সিরাজ প্রামাণিক: আপনি তালাক দিয়েছেন, ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশের ৭(১) ধারা মোতাবেক তালাক গ্রহীতাকে তালাকের নোটিশ পাঠিয়েছেন কিন্তু তিনি নোটিশ গ্রহণ করেননি। দুশ্চিন্তার কারণ নেই। আপনার দেয়া তালাক কার্যকর হবে। আপনার দায়িত্ব নিয়ম মেনে সঠিক ঠিকানায় তালাকের নোটিশ পাঠানো। বাকী কাজ আইন অনুযায়ী আপনা আপনিই কার্যকর হয়ে যাবে।
তালাকের নোটিশ প্রেরণের উপায়
আপনি দু’টি উপায়ে স্ব-স্ব ব্যক্তির কাছে তালাকের নোটিশ পাঠাতে পারেন।
১। সরাসরি তালাকের নোটিশ সংশ্লিষ্ট চেয়ারম্যান/মেয়র এবং তালাক গ্রহীতার নিকট পৌঁছে দিয়ে আরেকটি রিসিভ কপিতে স্বাক্ষর করিয়ে নিতে পারেন, এবং
২। সরকারী ডাক যোগে অর্থাৎ পোষ্ট অফিসের মাধ্যমে প্রাপ্তিস্বীকার সহ (এডি) সহযোগে রেজিস্ট্রি করে চিঠি সংশ্লিষ্ট ঠিকানায় পাঠাতে পারেন। এতে সুবিধা বেশী এবং আইনী জটিলতা কম। কারণ সংশ্লিষ্ট ঠিকানায় চেয়ারম্যান বা মেয়র চিঠি গ্রহণের পর প্রাপ্তি স্বীকার (এডি) ডকুমেন্টস আপনার ঠিকানায় আপনার নিকট ফিরে আসে।
মনে রাখবেন চেয়ারম্যান বা মেয়র মহোদয় সব ধরণের চিঠি গ্রহণ করে থাকে। আপনি পোষ্ট অফিসের মাধ্যমে নিয়ম মেনে তালাকের নোটিশ পাঠালে তালাক গ্রহীতা নোটিশ গ্রহণ না করলে তাহলে কেন গ্রহণ করেননি তা পোষ্ট অফিসের মন্তব্য সম্বলিত নোটিশটি আপনার নিকট ফেরত আসবে। যেমন চিঠির খামের উপর লেখা থাকে ‘প্রাপক চিঠি গ্রহণ না করায় ফেরত’ অথবা ‘গ্রহণে অস্বীকৃতি’ অথবা ‘খুঁজে পাওয়া গেল না’ কিংবা ‘এ ঠিকানায় পাওয়া গেল না’-কৌশলে এমন মন্তব্য কথাগুলো লেখা থাকে। যেদিন চিঠিখানা আপনার নিকট ফিরে আসবে, সেদিন থেকে ৯০ দিন পার হলে তালাক আপনা আপনিই কার্যকর হয়ে যাবে। অনেকে নোটিশ গ্রহণ না করে চিঠি সম্পর্কে অবগত হয়েও মিথ্যা বলে থাকে যে তালাকের নোটিশ পায়নি কিংবা নোটিশ স্বাক্ষর করিনি। তারা নিছক বোকার মতো কাজ করে থাকে।
General Clauses Act 1897 এ Legal Benefit of Registered Post সম্পর্কে ২৭ ধারায় বলা হয়েছে যে, if any person under any act serve any document by registered post where the proper procedure and processes is maintained, the post shall deemed to be served on due time. যার বাংলা অর্থ আপনি সঠিক ঠিকানায় রেজিষ্ট্রি ডাক যোগে সঠিক নিয়ম মেনে চিঠি পাঠালেই প্রাপকের উপর উক্ত চিঠি যথাসময় জারি হয়েছে বলে গণ্য হবে।
তালাকের নোটিশ একটিই যথেষ্ট
অনেকে আবার প্রশ্ন করে থাকে তালাকের কয়টি নোটিশ পাঠাতে হয়, একটি, দুটি না তিনটি। অনেকে বলে তিন মাসে তিনিটি নোটিশ পাঠাতে হয়। প্রকৃতপক্ষে তালাকের একটি নোটিশ একবারই উপরোক্ত নিয়ম মেনে পাঠাতে হয়। যেকোনো যুক্তিসংগত কারণে মুসলিম স্বামী বা স্ত্রী একে অপরকে তালাক প্রদান করতে পারেন। ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশের ৭(১) ধারা অনুযায়ী, আপনি তালাক দিতে চাইলে, তালাকের নোটিশ নিজেই তৈরী করে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব যাকে তালাক দিচ্ছেন তিনি যদি ইউনিয়ন পরিষদ এলাকায় বসবাস করেন, তাহলে সেই ইউপি চেয়ারম্যানকে উক্ত তালাকের নোটিশ দিতে হবে। আর তিনি যদি পৌরসভা বা সিটি কর্পোরেশন এলাকায় বসবাস করেন তাহলে পৌরসভা বা সিটি করপোরেশনের মেয়রের কাছে লিখিত নোটিশ পাঠাতে হবে। ওই একই নোটিশের কপি যাকে তালাক দিচ্ছেন অর্থাৎ তালাক গ্রহীতাকে পাঠাতে হবে। আর মনে রাখবেন, তালাকের নোটিশে দুজন উপযুক্ত সাক্ষীর কলাম রাখবেন এবং তাদের স্বাক্ষর নেবেন।
তালাক নিয়ে ভ্রান্ত ধারণা
অনেকেই মনে করেন তালাকের নোটিশ কাজির মাধ্যমে না পাঠালে তা কার্যকর হয় না। এটি ভুল ধারণা। তালাকের নোটিশ স্বামী বা স্ত্রী নিজে লিখিত আকারে পাঠিয়ে দিলেই হবে। ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশে তালাকের নোটিশ পাঠাতে কাজীর কাছে যেতে হবে-এমন কোন কথা লেখা নেই। ফলে নোটিশ প্রাপ্তির ৯০ দিন পার হলেই তালাক কার্যকর হয়ে যায়। তবে স্ত্রী গর্ভবতী থাকলে গর্ভকাল শেষ হওয়ার পর তালাক কার্যকর হবে।
এরপর আপনি ইচ্ছে করলে তালাক রেজিস্ট্রি করিয়ে নিতে পারেন। তবে আনন্দের সংবাদ এই যে, বিয়ে রেজিস্ট্রি না করলে যেমন শাস্তির ব্যবস্থা রয়েছে, এক্ষেত্রে তালাক রেজিস্ট্রি বাধ্যতামূলক কিংবা শাস্তির কোন ব্যবস্থা রাখা হয়নি। কাজেই নিয়ম মেনে তালাকের নোটিশ পাঠানো ও উক্ত ডকুমেন্টসগুলো সংগ্রহে রাখলেই তালাক কার্যকরে আইনত কোন বাধা নেই।
নোটিশ পাঠালেই তালাক কার্যকর হয় না
আরেকটি বিষয় আপনাদের জানিয়ে রাখি, নোটিশ পাঠালেই কিন্তু তালাক কার্যকর হয়ে যায় না। নোটিশ পাঠানোর পরে ৯০ দিন পার হওয়ার আগেই যদি আপনাদের মধ্যে ভুল বুঝাবুঝির অবসান হয়, তাহলে আপনি একই নিয়ম অনুসরণ করে তালাক প্রত্যাহার করে নিতে পারেন এবং একই স্ত্রীর সাথে হিল্লা বিয়ে বাদেই ঘর সংসার করতে পারেন, এতে আইন ও ধর্মের কোথাও বাঁধা নেই। আর যদি ৯০ দিন অতিক্রান্ত এমনকি কয়েক বছর পার হয়ে যাওয়ার পরও আপোষ হয়ে যায়, তাতেও একই স্বামী স্ত্রীর মধ্যে ঘর সংসারে আইনে বাঁধা নেই। এক্ষেত্রে শুধু ব্যতিক্রম রয়েছে যে, পুনরায় বিয়ে করে নিতে হবে।
লেখক: বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী, আইনগ্রন্থ প্রণেতা ও আইন গবেষক।