আবু মোহাম্মদ আমিন উদ্দিন, যিনি এ এম আমিন উদ্দিন নামেই সর্বাধিক পরিচিত। বর্তমানে তিনি দেশে ১৬তম অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে দায়িত্বপালন করছেন। আইনের শাসন, স্বাধীন ও নিরপেক্ষ বিচার ব্যবস্থা, মামলাজট ও বিচার বিভাগে প্রযুক্তির ব্যবহারসহ নানা বিষয়ে জানতে সম্প্রতি তাঁর মুখোমুখি হয়েছিল ল’ইয়ার্স ক্লাব বাংলাদেশ ডটকম। সম্পাদক অ্যাডভোকেট বদরুল হাসান কচির নেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারের চুম্বক অংশ পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হল।
ল’ইয়ার্স ক্লাব: রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন কর্মকর্তার দায়িত্ব কতটা চ্যালেঞ্জিং, কতটা উপভোগ্য?
এ এম আমিন উদ্দিন: রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা হিসেবে না, আমি তো একজন আইনজীবী এবং আইনজীবী হিসেবে আমার দায়িত্ব কোর্টে মামলা পরিচালনা করা। সচরাচর কাজ সরকার পক্ষে মামলা পরিচালনা করা, সে কাজটিই করি। এছাড়া সরকারের কিছু কিছু বিভাগ আমার কাছে ওপিনিয়ন (মতামত) চায়। তাই মাঝেমধ্যে মতামতও দিতে হয়। আরেকটা কাজ হচ্ছে সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল ও ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেলদের মধ্যে মামলা ভাগ করে দেওয়া এবং প্রয়োজনীয় সহায়তা করা। সাংবিধানিক এ পদে আসার আগে চেম্বার ভিত্তিক কাজের সময় এতো আইনজীবী একসাথে ছিলেন না। ফলে আড়াই শ’ সহকর্মীর সাথে এবং সবাইকে নিয়ে কাজ করাটা ঠিক চ্যালেঞ্জিং বলবো না, বরং উপভোগ্যই।
ল’ইয়ার্স ক্লাব: দেশে আইনের শাসন বাস্তবায়নে এ মুহূর্তে কী কোনো প্রতিবন্ধকতা দেখতে পাচ্ছেন?
এ এম আমিন উদ্দিন: দেশে আইনের শাসন বাস্তবায়নে সরকারের প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। সরকার এ বিষয়ে সহযোগী হিসেবে কাজ করে। আনন্দের বিষয় হচ্ছে এক্ষেত্রে কোন ব্যত্যয় ঘটলে সরকার তড়িৎ পদক্ষেপ গ্রহণ করে। আদালতসমূহ এখন অনেক প্রো-অ্যাকটিভ। আইনের শাসনে কোন ব্যত্যয় নজরে এলেই আদালত নির্দেশনা প্রদান করেন। সরকারের যথাযথ সহায়তা এবং আদালতসমূহের স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে শক্ত অবস্থানের কারণে স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে আইনের শাসনের সূচকে বর্তমান উন্নয়ন সম্ভব হয়েছে। আর এ উন্নয়নে বিচার বিভাগ, আইনজীবীসহ সংশ্লিষ্ট সকলেই প্রশংসার দাবীদার।
ল’ইয়ার্স ক্লাব: অধস্তন আদালতের বিচারকদের আইন মন্ত্রণালয়ের অধীনে রেখে স্বাধীন, নিরপেক্ষ বিচারব্যবস্থা কতটুকু সম্ভব?
এ এম আমিন উদ্দিন: অধস্তন আদালতের বিচারকবৃন্দ এখন আর আইন মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ নন। মাজদার হোসেন মামলার প্রেক্ষিতে অধস্তন আদালতের বিচারকদের নিয়োগ, পদোন্নতি, বদলি কিংবা শৃংখলার বিষয়টি আইনানুযায়ী এখন সুপ্রিম কোর্টের অধীন। সরকার চাইলেও এখন এসব বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে পারে না। মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাব সুপ্রিম কোর্টের জিএ কমিটির অনুমোদন সাপেক্ষেই বাস্তবায়ন হয়। জিএ কমিটি দ্বিমত পোষণ করলে সে প্রস্তাব অকার্যকর হয়ে যায়।
ল’ইয়ার্স ক্লাব: বিচার বিভাগের জন্য পৃথক সচিবালয়ের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন কি না?
এ এম আমিন উদ্দিন: নিশ্চয়ই, বিচার বিভাগের জন্য পৃথক সচিবালয়ের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। তবে সময় লাগবে। কারণ এর পেছনে বিস্তর কাজ করতে হবে। আশা করি, ভবিষ্যতে এটিও বাস্তবায়িত হবে।
ল’ইয়ার্স ক্লাব: মামলাজটের কারণে চরম দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন ভুক্তভোগীরা। এটা নিরসনে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে কি?
এ এম আমিন উদ্দিন: মামলা জট আমাদের মূল সমস্যা। সুপ্রিম কোর্ট দিবসে বিষয়টি উত্থাপন করেছি। মামলা জট নিরসন করতে সক্ষম না হলে ন্যায় বিচার ব্যহত হবে। বছরের পর বছর মামলা ঝুলে থাকার পর রায় বিচারপ্রার্থীর পক্ষে হলেও লাভ হবে না। কারণ এতে বিচারপ্রার্থীর মূল্যবান সময় নষ্ট হয়। দীর্ঘসূত্রিতা হ্রাসে উচ্চ এবং অধস্তন উভয় আদালতে বিচারক সংখ্যা বৃদ্ধি করতে হবে। একইসাথে প্রযুক্তির সহায়তা নেওয়া যেতে পারে। কারণ বিচারক রায় প্রদানের পর, নথিভুক্তকরণ, সংশোধন ইত্যাদি বিষয়ে সময় লাগে। প্রযুক্তির এই যুগে আর্টিফিসিয়াল ইন্টিলিজেন্স ব্যবহার করা হলে বিচারকদের আদেশ সরাসরি নথিভুক্ত করা সম্ভব। এছাড়া মাঝেমধ্যে তথ্য গোপন করে একই মামলা একাধিকবার দায়ের করা হয়ে থাকে। এসব বিষয়ও প্রযুক্তির মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব। এর ফলেও বিচারকাজে গতি আসবে।
ল’ইয়ার্স ক্লাব: ডিজিটাল বাংলাদেশের প্রযুক্তি বিচার বিভাগকে কতখানি স্পর্শ করতে পেরেছে?
এ এম আমিন উদ্দিন: ছোট একটা উদাহরণ দিয়েই বলি, করোনাকালে পুরো পৃথিবী লকডাউনে চলে গেলেও বিচারকাজ বন্ধ হয়নি। আদালতসমূহ তথ্য-প্রযুক্তি ব্যবহার করে বিচারিক কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে। মানুষ ন্যায় বিচার পেয়েছে। ফলে প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে অনেক সমস্যা সমাধান করা সম্ভব। আর একারণেই বর্তমান সরকার বিচার বিভাগ ডিজিটালাইজড করার বিষয়ে মনযোগী হয়েছেন। সম্প্রতি তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের মাননীয় প্রতিমন্ত্রীর সাথে কথা হয়েছে। তিনি জানিয়েছেন এ টু আই প্রজেক্টের অধীনে চলমান ই-জুডিসিয়ারি প্রকল্পের কাজ অনেকটা এগিয়েছে। ইতোমধ্যে সুপ্রিম কোর্টে কোম্পানি এবং এডমিরালটি বিষয়ক মোকদ্দমা/ আপীল/ দরখাস্ত ই-ফাইলিং পদ্ধতিতে দায়ের করা যাচ্ছে। আশা করছি ধাপে ধাপে সকল বিষয় ডিজিটালাইজড হবে। সুপ্রিম কোর্ট হচ্ছে কোর্ট অব রেকর্ড। এতো এতো রেকর্ড যে, রেকর্ড রুমে (নথি সংরক্ষণাগার) পা ফেলার জায়গা নেই! এখানে প্রতিটা বেইল (জামিন) –এর রেকর্ড পর্যন্ত সংরক্ষণে রাখা হয়। এসব বিষয়গুলো ডিজিটাল আর্কাইভের মাধ্যমে সংরক্ষণের কাজ চলছে। শিগগিরই এ ব্যবস্থা চালু হলে এবং দ্রুততার সাথে বিচার সংশ্লিষ্ট প্রযোজ্য অন্যান্য বিষয়গুলোও ডিজিটালাইজড করা গেলে জাতি উপকৃত হবে। ই-জুডিসিয়ারির মাধ্যমে বিচার বিভাগে বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধিত হবে। এক্ষেত্রে বিচারক, আইনজীবী ও বিচারপ্রার্থীসহ সংশ্লিষ্ট সকলকেই প্রযুক্তিকে সাধুবাদ জানিয়ে এর সঙ্গে দ্রুত মানিয়ে নেওয়া প্রয়োজন।
ল’ইয়ার্স ক্লাব: সারাদেশে বিভিন্ন বিষয়ে কিছু আলোচিত মামলা বছরের পর বছর শুনানির অপেক্ষায় থাকে। বিচার শেষ হয় না। কারণ কী? উত্তরণের পথ কি?
এ এম আমিন উদ্দিন: দেখুন মামলার সংখ্যা তো প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। পুরনো মামলা নিষ্পত্তির পরই তো নতুন মামলার বিচারকাজ শুরু হবে। যতদূর জানি, হাইকোর্ট বিভাগে বিচারাধীন আলোচিত বেশ কিছু মামলা ইতোমধ্যে নিষ্পত্তি হয়েছে। আরও কিছু মামলা এখনো বিচারাধীন রয়েছে। ক্রমান্বয়ে সবগুল মামলাই নিষ্পত্তি হবে। হাইকোর্ট বিভাগে নিষ্পত্তি হওয়া মামলাগুলো সুপ্রিম কোর্টে (আপিল বিভাগে) নিষ্পত্তি হতে বেশি সময় লাগবে না। আমার জানা মতে, আপিল বিভাগ গত তিন মাসে অসংখ্য মামলা নিষ্পত্তি করেছেন। নির্দিষ্ট করে যদি বলি ২০১৪, ২০১৫ সালের সব মামলা নিষ্পত্তি করে দিয়েছেন। এছাড়া ২০১৩ সালের অল্প কিছু মামলা এখনো বিচারাধীন, তবে ২০১২ সালের আগের কোন মামলা আপিল বিভাগে বিচারাধীন নেই। ফলে ফৌজদারি আপিলের ব্যাকলগ কমিয়ে আনা গেছে। এক্ষেত্রেও তথ্যপ্রযুক্তি সহায়তা করেছে। করোনাকালে শারীরিক উপস্থিতিতে সব আদালত চালু না থাকায় বিচারকগণ বাসায় বসে কোর্টের নির্ধারিত সূচির পরও যথেষ্ট সময় নিয়ে এসব মামলা নিষ্পত্তি করে দিয়েছেন। আগামীতে বিচারক সংখ্যা বৃদ্ধি ও আইনজীবীদের সহযোগিতা এবং তথ্য প্রযুক্তির সহায়তায় মামলাজট অনেকাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব হবে বলে বিশ্বাস করি।
ল’ইয়ার্স ক্লাব: একটা অপ্রিয় প্রশ্ন করতে চাই, পর্যবেক্ষকমহলের অভিমত অ্যাটর্নি জেনারেল যতটা না রাষ্ট্রের তারচেয়ে বেশি সরকারের, আপনার মন্তব্য জানতে চাই।
এ এম আমিন উদ্দিন: রাষ্ট্র অ্যাবস্ট্রাক্ট একটা বিষয়, আর রাষ্ট্রের পরিচালক সরকার। সংবিধান এবং সরকারের নীতির মাধ্যমে রাষ্ট্র পরিচালিত হয়। ফলে রাষ্ট্র এবং সরকারকে দূরে রাখা সম্ভব নয়। সরকারের সকল পদক্ষেপই রাষ্ট্রের পক্ষে। অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে রাষ্ট্রের আইনানুযায়ী রাষ্ট্রপক্ষে অর্ডারসমূহ ডিফেন্ড করতে হয়। ফলে অনেকেই মনে করে থাকেন অ্যাটর্নি জেনারেল সম্ভবত সরকারের কথা বলছেন! আদতে এটা সঠিক নয়। আইনসমূহ কিন্তু রাষ্ট্রের সরকার কেবল প্রণয়ন করেন। সত্য হচ্ছে আমরা রাষ্ট্র পক্ষেই কাজ করি, রাষ্ট্রের পক্ষেই আদালতে দাঁড়াই। কিন্তু সরকার এসব দেখাশোনা করেন বলেই অনেকের ভ্রান্ত ধারণা অ্যাটর্নি জেনারেল বুঝি সরকার পক্ষে কাজ করেন!