পুরোনো মামলা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নিষ্পত্তিতে অধস্তন আদালতের বিচারকদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। ঐ নির্দেশনা অনুযায়ী ১০ বছরের অধিক পুরোনো দেওয়ানি ও ফৌজদারি মামলাসমূহ, আপিল ও রিভিশনসমূহ অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নিষ্পত্তি করা হবে। সুপ্রিম কোর্ট থেকে অধস্তন আদালতের সকল পর্যায়ের বিচারকদের জন্য সম্প্রতি একগুচ্ছ নির্দেশনা দেওয়া হয়।
বিচারাঙ্গনের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বছরের পর বছর দেশের আদালতসমূহে মামলার জট বেড়েই চলেছে। নানা উদ্যোগ নেওয়ার পরেও মামলা নিষ্পত্তির হার বাড়লেও কোনোভাবেই জট কমানো সম্ভব হচ্ছে না। সে জন্য দ্রুত মামলা নিষ্পত্তি করে জট কমানোই এই নির্দেশনার উদ্দেশ্য।
তবে আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে বিচারকের প্রচুর সংকট রয়েছে। এই সংকট দূর করা না হলে মামলার জট হ্রাসে যে কোনো উদ্যোগ সফলতার মুখ না-ও দেখতে পারে। সে জন্য দেশের উচ্চ ও অধস্তন আদালতে বিপুলসংখ্যক বিচারক নিয়োগ দেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন তারা।
মামলাজট নিরসন ও দ্রুত বিচার নিশ্চিতে প্রধান বিচারপতির উদ্যোগ
চলতি বছরের শুরুতে দেশের ২৩তম প্রধান বিচারপতি হিসেবে দায়িত্ব নেন বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী। এরপরই মামলাজট নিরসনে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে দেখা যায় তাকে। এর মধ্যে দেশের আট বিভাগের অধস্তন আদালতের মামলা নিষ্পত্তি মনিটরিংয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয় হাইকোর্টের আট বিচারপতিকে। বিভিন্ন পর্যায়ের অধস্তন আদালতের বিচারকেরা দ্রুত মামলা নিষ্পত্তি করতে গিয়ে যেসব সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছেন, তা অবহিত করেন মনিটরিং কমিটির বিচারপতিদের।
মনিটরিং কমিটির বিচারপতিরা তখন অধস্তন আদালতের বিচারকদের দ্রুত নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে নির্দেশনা দেন। এছাড়া মাস শেষে প্রধান বিচারপতিকে তারা রিপোর্ট দিয়ে থাকেন। গত জানুয়ারি মাসে এই কমিটি গঠনের পর মার্চ মাসে তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন প্রধান বিচারপতি। ঐ বৈঠকের পরই নিম্ন আদালতে বিচারাধীন মামলার জট হ্রাস ও মামলা নিষ্পত্তিতে দীর্ঘসূত্রতা পরিহার তথা দ্রুত বিচার নিশ্চিতকরণে সাত দফা নির্দেশনা প্রদান করেন প্রধান বিচারপতি।
নির্দেশনাগুলো নিম্নরূপ
১. সকল অধস্তন আদালত/ট্রাইব্যুনালে কর্মরত বিচারকদের নির্দিষ্ট সময়ে এজলাসে উঠা, নির্দিষ্ট সময়ের পূর্বে এজলাস ত্যাগ না করা এবং এজলাসে সময়ের সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করার জন্য সচেষ্ট থাকতে হবে।
২. পারিবারিক মোকদ্দমাসমূহ দ্রুত ও সুষ্ঠুভাবে নিষ্পত্তির স্বার্থে জেলার সকল সহকারী জজ/সিনিয়র সহকারী জজ আদালতে বিচারাধীন পারিবারিক মোকদ্দমার সংখ্যা ৩০০ বা তদুর্ধ্ব হলে জেলার অতিরিক্ত সহকারী জজ কর্মরত থাকলে উক্ত অতিরিক্ত সহকারী জজ আদালতে সকল আদালতের বিচারাধীন পারিবারিক মোকদ্দমা বদলি করে উক্ত অতিরিক্ত সহকারী জজের আদালতকে কেবলমাত্র পারিবারিক আদালতরূপে কার্যকর করার জন্য সংশ্লিষ্ট জেলা জজ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।
তবে শর্ত থাকে যে, কোন জেলায় সহকারী জজ অতিরিক্ত আদালত না থাকলে ওই জেলার সহকারী জজ আদালতসমূহের মধ্যে যে আদালতে মোকদ্দমার সংখ্যা তুলনামূলক কম অনুরূপ আদালতে অন্যান্য আদালতের পারিবারিক মোকদ্দমাসমূহ স্থানান্তর করার জন্য সংশ্লিষ্ট জেলা জজ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।
এছাড়া, জেলায় কর্মরত লিগ্যাল এইড অফিসার উক্ত পারিবারিক আদালত কর্তৃক প্রেরিত বিচারাধীন মোকদ্দমাসমূহ মধ্যস্থতার মাধ্যমে নিষ্পত্তির জন্য নিবিড়ভাবে কার্যক্রম পরিচালনা করবেন।
৩. সারাদেশে বিভিন্ন দেওয়ানি আদালতে ডিক্রিজারি মোকদ্দমাসমূহ নিষ্পত্তিতে দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হচ্ছে। এমতাবস্থায়, দেওয়ানি আদালতের বিচারকদের যথাযথ আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করে যতদ্রুত সম্ভব ডিক্রিজারি মোকদ্দমা নিষ্পত্তি করবেন।
৪. সারাদেশে বিভিন্ন দেওয়ানি আদালতে একতরফা মোকদ্দমাসমূহ নিষ্পত্তির জন্য দীর্ঘদিন ধরে বিচারাধীন রয়েছে, উক্ত মোকদ্দমাসমূহ যথাযথভাবে সমন জারিসহ অন্যান্য আইনগত প্রক্রিয়া সম্পন্ন হলে দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন।
৫. দশ (১০) বছরের অধিক পুরাতন দেওয়ানি ও ফৌজদারি মোকদ্দমা/মামলাসমূহ, আপিল ও রিভিশনসমূহ অগ্রাধিকার ভিত্তিতে দ্রুত নিষ্পত্তি করবেন।
৬. দায়রা জজ/মহানগর দায়রা জজ এর বিচারিক আদালতের মামলাসমূহ দ্রুত ও সুষ্ঠুভাবে নিষ্পত্তির স্বার্থে কোন দায়রা জজ/মহানগর দায়রা জজ আদালতে দৈনিক ৪০ এর অধিক সংখ্যক জামিন সংক্রান্ত ফৌজদারি বিবিধ মামলা দায়ের হলে উক্ত ৪০ এর অধিক সংখ্যক ফৌজদারি বিবিধ মামলাসমূহ নিষ্পত্তির জন্য অতিরিক্ত দায়রা জজ আদালত/ অতিরিক্ত মহানগর দায়রা আদালতে বদলি করবেন।
৭. দেশের সকল জেলা জজ/দায়রা জজ বিদ্যমান আইন ও বিধি বিধান সাপেক্ষে তাঁর প্রশাসনিক এখতিয়ারাধীন সকল আদালত/ট্রাইব্যুনালে মামলা, আপিল বা অন্য যে কোন আইনগত কার্যধারা বদলি করে সকল আদালত/ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা যুক্তিসম্মত করবেন।
বিচারাধীন মামলার সংখ্যা নির্ধারণ
দেশের অধস্তন প্রতিটি দেওয়ানি ও ফৌজদারি আদালত এবং ট্রাইবু্যনালে বিচারাধীন মামলার প্রকৃত সংখ্যা নির্ধারণের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। মামলার নথি গণনাপূর্বক এই সংখ্যা নির্ধারণ করতে বলা হয়েছে। এছাড়া পুলিশ বা অন্য কোনো তদন্তকারী সংস্হার নিকট তদন্তাধীন মামলার প্রকৃত সংখ্যা পৃথকভাবে নির্ধারণ করে পাঠানোরও নির্দেশ দিয়েছেন প্রধান বিচারপতি।