দরকার অভিযুক্ত ব্যক্তির কর্মকাণ্ডে সরকার পতনের ষড়যন্ত্র রয়েছে কিনা।
লেখক: আইন বিষয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তরসম্পন্ন