প্রতারণার মাধ্যমে সিরামিক ইন্ডাস্ট্রিসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগের প্রলোভন দেখিয়ে শত কোটির অধিক টাকা আত্মসাৎ এবং বিপুল পরিমান অর্থ পাচারের অভিযোগে এক ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
র্যাব সদর দপ্তরের গোয়েন্দা শাখা ও র্যাব-১ এর অভিযানে রাজধানীর উত্তরা থেকে সোমবার (১১ এপ্রিল) তাকে গ্রেফতার করে র্যাব।
গ্রেফতারকৃত ব্যক্তির নাম জিয়াউদ্দীন ওরফে জামান (৫৫)। তিনি বাগেরহাটের মোড়েলগঞ্জ উপজেলার কামরুজ্জামানের ছেলে।
এসময় তার কাছ থেকে বিভিন্ন ব্যাংকের ৩৭টি চেক বই, ৬ বোতল বিদেশি মদ, ৯৯ হাজার টাকার জালনোট, ৬ হাজার জাল ইউএস ডলার, প্রতারণামূলক কার্যকলাপের জন্য ফোসান সিরামিক প্ল্যান্ট এবং জিয়া টাওয়ারের কাঠামোগত ভবিষ্যত পরিকল্পনা, ওমানে অর্থ পাচারের তথ্যাদি, প্রতারণামূলক কার্যকলাপের জন্য “জাপানে তৈরি” স্টিকার, ৫ ধরণের আইডি এবং বিজনেস কার্ড, নগদ ২ লক্ষ ২৫ হাজার টাকা এবং ২০০ কোটি টাকা নেওয়ার ভবিষ্যত পরিকল্পনা সংক্রান্ত নথিপত্র উদ্ধার করা হয়।
র্যাব জানায়, সাম্প্রতিক সময়ে কয়েকজন ভুক্তভোগী হতে দেশে বিদেশে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগের প্রলোভন দেখিয়ে বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ীর নিকট হতে প্রতারণার মাধ্যমে বিপুল পরিমান অর্থ আত্মসাৎ ও ভয়ভীতি দেখানোর অভিযোগ পাওয়া যায়। প্রতারণার বিষয়টি বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হলে ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। তার নামে বিভিন্ন থানায় একাধিক মামলা রুজু হয়। এরই প্রেক্ষিতে উক্ত প্রতারককে গ্রেফতার করে আইনের আওতায় নিয়ে আসতে র্যাব গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধি করে।
র্যাবের পক্ষ থেকে জানানো হয়, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে সে বিভিন্ন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানকে প্রতারিত করার বিভিন্ন বিষয়াদি ও কৌশল সম্পর্কে তথ্য প্রদান করে। গ্রেফতারকৃত জিয়াউদ্দিন ১২টি প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার অর্থাৎ চেয়ারম্যান বা এমডি হিসেবে দাবী করে থাকেন। সে নিজেকে জাহির করার লক্ষ্যে এ ধরণের তথ্য সম্বলিত ভিজিটিং কার্ড তৈরী করেছে বলে জানায়।
এছাড়াও তার অস্ট্রেলিয়া, চায়না, হংকং, ওমান ও দুবাই এ নানাবিধ ব্যবসা রয়েছে বলে বিভিন্ন মহলে ভুয়া প্রচারণা চালায়। সে বিভিন্ন ব্যক্তিকে কৌশলে প্রলুব্ধ করে ব্যবসায়িক পার্টনার বানানোর নামে বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ করেছে। এছাড়া প্রায় শতাধিক ব্যক্তিকে নানাভাবে প্রতারিত করার বিষয়ে জানা যায়।
প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতারকৃত জানায়, সে ২০১৪ সালে ফোসান সিরামিক লিমিটেড স্যানিটারি প্যাড, হাইলেডি স্যানিটারি ন্যাপকিনসহ নানাবিধ পণ্যের আকর্ষনীয় টিভিসির মাধ্যমে ক্রেতাদের আকৃষ্ট করে, সে প্রতারিত করত। ব্যবসায়িক অংশীদার বানানোর লোভ দেখিয়ে বিভিন্ন ভুক্তভোগীর কাছে কয়েকশত কোটি টাকা আত্মসাৎ করে। এইভাবে ব্যবাসায়িক অংশীদারের প্রস্তাব দিয়ে সে আনুমানিক শতাধিক ভুক্তভোগীর নিকট থেকে প্রায় ১৭০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করে।
মূলত ভুয়া আকর্ষণীয় বিজ্ঞাপণ, ভুয়া কোম্পানি ওয়েবসাইট, বিদেশে ভুয়া সাজানো ফ্যাক্টরি এবং অফিস পরিদর্শন, সাজানো বিপনন কেন্দ্র এবং ভুয়া কৃষি খামার ইত্যাদিতে আকৃষ্ট হয়ে জিয়া উদ্দিনকে সরলভাবে বিশ্বাস করে ব্যবসায়ীরা তার প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ করে প্রতারিত হত।
সে বেশ কয়েকটি ব্যাংক থেকে তার নাম সর্বস্ব ভূয়া প্রতিষ্ঠানের নামে প্রায় ৩০০ শত কোটি টাকা ঋণ গ্রহণ করে তার উল্লেখযোগ্য অংশ মানি লন্ডারিং করে বিদেশে পাচার করেছে বলেও গ্রেফতারকৃত জানায়।
জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতারকৃত প্রতারণার কৌশল সম্পর্কে জানায়, ২০০৯ সালে প্রবাসে থাকা অবস্থায় টাইলস ব্যবসার খুঁটিনাটি সম্পর্কে সম্যক ধারণা অর্জন করে। এছাড়া বিদেশি দুটি দেশের মাফিয়াদের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ টাকা এক দেশ হতে অন্য দেশে স্থানান্তর করে। এভাবে অর্থ পাচার চক্রের সাথে তার সখ্যতা তৈরি হয়।
পরবর্তীতে ২০১৪ সাল হতে ফোসান সিরামিক লিমিটেড, হাইটেক সিরামিক লিমিটেড ইত্যাদি আমদানীর ক্ষেত্রে অধিক মূল্য দেখিয়ে সে বিদেশে অর্থ পাচার করে। ২০১৬ সাল হতে অদ্যাবধি বাংলাদেশ হতে প্রায় অর্ধশত কোটি টাকা পাচার করেছে বলে জানায়।
জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতারকৃত আরও জানায়, সে প্রতারণার কৌশল হিসেবে ব্যবসায়ীদের দামী এবং আকর্ষণীয় গিফট প্রদান করত। পরবর্তীতে তাদেরকে বিদেশে তার তথাকথিত ভুয়া মালিকানাধীন টাইলস ফ্যাক্টরিতে ভ্রমণের ব্যবস্থা করত। ঐসব ফ্যাক্টরির অফিসের পরিদর্শনযোগ্য ব্যবস্থাপনার জন্য অর্থ প্রদান করত। সে শীঘ্রই বাংলাদেশে এই ধরণের ফ্যাক্টরি স্থাপন করতে যাচ্ছে বলে দেশি/বিদেশি ব্যবসায়ীসহ খ্যাতনামা অনেককেই প্রলুব্ধ করত। কারসাজি হিসাবের মাধ্যমে অস্বাভাবিকভাবে দেশে উৎপাদিত পণ্যের লাভ দেখিয়ে সকলকে বিভ্রান্ত করত।
এছাড়াও মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশের সরকারি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সাথে তার সখ্যতা রয়েছে বলে প্রচার-প্রচারণা করত। বিভিন্ন প্রজেক্টের নামে কয়েকশ একর জমি লিজ নিয়ে সেটিকে তার নিজস্ব সম্পত্তি বলে প্রচার করত। যা দেখে অনেকেই বিভ্রান্ত হত। সেই সমস্ত দেশে টাইলসহ বেশ কিছু ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান রয়েছে এই ধারণা দিতে সে সেখানে সাময়িক দোকান ভাড়া করে প্রদর্শন করত। পরবর্তীতে সে দেশি/বিদেশি ব্যবসায়ীদের সেখানে পরিদর্শন করিয়ে বিনিয়োগের নামে অর্থ আত্মসাৎ করত।
গ্রেফতারকৃত আরও জানায়, নাম সর্বস্ব প্রতিষ্ঠানের সাথে যোগসাজসের মাধ্যমে টাইলসে ফোসান সিরামিকের লোগো খোদাই করে নিজের ফ্যাক্টরি হতে তৈরীকৃত বলে প্রচার করে বাংলাদেশে ব্যবসা করত। এভাবে একজন আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন ব্যবসায়ী হিসেবে নিজের ঠাট বজায় রাখত। বিভিন্ন ব্যক্তিদের প্রতারিত করে প্রতারিত অর্থ দিয়ে সে বিলাসী জীবনযাপন করত। সে ক্রেতাদের নিকট হতে বিপুল পরিমাণ অর্থ নিয়ে যৎ সামান্য টাইলস সরবরাহ করত। বাকী অর্থ দিয়ে সে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিপুল পরিমাণ জমি ক্রয় বা পাওয়ার অব অ্যাটর্নি নিয়ে নিত। অতপর ঐ সমস্ত জমির বিপরীতে বিভিন্ন ব্যাংক হতে কয়েকশত কোটি টাকা লোন নেয়।
এরপর এসব অর্থ এবং প্রলুব্ধ লোকজন হতে প্রতারণার মাধ্যমে প্রাপ্ত অর্ধ কোটি টাকা আন্ডার-অভারইন ভয়েজের মাধ্যমে বিদেশে পাচার করেছে বলে জানায়। জিজ্ঞাসাবাদে আরও জানা যায় যে ২৪%-২৫% অতিরিক্ত মূল্য নির্ধারণ করে টাইলস আমদানী দেখাত; পরবর্তীতে ঐ সমস্ত দেশে ৬% উক্ত কোম্পানী ও ১৮%-১৯% সে গ্রহণ করত বলে জানায়।
গ্রেফতারকৃত জানায়, সে তার ৪টি ব্রান্ডের সিরামিকস বা টয়লেট সামগ্রীর ব্যবসার আড়ালে বিভিন্ন ভাবে মানুষদের প্রতারিত করে। প্রতারণার অর্থ হতে প্রায় ১৩০ বিঘা জমি ক্রয় করে। যার বিপরীতে বিভিন্ন ব্যাংক হতে প্রায় তিনশত কোটি টাকা ব্যাংক লোন নেয়। দেশে বিভিন্ন ব্যাংকে ৩৯টি এ্যাকাউন্ট ও বিদেশে ০৩টি ব্যাংকে এ্যাকাউন্ট রয়েছে।
এছাড়াও তার পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের নামে বিভিন্ন ব্যাংকে ৬০-৭০ টি ব্যাংক একাউন্ট রয়েছে। তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানায় প্রতারণাসহ বিভিন্ন অপরাধে ১৮-২০টি মামলা রয়েছে। গ্রেফতারকৃত আসামীর বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন বলে র্যাব সূত্র জানিয়েছে।