পঞ্চগড়ে তিন ছেলের নামে আদালতে মামলা করেছেন মা। অভিযোগ, ছেলেরা তার দোকানঘর অন্যের নিকট ভাড়া দিয়ে টাকা তুলে নেয়। তাঁকে টাকা দেয় না। অন্যদিকে আদালতে মামলার শুনানিতে ছেলেদের দাবি, দোকান ঘরটি তারা অন্যের নিকট ভাড়া দেয়নি। বোনের চক্রান্তে মামলা করছেন তাদের মা।
উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সন্দেহ দূর করতে আদালতের বিচারকাজ মুলতবি করে বিচারক নিজেই সরজমিনে দোকানটি দেখতে চলে গেলেন। স্বচক্ষে ঘটনাস্থল পরিদর্শন ও আশপাশের সব দোকানদারের সঙ্গে কথা বলে বিচারক বুঝতে পারেন বিবাদীরা মিথ্যা বলছেন না। এরপর নিলেন অসাধারণ সিদ্ধান্ত।
এজলাসে ফিরে এসে বিচারক মায়ের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব নিতে বলেন তিন ছেলেকে। লিখিত অঙ্গীকারনামায় প্রতিমাসে চার হাজার টাকা করে দিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয় তারা। অবশেষে বিচারকের মধ্যস্থতায় মা ও তিন ছেলের দ্বন্দ্ব নিরসন হয়। আবেগাপ্লুত মা কাঁদতে কাঁদতে একসময় হেসে ফেলেন। তিন ছেলেকে বুকে টেনে জড়িয়ে ধরেন। এরপর ছোট ছেলের কোলে চড়ে খুশি মনে এসলাস ত্যাগ করেন মা।
আজ বুধবার (২৬ জানুয়ারি) পঞ্চগড়ের অতিরিক্ত চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বিচারক যুগ্ম জেলা ও দায়রা জজ মো. মতিউর রহমানের আদালতে আবেগঘন এমন ঘটনা ঘটেছে।
আদালত সূত্রে জানা গেছে, আপন তিন ছেলের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন মা। বাদীর নাম সুলতানা রাজিয়া। মামলায় তাঁর অভিযোগ, ছেলেরা তার দোকানঘর অন্যের নিকট ভাড়া দিয়ে টাকা তুলে নেয়। তাঁকে টাকা দেয় না। মূল ঘটনা এটুকু হলেও মামলার আরজিতে অতিরঞ্জিত অনেক কথা লেখা আছে।
অন্যদিকে মামলার বিবাদী তিন ভাইয়ের আদালতে দেওয়া বক্তব্য হল, দোকান ঘরটি তারা অন্যের নিকট ভাড়া দেয়নি। বড় ভাই তৈমুর অনেক গরীব। তার দু’টি ছেলে প্রতিবন্ধী হওয়ায় তৈমুর ইসলাম সেখানে ছবি বাঁধাইয়ের কাজ করে দিন চালায়। তাদের বোনের চক্রান্তের মা এই মামলা করেছে মর্মে তারা দাবি করে। কিন্তু মা এই কথা কিছুতেই বিশ্বাস করতে চায় না। কখনো কখনো বলে ছেলেরা দোকানটি বিক্রি করে দিয়েছে।
ঘটনাস্থল আদালত থেকে খুব বেশি দূরে নয়। পঞ্চগড় শহরের কদম তলায়। আদালত মুলতবি করে দোকানটি দেখতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন বিচারক। সরেজমিনে দেখে বিষয়টি পরিষ্কার বুঝতে পারেন বিচারক। দোকানটি পরিদর্শন করে বিচারক নিশ্চিত হন বাদীর বড় ছেলে তৈমুর সেখানে ছবি বাঁধাইয়ের কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করছে। আশেপাশের সব দোকানদারও একই কথা বলে। নিজের চোখে দোকানটি দেখেন বিচারক। দোকান নিয়ে মামলা দায়েরকারির অহেতুক দুশ্চিন্তাও দূর হয়।
এজলাসে ফিরে এসে মায়ের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব নিতে তিন ছেলেকে বলেন বিচারক মতিউর রহমান। ছেলেরা রাজি হয়। এরপর লিখিত অঙ্গীকারনামায় প্রতিমাসে চার হাজার টাকা করে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়।
বিচারক এখানে ক্ষান্ত হলেন না। পারিবারিক বন্ধনের দৃঢ়টা যাচাইয়ে তিন ছেলে দিলেন পরীক্ষা। মাকে কোলে নেওয়ার জন্য তিন ছেলের মধ্যে কে শক্তিশালী তার প্রমাণ দিতে হবে। পরীক্ষায় বাদীর ছোট ছেলে শামীম মাকে কোলে নেয় আদালতেই। আবেগাপ্লুত মা কাঁদতে কাঁদতে একসময় হেসে ফেলেন। তিন ছেলেকে বুকে টেনে জড়িয়ে ধরে। শেষে ছেলের কোলে চড়েই আদালত ছেড়ে চলে যায়।
প্রসঙ্গত, বিচারক মো. মতিউর রহমানের এমন ব্যতিক্রমী উদ্যোগ এটাই প্রথম নয়। পারিবারিক কলহের জেরে এর আগেও তাঁর মধ্যস্থতায় পুনরায় সংসার শুরু করেছেন একাধিক বিচারপ্রার্থী। বিচারকাজে আইনের মধ্যে থেকে দ্বন্দ্ব নিরসনে পারিবারিক মূল্যবোধকে তিনি সর্বাগ্রে প্রাধান্য দিয়ে থাকেন। তাঁর এমন কার্যকলাপ প্রশংসিত হয়েছে বিচারপ্রার্থী, বিচার সংশ্লিষ্ট সহ সর্বসাধারণের কাছে।