জয়পুরহাটে প্রায় ২৯ লাখ ৮ হাজার টাকা সোনালী ব্যাংকে জমা দেওয়ার পৃথক দুটি ভুয়া চালান দাখিল করে দুটি চেক প্রত্যাখ্যান মামলার দুই আসামির আদালত থেকে জামিন নেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। গত নভেম্বর মাসে অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ এবং দ্বিতীয় যুগ্ম জেলা ও দায়রা জজ আদালত থেকে জামিন পান এ দুই আসামি। এ ঘটনার প্রায় আড়াই মাস পর চলতি জানুয়ারি মাসে ঘটনাটি ধরা পড়ে। জালিয়াতির এ ঘটনায় চারজনের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন সংশ্লিষ্ট আদালত। মামলাটি আমলে নিয়ে আদালত আসামিদের বিরুদ্ধে সমন জারির নির্দেশ দিয়েছেন।
জয়পুরহাট যুগ্ম দায়রা জজ আদালতের বিচারক কামরুল হাসানের পক্ষে গত বৃহস্পতিবার (২৭ জানুয়ারি) দুপুরে যুগ্ম দায়রা জজ ২য় আদালতের সেরেস্তাদার মো. আবদুল হান্নান বাদী হয়ে জয়পুরহাট অতিরিক্ত চিফ জুডিশিয়াল সদর আদালতে চারজনের নাম উল্লেখ করে মামলা করেন। আদালতের বিচারক আবদুল্লাহ আল মামুন মামলাটি আমলে নিয়ে আসামিদের প্রতি সমন জারি করে আগামী ৩ ফেব্রুয়ারি আদালতে হাজিরের আদেশ দেন।
আসামিরা হলেন- জয়পুরহাট সদর উপজেলার পাঁচুর চক গ্রামের হারেজ উদ্দিনের ছেলে সোহেল রানা ও তার বোন পারুল বেগম, বড় ভাই কালাই উপজেলার আবদুল করিম কাজী ও আইনজীবী রেজাউল করিমের মহুরি পাঁচবিবি উপজেলার রসুলপুর গ্রামের আমজাদ হোসেনের ছেলে আজিজার রহমান।
জয়পুরহাট আদালতের সরকারি কৌঁসুলি অ্যাডভোকেট নৃপেন্দ্রনাথ মণ্ডল পিপি বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
এর আগে ব্যাংক চালান জালিয়াতি চক্রের সঙ্গে আসামিপক্ষের আইনজীবী ও মহুরির সম্পৃক্ততার অভিযোগ উঠে। তবে তারা জালিয়াতির সঙ্গে নিজেদের সম্পৃক্ততার কথা স্বীকার করেননি। এ ঘটনায় নিজের দায় এড়াতে এক আসামির আইনজীবী থানায় মামলা করেছেন। এ মামলায় একজনকে গ্রেপ্তারও করেছে পুলিশ।
জয়পুরহাট আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) নৃপেন্দ্রনাথ মণ্ডল বলেন, জীবিত ব্যক্তিকে মৃত দেখিয়ে, আবার ৩০০ বোতল ফেনসিডিলকে ৩০ বোতল দেখিয়ে আসামির জামিন নেওয়া হয়েছে। সর্বশেষে চেক প্রত্যাখ্যানের দুটি মামলা ব্যাংক চালান জালিয়াতি করে দুই আসামির জামিন নিয়েছেন। এসব জালিয়াতির ঘটনায় আদালত ও আইনজীবীদের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে। এসব জাল-জালিয়াতির সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের চিহ্নিত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় আনার দাবি জানাচ্ছি।
সংশ্লিষ্ট আদালত ও আইনজীবী সমিতি সূত্রে জানা গেছে, আরমান হাবিব ও সোহেল রানা নামে দুই ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে আদালতে পৃথকভাবে প্রায় ৬০ লাখ টাকার দুটি চেক প্রত্যাখ্যান মামলা করা হয়। আরমান হাবিবের বিরুদ্ধে করা মামলার বাদী শাহ মো. কামরুল হাসান, আর সোহেল রানার মামলার বাদী আমানুল্লাহ নামে এক ব্যক্তি। সংশ্লিষ্ট আদালত দুই আসামিকে এক বছর করে কারাদণ্ড ও চেকে উল্লিখিত সমপরিমাণ টাকা জরিমানা করেন। দুই আসামি গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারেও ছিলেন। গত বছরের ১১ নভেম্বর আইনজীবী রেজাউল করিম তার মক্কেল আরমান হাবিবের জরিমানার ৩০ লাখের অর্ধেক ১৫ লাখ টাকা জমার সোনালী ব্যাংকের ১০৩ নম্বর চালান অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালতে দাখিল করেন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ওই দিনই আদালত আরমান হাবিবকে জামিন দেন। অপর আসামি সোহেল রানার চেকে উল্লিখিত সমপরিমাণ জরিমানার ২৮ লাখ ১৬ লাখ টাকার অর্ধেক ১৪ লাখ ৮ হাজার টাকা সোনালী ব্যাংকের ৮৩ নম্বর চালান দ্বিতীয় যুগ্ম জেলা ও দায়রা জজ আদালতে দাখিল করেন। ২৮ নভেম্বর আসামি সোহেল রানা আদালত থেকে জামিনে কারাগার থেকে ছাড়া পান।
ওই দুটি পৃথক চেক প্রত্যাখ্যান মামলার বাদীপক্ষের আইনজীবীরা চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে চালানমূলে ব্যাংক ও আদালতে খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন, আদালতে জমা দেওয়া ১০৩ নম্বর ও ৮৩ নম্বর চালানে কোনো ব্যাংকে টাকা জমা করা হয়নি। এর পর আসামিপক্ষের আইনজীবীরা নিজেদের দায় এড়াতে তৎপর হয়ে ওঠেন। দুই আইনজীবী তাদের দুই আসামির জামিন বাতিল চেয়ে আবেদন করেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে সংশ্লিষ্ট আদালত ওই আইনজীবীর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে দুই আসামির জামিন আদেশ বাতিল করে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছেন।
ব্যাংকের চালান জালিয়াতির ঘটনায় আসামি সোহেল রানার আইনজীবী আনিসুর রহমান বাদী হয়ে গত ১৯ জানুয়ারি জয়পুরহাট সদর থানায় একটি মামলা করেন। ওই মামলায় সোহেল রানার বড় ভাই আবদুল করিম, বোন পারুল বেগম ও আলম বাবু ওরফে নসু বাবুসহ অজ্ঞাত আরও ৩-৪ জনকে আসামি করা হয়। পুলিশ সোহেল রানার বড় ভাই আবদুল করিমকে গ্রেপ্তার করে। তিনি এখন কারাগারে আছেন।
আসামি সোহেল রানার ভাবি নাছিমা বেগম বলেন, আমাদের দেবর চেকের মামলায় কারাগারে ছিলেন। তখন আইনজীবী আনিসুর রহমান ও মহুরি আজিজার রহমান আমার দেবরকে জামিন করানোর জন্য আমাদের ১ লাখ ৭০ হাজার টাকা চুক্তি করেন। আমরা চুক্তি করা টাকা দিয়েছি। আমরা ১৪ লাখ ৮ হাজার টাকার ব্যাংক চালানের কথা জানি না। আইনজীবী নিজের দায় এড়াতে আমার স্বামী ও ননদের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন। অথচ তিনি মহুরিকে মামলায় আসামি করেননি।
অভিযোগ অস্বীকার করে পৃথক দুটি মামলার আইনজীবী রেজাউল করিম ও আনিসুর রহমান বলেন, ‘মহুরি ও মক্কেলের স্বজনরা ব্যাংকে টাকা জমা দেওয়ার চালান এনে দিয়েছেন। আমরা তাদের প্রতি সরল বিশ্বাসে চালানে স্বাক্ষর করেছি। চালানে সোনালী ব্যাংকের সিল ও কর্মকর্তার স্বাক্ষর ছিল। অবিশ্বাস করার মতো কোনো সূত্র ছিল না।’ ব্যাংকের চালান জালিয়াতির ঘটনার সঙ্গে তারা জড়িত নন বলে দাবি করেছেন।
মহুরি আজিজার রহমান বলেন, যে আইনজীবীরা জামিন করিয়েছেন, তারাই ব্যাংক চালান আদালতে জমা দিয়েছেন। মহুরি হিসেবে আইনজীবীদের লেখালেখির সহযোগিতা করেছি। কে ব্যাংকে গিয়ে টাকা জমা দিয়েছে সেটি জানি না।
জয়পুরহাট দ্বিতীয় যুগ্ম জেলা ও দায়রা জজ আদালতের সেরেস্তাদার আবদুল হান্নান বলেন, আইনজীবী নিজেই ব্যাংকে টাকা জমা দিয়েছেন বলে চালানে স্বাক্ষর করেছেন। যদি সেটি ভুয়া ব্যাংক চালান হয়, তা হলে তার দায়দায়িত্ব আইনজীবীর। এ রকম দুটি পৃথক ঘটনায় দুই আসামির জামিন বাতিল হয়েছে। ব্যাংক থেকে প্রত্যয়ন পাওয়ার পর পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
এ ব্যাপারে জয়পুরহাট সদর থানার ওসি একেএম আলমগীর জাহান বলেন, ব্যাংক চালান জালিয়াতি করে জামিন নেওয়ার ঘটনায় আইনজীবী আনিসুর রহমান থানায় একটি মামলা করেছেন। এ মামলার এজাহার নামীয় এক নম্বর আসামিকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। এ ছাড়া এর সঙ্গে জড়িত অন্যদের চিহ্নিত করে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।