মো. সাইফুল ইসলাম: “তুই চোরের ছেলে। তোর বাপ একটা চোর। আমাদের সাথে খেলতে আসবি না” – কথাগুলো বলছিল কারামুক্ত দুলালের ছেলে তমালকে (১০) তার প্রতিবেশী বন্ধু জাহিদ (১২)। দিনমজুর দুলাল ছাগল চুরির মামলায় এক বছর সাজা ভোগ করে সমাজে ফিরলেও সমাজ তাকে ঠিকভাবে গ্রহণ করছে না। কেউ কাজে নিচ্ছে না। তার পরিবারও পদে পদে প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হচ্ছে। অথচ সে ভালো হতে চায়, স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে চায়। কিন্তু জেল জীবনের কলঙ্ক (Stigma of jail life) তাকে প্রতিনিয়ত বয়ে নিয়ে বেড়াতে হচ্ছে। এরূপ লঘু অপরাধে দণ্ডিত অপরাধীদের জেল জীবনের কলঙ্ক থেকে মুক্তি দিয়ে সংশোধন পূর্বক সমাজের উপযোগী করে তুলতেই প্রবেশন ব্যবস্থার উদ্ভব। এই মুক্তি হয় শর্তসাপেক্ষে প্রবেশন অফিসারের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে। আর তত্ত্বাবধান কার্যক্রম পরিচালিত হয় প্রবেশন বন্ডে সন্নিবেশিত শর্তের আলোকে।
বিশ্বের অন্যান্য উন্নত দেশের ন্যায় আমাদের দেশেও প্রবেশনের চর্চা দিন দিন বাড়ছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এর আশানুরূপ সাফল্য পাওয়া গেলেও কিছু কিছু অভিনব শর্ত মানবাধিকার ও মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী হওয়ায় আইন অঙ্গনে সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। এ ধরনের অভিনব শর্ত দেয়ার ক্ষমতা সত্যিই কী আদালতের আছে? কেনইবা বন্ড নিয়ে ব্যক্তির স্বাধীনতাকে সীমিত করে দেয়া হচ্ছে? আসলে দ্য প্রবেশন অব অফেন্ডার্স অর্ডিন্যান্স, ১৯৬০ এর ০৫ ধারায় আদালতকে এমন ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। আদালতে কোনো আসামীর জামিন হলে যেমন জামিননামা দাখিল করতে হয়; ঠিক তেমনি কোনো দণ্ডিত অপরাধীকে সংশোধনের জন্য প্রবেশনে মুক্তি দেয়া হলে শর্ত সম্বলিত প্রবেশন মুচলেকা দাখিল করতে হয়। ১৯৭১ সালের বাংলাদেশ প্রবেশন অব অফেন্ডার্স বিধিমালায় ০৫ টি ফরম দেয়া আছে। এর মধ্যে ‘সি’ ফরমে প্রবেশনের বন্ডে কিছু শর্ত উল্লেখ রয়েছে। এই শর্তগুলো অত্যন্ত সহজ, সরল এবং প্রবেশন আইনের সাথে সামঞ্জস্য করে করা হয়েছে। এই আইনের ৪, ৫ ও ১০ ধারা বিশ্লেষণ করলে ২ ধরনের শর্ত পাওয়া যায়। এখানে অধিকাংশ শর্ত বিধিবদ্ধ (Statutory Condition) এবং অবশিষ্ট শর্তগুলো আদালতের বিবেচনামূলক (Discretionary Condition)।
যে সব শর্ত দ্য প্রবেশন অব অফেন্ডার্স অর্ডিন্যান্স, ১৯৬০ এ সুনির্দিষ্ট করে উল্লেখ আছে তাকে আমরা বিধিবদ্ধ শর্ত বলতে পারি। যেমন- নতুন করে কোন অপরাধে জড়িত না হওয়া, মাদক সেবন থেকে বিরত থাকা, শান্তি রক্ষা ও সদাচরণ করা, আদালতের নির্দেশমত হাজির হওয়া ইত্যাদি। আদালত কোনো প্রবেশন আদেশ দেবেন না যদি অপরাধী নির্ধারিত সময়কালে কোনো অপরাধ না করার এবং শান্তিরক্ষার ও সদাচরণ করার এবং আদালত কর্তৃক নির্দেশিত হলে ঐ সময়কালে আদালতে হাজির হবার এবং শাস্তিভোগের জন্য প্রস্তুত থাকার অঙ্গীকার সম্বলিত জামিনদারসহ বা জামিনদার ছাড়া কোন মুচলেকা সম্পাদন না করে। অন্যদিকে, প্রবেশনারকে সংশোধন করে সুনাগরিক হিসেবে সমাজে আত্তীকরণের স্বার্থে আদালত যেমন প্রয়োজন মনে করেন তেমন শর্ত আরোপ করতে পারবেন। এরূপ শর্তগুলোকে বিবেচনামূলক শর্ত বলা যায়। যেমন- বই পড়া, বৃক্ষরোপণ, প্রবীণদের সেবা করা ইত্যাদি। আমাদের আইনে এমন শর্তারোপের কথা উল্লেখ না থাকলেও এসব প্রয়োগে কোনরূপ বাঁধাও নেই। কারণ উক্ত আইনের ০৫ ধারানুসারে আদালত প্রবেশন অফিসার কর্তৃক তত্ত্বাবধান নিশ্চিত করার প্রয়োজনে যে ধরনের শর্তাবলী সন্নিবেশিত করা আবশ্যক মনে করেন সে ধরনের শর্তাদি মুচলেকায় সংযোজনের নির্দেশ দিতে পারেন। এছাড়াও অপরাধীর বাসস্থান, পরিবেশ, মাদক সেবন হতে বিরত থাকা বা অন্য কোনো বিষয়ে প্রতিটি মামলার বিশেষ পরিস্থিতি নিরিখে যে রকম উপযুক্ত বিবেচনা করেন সে রকম অতিরিক্ত শর্তাদিও কোর্ট জুড়ে দিতে পারেন। সুতরাং এই শর্তগুলো আরোপের একমাত্র ক্ষমতা আদালতের যা প্রতিটি মামলার বিশেষ পরিস্থিতির নিরিখে ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে। যদি কোনো সময় শর্ত পরিবর্তনের প্রয়োজন হয় তবে আদালত স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে বা আবেদনের প্রেক্ষিতে কারণ দর্শানোর সুযোগ দিয়ে তা পরিবর্তন করতে পারবেন (১০ ধারা)। আদালত যদি কোনো শর্তারোপ নাও করেন তবুও তা অশুদ্ধ হবে না। সেক্ষেত্রে ‘সি’ ফরমে বর্ণিত শর্তাবলীই প্রবেশনারের জন্য প্রযোজ্য হবে। কিন্তু কোনো অবস্থাতেই প্রবেশন অফিসার বন্ডে শর্ত সংযোজন করতে পারবে না।
প্রবেশনে কি কি শর্ত থাকবে তা নির্ভর করে মামলার প্রকৃতি, অপরাধের ধরন, অপরাধীর পেশা ও বৈশিষ্ট্য, তার শিক্ষাগত যোগ্যতা, আর্থিক সামর্থ্য ইত্যাদির উপর। দ্য টোকিও রুলস অনুসারে প্রবেশনের শর্তগুলোর লক্ষ্য হচ্ছে অপরাধের পুনরাবৃত্তির সম্ভাবনা হ্রাস করা এবং ভিকটিমের প্রয়োজনীয়তা বিবেচনায় নিয়ে অপরাধীর সামাজিক একীকরণের সম্ভাবনা বৃদ্ধি করা। বিধিবদ্ধ শর্তগুলো আরোপে কোনো জটিলতা নেই। তবে কোনো কোনো সময় বিবেচনামূলক অতিরিক্ত শর্তাদি আরোপ সমালোচিত হচ্ছে। প্রবেশনের শর্ত যেমন গতানুগতিক হওয়া উচিত নয় তেমনি এমন শর্ত যেন আরোপ করা না হয় যা অপরাধী বিশেষের পক্ষে পালন করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। আবার এমন শর্তারোপ করাও সমীচীন নয় যা পালনে ব্যর্থ হলে আদালত আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে পারবে না। যেমন: আদালত কাউকে নামাজ পড়তে, রোজা রাখতে বাধ্য করতে পারবেন না। আসামী ৫ ওয়াক্ত নামাজ পড়ছে কিনা তা মনিটরিং করা সম্ভব নয়। বন্ডের মাধ্যমে ধর্মীয় কোনো বিষয় কারো উপর চাপিয়ে দেয়া যায় না। আদালত নিশ্চয়ই প্রবেশনারকে নামাজ না পড়ার কারণে আইনের ৭ ধারানুসারে ওয়ারেন্ট ইস্যু করতে পারবে না, জরিমানা করতে পারবে না বা মূল অপরাধের জন্য স্থগিত সাজাও দিতে পারবে না। এগুলো শর্তে দেশের অধিকাংশ মানুষ বাহবা দিলেও আদতে এগুলো ব্যক্তি স্বাধীনতা ও ধর্মীয় স্বাধীনতার পরিপন্থী। আদালত যদি মনে করেন প্রবেশনার ধর্ম পালনে পরিবর্তন হবে তাহলে তাকে ধর্মীয় বই পড়তে দেয়া যেতে পারে। এতে তিনি যদি নিজেই উপলব্ধি করেন তাহলে তো কোন সমস্যা নেই। যদি আসামী নিরক্ষর হয় তাহলে তাকে পড়ালেখা শেখার শর্ত দেয়া যেতে পারে।
কোনো শর্ত মৌলিক অধিকারের সাথে সাংঘর্ষিক কিনা সেটাও বিবেচনা করতে হবে। যেমন- চুরির কোনো মামলায় বিচারক ভাবতে পারেন, আসামী প্রতিদিন আদালত প্রাঙ্গণে এসে ১ ঘন্টা করে বলবেন, “আমি চোর। চুরি করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। আপনারা চুরি করবেন না। আমাকে ক্ষমা করবেন”। এটা বললে আসামীর পরিবর্তন আসবে মর্মে ভাবতে পারেন। কিন্তু একইসাথে এটাও ভাবতে হবে যে, প্রতিদিন আদালতে আসা একদিকে যেমন ব্যয়বহুল, অন্যদিকে আসামীকেও সামাজিকভাবে হেয় করা হয়। এটা প্রবেশনের মূলনীতি বিরুদ্ধ। কারণ প্রবেশন সার্ভিসের অন্যতম লক্ষ্য হচ্ছে অপরাধীকে সমাজের উপযোগী করে গড়ে তোলা। কিন্তু এভাবে প্রকাশ্যে তাকে চোর হিসেবে দাঁড় করিয়ে রাখলে সমাজ তার প্রতি বিরূপ মনোভাব দেখাবে। এতে অপরাধী হীনমন্নতায় ভোগে এবং তার স্বাভাবিক জীবনে ফেরা বাধাগ্রস্ত হয়। প্রবেশনার আবার অপরাধ করে বসে।
আজ থেকে ১০/১২ বছর আগের একটি ঘটনা আমার মনে আছে। দিনাজপুরে একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ভ্রাম্যমান আদালতে জেল-জরিমানা না করে আসামীকে প্রকাশ্যে হাঁটু গেড়ে বসিয়ে রেখেছিলেন। এরূপ অমর্যাদাকর বেআইনী দণ্ড দেয়ার কারণে মহামান্য হাইকোর্ট তাকে তলব করেছিলেন। পরে ব্যাপক সমালোচনার মুখে তাকে প্রত্যাহার করা হয়েছিল। এছাড়া করোনাকালে মাস্ক না পড়ায় তিন বৃদ্ধকে কান ধরে উঠ-বস করার ঘটনা সবার মনে আছে। মোবাইল কোর্টে এরূপ অমানবিক দণ্ড দেয়ায় যশোরের একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটকে দেশব্যাপী ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছিল। পরে তাকে প্রত্যাহার করে তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছিল। আমাদের দেশের আইন এরূপ হেয় করার মত, সামাজিকভাবে অসম্মানজনক করার মত, অমর্যাদাকর ও মানহানিকর দণ্ড প্রদান সমর্থন করে না। এটি আমাদের পবিত্র সংবিধানের ৩৫ অনুচ্ছেদের পরিপন্থী। মানবাধিকারের সার্বজনীন ঘোষণাপত্রের ৫ ধারাতেও বলা আছে কারো প্রতি নিষ্ঠুর, অমানবিক বা অবমাননাকর আচরন করা যাবে না বা কাউকে এরূপ শাস্তি দেয়া যাবে না। তাছাড়া বাংলাদেশ নির্যাতন এবং অন্যান্য নিষ্ঠুর, অমানবিক অথবা মর্যাদাহানিকর আচরন বা শাস্তির বিরুদ্ধে কনভেনশন, ১৯৮৪ এবং আইসিসিপিআর, ১৯৬৬ তে স্বাক্ষর করেছে। শেষ সনদের ৭ অনুচ্ছেদে কারো প্রতি নির্যাতন, নৃশংস, অমানবিক বা অসম্মানজনক আচরণ করাকে করাকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
তাহলে প্রবেশনের শর্তাবলী কেমন হওয়া উচিত? একটি আদর্শ প্রবেশন ব্যবস্থা স্ব স্ব সমাজের মূল্যবোধ এবং আচার ও প্রথার আলোকে অপরাধীর উপর এমন শর্ত আরোপ করবে যা তার চারিত্রিক সংশোধনের জন্য বিশেষ কার্যকর ভূমিকা পালন করবে। ১৯৭১ সালের বাংলাদেশ প্রবেশন অব অফেন্ডার্স বিধিমালার ‘সি’ ফরমে উল্লেখিত শর্তগুলো অধিকাংশ অপরাধীকে পরিবর্তনের জন্য যথেষ্ট হতে পারে। মামলার প্রকৃতি অনুসারে ২/১ টি শর্ত সংযোজন অনেক কার্যকরী হতে পারে। আব্দুল খালেক বনাম হাজেরা বেগম; ৫৮ ডিএলআর (হাইকোর্ট) ৩২২ মামলায় মহামান্য হাইকোর্ট ভবিষ্যতে অপরাধ করবে না বলে অপরাধীকে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হওয়া, প্রবেশনকালীন সময়ে ভাল ব্যবহার ও শান্তি বজায় রাখার প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হওয়া ইত্যাদি সহজ শর্তের পাশাপাশি ভিকটিমও যাতে ন্যায় বিচার থেকে বঞ্চিত না হয় সেজন্য ভিকটিমকে ক্ষতিপূরণ প্রদানের আদেশও প্রদান করেছিলেন। কারণ অপরাধের শিকার ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিরা শুধু শারীরিক ও মানসিকভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত হয় না, প্রকৃতপক্ষে তারা আর্থিকভাবেও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এজন্য প্রবেশন ব্যবস্থা অপরাধী সংশোধনের পাশাপাশি ভিকটিম সংশ্লিষ্ট মামলাগুলোতে যেন তারা কোনভাবেই ক্ষতিগ্রস্থ না হয় সেজন্য তাদের ক্ষতিপূরণের বিষয় নিয়েও কাজ করে।
আধুনিক প্রবেশন ব্যবস্থায় উভয়পক্ষের মধ্যে সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ভিকটিমের কাছে ক্ষমা চাওয়ার শর্ত জুড়ে দেয়া হয়। অপরাধী যদি তার কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত হয়ে ক্ষমা চায় তাহলে অধিকাংশ ক্ষেত্রে এর সুফল পাওয়া যায়। Commonwealth v. Sean P. Lally; 55 Mass. App. Ct. 601; 773 N.E.2d 985; 2002 Mass. App. LEXIS 1093 মামলায় অন্যান্য শর্তের মধ্যে ভিকটিম বা অপরাধীর স্ত্রীকে পুনরায় নির্যাতন না করার শর্তে প্রবেশন দেয়া হয়েছিল। প্রবেশনের এরূপ শর্ত ভিকটিমকে যথেষ্ট সুরক্ষা দেয়। আবার বিপরীতমূখী শর্তও ভিকটিমকে সুরক্ষা দিতে পারে। যেমন: ভিকটিম থেকে দূরে থাকা এবং তার সাথে যোগাযোগ না রাখা (Commonwealth v. Paul Macdonald; 435 Mass. 1005; 757 N.E.2d 725; 2001 Mass. LEXIS 641)। মামলা ভেদে এরূপ ভিন্ন ভিন্ন শর্ত ভিকটিমের অধিকার নিশ্চিত করতে পারে।
বিবেচনামূলক শর্তের ব্যাপক প্রয়োগ হয়েছে মতি মাতবর বনাম রাষ্ট্র; ৭৩ ডিএলআর (হাইকোর্ট) পৃষ্ঠা ৮৯ মামলায়। এই মামলায় মহামান্য হাইকোর্ট যে সব শর্তারোপ করেছিলেন সেগুলো হচ্ছে, প্রবেশনকালীন সময়ে তার পরিবারের নির্ভরশীলদের প্রতি যত্নশীল হওয়া এবং পারিবারিক বন্ধন বজায় রাখা, তার সাথে বসবাসরত বৃদ্ধা মাতার প্রতি যত্নশীল হওয়া, তার স্কুলে যাওয়া ছেলে মেয়েদের প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়ার অগ্রগতি নিশ্চিত করা মায়ের সেবা করা, আইন অনুযায়ী বয়স না হওয়া পর্যন্ত মেয়ের বিয়ে না দেয়া, চিকিৎসকের পরামর্শ ব্যতীত কোন মাদকদ্রব্য ব্যবহার বা সেবন করবেন না এবং ছয় মাস পর পর ডোপ টেস্ট দেয়া ইত্যাদি।
ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় দেখেছি, শিক্ষিত প্রবেশনারদের ৬-১০ টি দেশাত্নবোধক, নৈতিক শিক্ষা এবং মনীষীর জীবনী গ্রন্থ পড়তে দেয়া দারুণ কার্যকরী। প্রতিটি বই পড়ার পর তিনি প্রবেশন অফিসারকে অনধিক ২০০ শব্দের মধ্যে সারমর্ম লিখে দিতে পারেন। প্রবেশন অফিসার সেগুলো চূড়ান্ত অব্যাহতির শুনানীকালে আদালতে দাখিল করতে পারেন। এভাবে সত্যিকারের ফলোআপটা হয়। শিক্ষিত প্রবেশনারদের বয়স্ক শিক্ষা কার্যক্রমে সম্পৃক্ত করা যেতে পারে। যারা পড়ালেখা জানে না তাদের পড়ালেখা শেখার শর্ত দেয়া যেতে পারে। শেখা মানে শুধু রিডিং পড়তে ও লিখতে পারলেই যথেষ্ট। প্রথম শ্রেণীর পাঠ্যবই উপকারী হতে পারে। তাদেরকে সরকারী বা বেসরকারী কোনো জীবনমুখী কোনো প্রশিক্ষণ গ্রহণ করার শর্ত দেয়া যেতে পারে। যদি নির্দিষ্ট সময়ের পূর্বেই প্রবেশনার সকল শর্ত পূরণ করেন, তার আচরণ সন্তোষজনক হয় তবে খুব ব্যতিক্রমসাপেক্ষে প্রবেশন আদেশ ও মুচলেকা খারিজ করতে পারেন (১০ ধারা)। তবে একবার প্রবেশনে দেয়ার পর তাকে কোনো অবস্থাতেই আবার ৪ ধারার অধীনে কন্ডিশনাল ডিসচার্জ করা যাবে না।
আবার যদি এমন হয় সবগুলো নতুন নতুন শর্ত দেয়া হলো কিন্তু নিয়মিত ফলোআপ দেয়া হলো না। নির্দিষ্ট বিরতিতে অগ্রগতি প্রতিবেদন নেয়া হলো না। তাহলে ফলাফল শূণ্য। আরেকটি বিষয় হচ্ছে চমক লাগানো নতুন নতুন শর্তারোপ করে প্রবেশন দেয়া বড় কথা নয়, প্রবেশন কেসটা সফলভাবে সমাপ্ত করা বড় কথা। আরো বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে প্রবেশন পরবর্তী সময়ে অপরাধী অপরাধের পুনরাবৃত্তি ঘটাচ্ছে কিনা।
প্রবেশনের অপর নাম সংশোধনের সুযোগ। এই সুযোগ যেন হয় সহজ, সরল ও স্বাভাবিক। বিবেচনামূলক শর্তগুলোর ক্ষেত্র উন্মুক্ত হলেও তা অসীম নয়। এই শর্তগুলো ভেবে চিন্তে আরোপ করতে হবে। বিচারিক চিন্তা প্রয়োগ করতে হবে। দ্য টোকিও রুলস অনুসারে অপরাধীকে দেয়া এই শর্তগুলো যেন বাস্তবসম্মত, সংক্ষিপ্ত এবং তুলনামূলক কম হয় মর্মে উল্লেখ করা আছে। এরূপ শর্ত আরোপের সময় সমাজের চাহিদা, অপরাধী ও ভিকটিমের চাহিদা এবং তাদের অধিকার উভয়ই বিবেচনা করার কথা বলা হয়েছে। অপরাধ বিজ্ঞানী Walter C. Recless বলেছেন, প্রবেশন হচ্ছে কোর্ট কর্তৃক দণ্ডের বোঝা না চাপানো এবং দণ্ডের কষ্ট থেকে অপরাধীকে অব্যাহতি দান। তাই আমাদের শর্তারোপ করার সময় মনে রাখতে হবে দণ্ডের বোঝার চেয়ে শর্তের বোঝা যেন বেশী ভারী না হয়ে যায়। প্রবেশনার যেন কখনো না ভেবে বসে প্রবেশনের শর্ত মানার চেয়ে জেলে থাকাই ভালো।
(বি . দ্র. লেখার প্রথম প্যারার চরিত্র ও ডায়ালগ কাল্পনিক। লেখার কোনো অংশের সাথে কারো মিলে গেলে তা কাকতালীয়। কারো সাথে মিলে গেলে আন্তরিকভাবে দুঃখিত )
লেখক: যুগ্ম জেলা জজ, কুড়িগ্রাম।