খুরশীদ কামাল তুষার
খুরশীদ কামাল তুষার

বৈধ সন্তান ও সাক্ষ্য আইনের ১১২ ধারা

খুরশীদ কামাল তুষার: এই পৃথিবীতে যখন একটি সন্তান ভূমিষ্ট হয়, তখন জন্মের সাথে সাথেই তার মায়ের পরিচয় স্পষ্ট হলেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে সদ্যজাত সন্তানটির পিতৃ-পরিচয় কি তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। এখানেই নির্ধারিত হয়, সন্তান বৈধ নাকি অবৈধ। আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় যেকোন স্থানে পরিচয়, পরিবার ও গোত্র নির্ধারণ, খোরপোশ ও সম্পত্তিতে অধিকার করা সমস্ত ক্ষেত্রেই একটা মানুষের পিতার পরিচয় জানা অপরিহার্য।

সাধারণত দুজন নারী-পুরুষের বিবাহ বলবত থাকাকালীন অথবা বিবাহ বিচ্ছেদের পর একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ভূমিষ্ঠ হওয়া সন্তানকেই বৈধ সন্তান বলা হয়। কোন কারণে সন্তানের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠলে আইনগতভাবে সমাধানের যে ব্যবস্থা তা মূলত সাক্ষ্য আইনের ধারা ১১২ কে অনুসরণ করে গ্রহণ করা হয়। উল্লেখ্য, বাংলাদেশ ও ভারত উভয় দেশেই সাক্ষ্য আইন, ১৮৭২ প্রচলিত।

কি বলে সাক্ষ্য আইন, ১৮৭২ এর ধারা ১১২?

সাক্ষ্য আইন, ১৮৭২ এর ধারা ১১২ বলে ‘কোনো ব্যক্তির মাতার সহিত এক ব্যক্তি আইনত সিদ্ধ বিবাহ কায়েম থাকাকালে অথবা বিবাহবিচ্ছেদের পর দুইশ আশি দিনের মধ্যে তাহার মাতা অবিবাহিতা থাকলে যদি তাহার জন্ম হইয়া থাকে এবং যদি ইহা দেখানো না হয় যে, ওই ব্যক্তি মাতৃগর্ভে আসিয়া থাকিতে পারে অনুরূপ কোনো সময়ে বিবাহিত পক্ষদ্বয়ের পরস্পরের মধ্যে মিলনের পথ উন্মুক্ত ছিলনা, তবে সে যে জন্মিয়াছে এই বিষয় দ্বারা অবশ্যই চূড়ান্তভাবে প্রমাণিত হইবে যে, সে উক্ত ব্যক্তির বৈধ সন্তান।’

এই ধারা অনুযায়ী সন্তানের বৈধতা তিনটি বিষয় বিবেচনায় নেওয়া হয়। যথা: ১. কোন ব্যক্তির সাথে কোন নারীর আইনতঃ বৈধ বিবাহ বলবত থাকাকালীন ঐ নারীর গর্ভজাত সন্তান বৈধ। ২. বিবাহ বিচ্ছেদের দুইশত আশি দিনের মধ্যে ভূমিষ্ঠ হওয়া সন্তান বৈধ, যেক্ষেত্রে সন্তানের মা এই দুইশত আশি দিনের মধ্যে পুনরায় বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়নি এবং ৩. সন্তান মাতৃগর্ভে এসেছে বলে ধরে নেয়া হয় এরকম সময়ের মধ্যে বিবাহিত নারী-পুরুষ পরস্পরের মধ্যে মিলিত হবার সুযোগ ছিল না।

উল্লেখ্য, দাম্পত্য জীবন চলমান থাকাকালে জন্মানো সন্তান মাত্রই বৈধ সন্তান, তবে যদি কোন পক্ষ এরকম সন্তানের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে বা সন্দিহান হয়, সেক্ষেত্রে যে পক্ষ সন্দেহ প্রকাশ করে, সন্তান অবৈধ, প্রমাণ করার দায়িত্ব ঐ পক্ষেরই। অনেক সময় সন্তানের পিতার পরিবার এরকম সন্দেহ প্রকাশ করে থাকে। অর্থাৎ ঐ পিতা বাবা কথিত স্বামী যথেষ্ট, দৃঢ় এবং সন্তোষজনক সাক্ষ্য ও প্রমাণ উপস্থাপন করে প্রমাণ করবে যে তার স্ত্রীর গর্ভধারণের সময় বা তার আগে থেকেই তাঁদের মধ্যে কোন ধরণের সংযোগ বা যোগাযোগ ছিলনা যার জন্য ঐ নারী গর্ভবতী হতে পারে।

এই ধারার অধীনে, সন্তান কখন মায়ের গর্ভে এসেছে তা মূখ্য নয়, বরং সন্তানের ভুমিষ্ট হওয়ার সময়টিই মূখ্য বিষয় বলে বিবেচিত হয়। এই ধারা আইনত এটাই স্থাপন করতে চায় যে, সন্তান অবৈধ হওয়ার চূড়ান্ত সন্তোষজনক প্রমাণ না আসা পর্যন্ত দাম্পত্য জীবন চলমান থাকাকালে জন্মানো সন্তান মাত্রই বৈধ এবং এটি সার্বজনীন নীতি নৈতিকতার ধারণার ওপরই প্রতিষ্ঠিত।

সাক্ষ্য আইনের ১১২ ধারার ফলাফল ও প্রভাব

এই ধারা গর্ভধারণের সময়কে প্রাধান্য না দিয়ে সন্তান ভূমিষ্ঠ হবার সময়কে প্রাধান্য দেয়। যার ফলস্বরুপ, কোন নারী অবিবাহিত অবস্থায় যদি সন্তান ধারণ করে এবং সন্তান ধারণের পর বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়, তবে জন্ম লাভ করা উক্ত সন্তান তার স্বামীর বৈধ সন্তান বলে ধরে নেয়া হয়। যা ধর্মীয় আইনে মোটেই বৈধ বলে স্বীকার করা হয় না। আবার যদি বিবাহ বিচ্ছেদের ২৮০ দিনের মধ্যে নারী পুনরায় বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয় তবে জন্ম লাভ করা সন্তান দ্বিতীয় স্বামীর বৈধ সন্তান বলে বিবেচিত হবে, প্রথম স্বামীর নয়। যদি কোন সন্দেহের প্রকাশ না ঘটে তবে স্বামীর মৃত্যুর ২২৩ দিনের মধ্যে জন্মলাভ করা সন্তান বৈধ সন্তান বলে বিবেচিত হয়।

সন্তানের বৈধতার প্রশ্নে আদালতের সিদ্ধান্ত

সন্তানের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠলে তা বেশিরভাগ সময়ই আদালতে গড়ায়। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন মামলায় সন্তানের বৈধতা নির্ধারণে আদালত আইনি ব্যাখ্যা ও ন্যায়পরায়ণ বিচারিক নীতি প্রয়োগ করে সিদ্ধান্ত দিয়েছে।

২০০৬ সালে শেখ ফারুক উদ্দিন বনাম শেখ মোহম্মদ হাসান মামলায় ভারতের একটি আদালত সন্তানের বৈধতার চূড়ান্ত প্রমাণকে খণ্ডন করতে ডিএনএ পরীক্ষার বিধানকে স্বীকৃতি না দিয়ে বরং শুধুমাত্র পক্ষদ্বয়ের মধ্যে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকাকে প্রমাণ করতে বলেছেন।

১৯৯৩ সালে তুষার রায় বনাম শুক্লা রায় মামলায় কোলকাতা হাইকোর্ট এই রায় দেন যে, আইনত বৈধ দাম্পত্য চলাকালীন জন্মলাভ করা সন্তানের বৈধতার প্রশ্নে রক্তের গ্রুপ পরীক্ষার দ্বারা সিদ্ধান্ত গ্রহণ বৈধ নয় এবং তা সাক্ষ্য আইন ১৮৭২ এর ১১২ ধারার পরিপন্থী।

চূড়ান্ত প্রমাণের ধারণা ও আইনের সীমাবদ্ধতা

সাক্ষ্য আইনের ১১২ ধারা চূড়ান্ত প্রমাণের পর্যায়ে আলোচিত হয়। সাক্ষ্য আইনের ব্যাখ্যা অনুচ্ছেদ ধারা ৪ এ চূড়ান্ত প্রমাণকে এভাবে সজ্ঞায়িত করা হয়েছে যে, দুইটি পররস্পর সম্পর্কীত বিষয়ের একটি প্রমাণিত হলেই অপর বিষয়টি চূড়ান্তভাবে প্রমাণিত বলে আদালত প্রতিষ্ঠিত করবে এবং তা খণ্ডনের আর কোন সুযোগ অপর পক্ষ পাবে না।

সাক্ষ্য আইনের ১১২ ধারায় বিবাহ বলবত অবস্থায় জন্মলাভ করা সন্তান ঐ দম্পতির বৈধ সন্তান বলে চূড়ান্তভাবে কোর্ট ধরে নেয় এবং এই চূড়ান্ত প্রমাণকে খণ্ডন করার একমাত্র উপায় হলো  স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকা প্রমাণ করা, অন্য কোন উপায় যেমন: রক্তের গ্রুপ পরীক্ষা বা ডিএনএ পরীক্ষার কোন সুযোগ আইন দেয়না।

এমন অনেক সময় হতে পারে যে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে যোগাযোগ চলমান থাকা অবস্থায় স্ত্রীর চরিত্র নিয়ে স্বামী প্রশ্ন তুলতে পারে এবং স্ত্রীর গর্ভজাত সন্তান অন্যকারোর এমন দাবী স্বামী করতে পারে। কিন্তু শুধুমাত্র সংযোগহীনতা প্রমাণে ব্যর্থ হওয়ায় স্বামীকে ঐ সন্তান নিজের বলে মেনে নিতে হয়। আর এর ফলে পারিবারিক কলহ সৃষ্টি হতে পারে এমনকি তা সন্তানের জীবনের জন্যেও হুমকির কারণ হতে পারে। তাই কিছু ব্যতিক্রম বিবেচনা করে আদালতকে রক্তের গ্রুপ বা ডিএনএ পরীক্ষার বিধান দেওয়া উচিত এবং প্রয়োজনে এই বর্ষীয়ান আইনের ধারাটি সংশোধন করা উচিত।

নিঃসন্দেহে সাক্ষ্য আইনের ১১২ ধারা একটি অতিগুরুত্বপূর্ণ বিধান। তবে এতে স্পষ্টতঃ কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে যা নিরসন করা এখন সময়ের দাবী। ভারতের আইন কমিশন ২০০৩ সালে এই ধারা সংশোধনের নিমিত্তে বিল পাশ করে পিতার জন্য আধুনিক বিভিন্ন পরীক্ষা করার অনুমতি দিলেও বাংলাদেশে এরকম কোন উদ্যোগ ই গ্রহন করা হয়নি। বর্তমান সময়ে এসে আইনের এসব ফাঁক-ফোঁকর যদি দ্রুত বন্ধ করা না হয় তবে তা ন্যায়বিচারের ক্ষেত্রে বড় বাধা হয়ে থাকবে এবং তা অনেক সময় পারিবারিক বন্ধনে চিড় ধরিয়ে একসময় সমাজব্যাবস্থাকেই হুমকির মুখে ফেলতে পারে।

লেখক: শিক্ষার্থী; আইন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।