মো. আব্দুল বাতেন: গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের (গাসিক) নির্বাচিত মেয়র জাহাঙ্গীর আলমকে পদ থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের মধ্যে রয়েছে- ভুয়া দরপত্র (টেন্ডার), অবৈধভাবে লোক নিয়োগ, ভুয়া বিল ভাউচার ও একই কাজ বিভিন্ন প্রকল্পে দেখিয়ে অর্থ আত্মসাৎ, জমি দখল, জনগণের স্বার্থপরিপন্থী কাজ এবং অবকাঠামো ও জমির ক্ষতিপূরণ না দিয়ে জোর-জবরদস্তি রাস্তা সম্প্রসারণ ইত্যাদি।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, উপরের অভিযোগসমূহের দায় কি শুধুই মেয়রের? গাসিকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার (সিইও) কি কোন দায় দায়িত্ব নেই? এই প্রশ্ন দু’টির উত্তর খুঁজতে হলে যেতে হবে আইনি ব্যাখ্যায়।
স্থানীয় সরকার (সিটি কর্পোরেশন) আইন, ২০০৯ এর ৬২ ধারায় প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সম্পর্কে বলা হয়েছে। আইনের ৬২ (১) ধারায় বলা হয়েছে, কর্পোরেশনের একজন প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা থাকবেন এবং তিনি সরকার কর্তৃক নির্দিষ্ট শর্তে নিযুক্ত হবেন। একই আইনের ৬২(২) ধারায় বলা আছে, এই আইন ও বিধিতে ভিন্নরূপ বিধান না থাকিলে প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা কর্পোরেশনের সকল সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন এবং প্রশাসন পরিচালনার জন্য দায়ী থাকবেন।
এবার মেয়রের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগসমূহের মধ্যে প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা যেসকল অভিযোগের দায় কিছুতেই এড়াতে পারেন না সে প্রসঙ্গে আসা যাক।
অর্থ আত্মসাত সংক্রান্ত দায়
ভুয়া বিল ভাউচারের মাধ্যমে অর্থ আত্মসাতের যে অভিযোগ মেয়রের বিরুদ্ধে উঠেছে, এর জন্য প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাও সমানভাবে দায়ী। সিটি কর্পোরেশনের নিজস্ব ফান্ড/তহবিল আছে। যার টাকা ব্যাংকের মাধ্যমে লেনদেন হয়। উক্ত টাকা চাইলেই মেয়রের একক স্বাক্ষরে উত্তোলন করা যায় না। মেয়র ও সিইও দুইজনের যৌথ স্বাক্ষর যুক্ত চেকের মাধ্যমেই টাকা উত্তোলন করা সম্ভব।
সুতরাং অর্থ আত্মসাৎ সংক্রান্ত অভিযোগের দায় প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) উপর বর্তায়। তিনি চাইলেই ভুয়া বিলে আপত্তি দিয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রনালয়কে অবহিত করতে পারতেন।
ভুয়া টেন্ডার সংক্রান্ত দায়
ভুয়া টেন্ডার দিয়ে অর্থ আত্মসাৎ সংক্রান্ত অভিযোগের বিষয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ২০২০ সালের ৮ অক্টোবর একটি চিঠির মাধ্যমে প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে জানতে চান। যার জবাব অদ্যবধি প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা দুর্নীতি দমন কমিশনের কাছে দেন নাই। তিনি চাইলেই দুদককে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করতে পারতেন।
ক্ষতিপূরণ ছাড়া রাস্তা সম্প্রসারণ
জাহাঙ্গীর আলম মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর বিভিন্ন ওয়ার্ডে রাস্তার সম্প্রসারণের উদ্দোগ গ্রহণ করেন। বিদ্যমান দশ/বারো ফিট রাস্তা গুলো যথাক্রমে ত্রিশ/চল্লিশ ফিট করার কথা মুখে বললেও বাস্তবে হয়েছে, ড্রেন সহ বাইশ/তেইশ ফিট। যে পাশে ড্রেন নির্মাণ করা হয়েছে সেই পাশের জমি মালিকের কাছে থেকে ড্রেনসহ পুরো জমি নিলেও অপর পাশের জমির মালিকের কাছে থেকে জমি নিয়েছেন সাত/আট ফিট। যাদের জমি ও স্থাপনা ভাঙা পরেছে তাদের কোন ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয় নাই। অনেকে ক্ষতিপূরণ পাওয়ার জন্য মেয়র ও সিইও বরাবর আবেদন করলেও সিটি কর্পোরেশন সেই দরখাস্ত গ্রহণ করে নাই। তখন অনেকেই ডাকযোগে সেই আবেদন জমা দিয়ে মহামান্য হাইকোর্ট বিভাগে রিট দায়ের করেন।
মহামান্য হাইকোর্ট বিভাগ রিটগুলোর প্রাথমিক শুনানি শেষে, রুল স্থিতাবস্থা ও ক্ষতিপূরণের আবেদন নিষ্পত্তির জন্য প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাকে আদেশ/নির্দেশ প্রদান করেন। প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মহামান্য হাইকোর্ট বিভাগের সেই আদেশ ও নির্দেশ একটাও পালন করে নাই। অনেক ক্ষেত্রে স্থিতাবস্থা আদেশ অমান্য করার অভিযোগ আছে। এই জন্য আদালত অবমাননার মামলাও হয়েছে।
সুতরাং রাস্তার সম্প্রসারণের ক্ষতিপূরণ না দেওয়ার অভিযোগ সংক্রান্ত দায় ও দায়িত্ব প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার উপরও বর্তায়। তাই তাকেও সাময়িক বরখাস্ত করে তার বিরুদ্ধেও উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করা দরকার।
লেখক: আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট।