মো: সালাউদ্দিন সাইমুম: আইনের জনক মার্কাস টুলিয়াস সিসেরো সর্বকালের অন্যতম সেরা একজন আইনবিদ। রোম হতে প্রায় সত্তর মাইল দূরে অবস্থিত শহর আর্পিনামে ১০৬ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে তিনি জন্ম গ্রহণ করেন। সব্যসাচী ক্ষণজন্মা এ ব্যক্তি ছিলেন একাধারে একজন রাজনৈতিক তাত্ত্বিক, আইনজীবী, বিচারক, দার্শনিক, বাগ্মী, দূত এবং সংবিধানপ্রণেতা।
সিসেরো আইনকে প্রকৃতির অন্তর্নিহিত সবচেয়ে বড় যুক্তি হিসেবে দেখেছেন। তিনি মনে করতেন, আইন রাষ্ট্রজাত কোনো বিষয় নয়, উহা ব্যক্তির যৌক্তিক মননের ফসল। তার মতে মানবিক যৌক্তিকতাবোধের নির্যাস থেকেই আইনের আবির্ভাব। কোনটা করা উচিত এবং কোনটা পরিহার করা উচিত সেটি বাতলিয়ে দেয় আইন। আইনকেই তিনি সকল যুক্তির সেরা যুক্তি মনে করতেন। লঘুপাপে গুরুদন্ডের ঘোর বিরোধী ছিলেন বলেই অপরাধের মাত্রা অনুসারে শাস্তির তারতম্যকে সমর্থন করে তিনি বলেন- Let the punishment fit the crime.
সিসেরো ন্যায়নীতিকে রাষ্ট্রের মৌল ভিত্তি মনে করতেন। সুযোগের সমতা এবং অধিকারের সমতা প্রতিষ্ঠায় তিনি ছিলেন বদ্ধপরিকর। তিনি প্রায়শই উচ্চারণ করতেন, ন্যায়নীতি হলো আইনের পূর্বশর্ত। বলতেন যে, প্রকৃতিকে অনুসরণ করার দ্বারাই কেবল ন্যায়ানুগ হওয়া সম্ভব। দেশ ও দশের তরে আমাদের সুমহান দায়িত্ব-কর্তব্যকে এড়িয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই-এমনটাই তিনি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন। তার অধিকাংশ লেখনীতেই আখ্যান বস্তু হিসেবে দুটো বিষয়ের অবতারণা প্রতিভাত হয়, এক. দেশের প্রতি কর্তব্য এবং দুই. মানুষের প্রতি কর্তব্য।
সিসেরো রাষ্ট্রকে জনগণের সম্পত্তি হিসেবে অভিহিত করেছেন। জনগণই যে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু সেটা তিনি তার বিভিন্ন লেখায় তুলে ধরেছেন। তিনি বলতেন, রাষ্ট্র জনগণের অধীন, রাজার অধীন নয়। সাম্য ও সমানাধিকার প্রতিষ্ঠায় তিনি আজীবন নিজেকে ব্যাপৃত রাখেন। তিনি মনে করতেন, প্রকৃতি সকল মানুষকে সমানভাবে সৃষ্টি করেছে, প্রকৃতি সৃষ্ট স্বাভাবিক সমতা নীতিতে তাই তার ছিলো অগাধ বিশ্বাস।
তবে সিসোরে আইনের সংখ্যাধিক্যের বিষয়ে নেতিবাচক ধারণা পোষণ করতেন। তিনি বলতেন- The more laws, the less justice. অর্থাৎ আইনের সংখ্যা যতবেশি বৃদ্ধি পাবে ন্যায়বিচার প্রাপ্তির হার ততটাই ক্ষীয়মাণ হয়ে পড়বে। আইনের আধিক্যের চেয়ে আইনের যথাযথ প্রয়োগে তিনি গুরুত্বারোপ করার বিশেষ তাগিদ দেন। তার মতে রাষ্ট্রের সুমহান দায়িত্ব হলো আইনকে সমুন্নত রাখা।
তিনি মনে করতেন, ন্যায়বিচার তাহাই যা প্রকৃতিদত্ত এবং মানুষের সহজাত গুণাবলী থেকেই উৎসরিত। তার কাছে ন্যায়বিচার কোনো বিমূর্ত অভিমতের বিষয় ছিলোনা, কার্যত ও দৃশ্যমান ন্যায়বিচারের ওপরই কেবল তার আস্থা ছিলো।
তার অভিমত অনুসারে ন্যায়বিচারের ধারণাটি চতুর্মাত্রিক-
১। যথোপযুক্ত হেতু ছাড়া আইনের লঙ্ঘন না ঘটানো
২। প্রতিজ্ঞা তথা অঙ্গীকারের যথাযথ প্রতিপালন
৩। ব্যক্তিগত সম্পত্তি ও যৌথ সম্পত্তির সুরক্ষা
৪। সাধ্যানুযায়ী অপরাপর ব্যক্তিবর্গের হিত সাধন
যতদূর জানা যায়, আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ৮০ অব্দে, সিসেরো যখন ২৬ বছরের টগবগে যুবক, ঠিক তখনই আর্পিনামে তার আইন পেশায় আগমন। আর শুরুতেই বাজিমাত করেন একটি নিশ্চিত হেরে যাওয়া মামলা জয়ের দ্বারা।তারই ধারাবাহিকতায় একের পর এক চাঞ্চল্যকর মামলায় জয়লাভ তাকে আকাশছোঁয়া সাফল্য এনে দেয়। ন্যায়বিচার প্রার্থীরা তার দরজায় কড়া নাড়তে থাকে। দিকে দিকে এমন কথা রটে যায়, যে কোনো অসম্ভব মামলাও সিসেরো তুড়ি দিয়ে বাগিয়ে নিতে পারেন। কথিত আছে পেশাগত জীবনে মামলায় ব্যর্থতার গ্লানি তাকে স্পর্শ করতে পারেনি।
ইতিহাসবিদের মতে, পৃথিবীর ইতিহাসে সিসেরোই অন্যতম শ্রেষ্ঠ বাগ্মী। আদালতে তার যুক্তিতে ঠাসা তীক্ষ্ম ক্ষুরধার বক্তৃতাগুলো মন্ত্রমুগ্ধের মতোই শুনতেন তৎকালীন জুরিরা। আইনজীবীদের জন্য সিসেরোর বক্তৃতাগুলোর সুখ্যাতি প্রবাদতুল্য।সিসেরোর আইন বিষয়ক লেখাগুলো থেকে প্রাচীন রোম এবং অন্যান্য অঞ্চলের আইনকানুন সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যায়।
জনদরদী সিসেরো সবসময় জনবান্ধব আইনের কথা বলতেন। জনকল্যাণকেই তিনি আইনের মুখ্য উদ্দেশ্য মনে করতেন। এ প্রসঙ্গে তার বহুল ঊদ্ধৃত একটি বাণীর অবতারণা করা যেতে পারে- ‘salus populi suprema lex’– let the welfare of the people be the ultimate law. ‘ডিলেগিবাস’ নামে আইনের ওপর এক অনন্য সাধারণ ভাষ্য তিনি লিখেছিলেন। সিসেরো প্রাকৃতিক আইন মতবাদের প্রবক্তাগণের মধ্যে অন্যতম। তিনি বলতেন, আইন আসলে প্রকৃতির সাথে চুক্তিবদ্ধ হবার যুক্তি। আইন ও নৈতিকতা যেখানে একে অপরকে ছেদ করে সেখানেই প্রাকৃতিক আইনের স্থান। এ মতবাদের সার কথা হলো- তাই হওয়া উচিৎ যা স্বাভাবিকভাবে বা প্রাকৃতিক ভাবে হয়ে থাকে। প্রাকৃতিক আইন সার্বজনীন, অবিচ্ছেদ্য এবং অলঙ্ঘনীয়।
মহান আইনবিদ সিসেরো দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন যে, মানবতার বিজয়কেতন সেদিনই উত্থিত হবে যেদিন সত্যিকারের ন্যায়পর সমাজ প্রতিষ্ঠিত হবে। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, এই অসম্ভব গুণী মানুষটিকে নির্মমভাবে শিরশ্ছেদ করা হয়। সিসেরো আজ নেই কিন্তু আইনে তার অবদান অদ্যাবধি সমুজ্জ্বল। যতদিন আইনাঙ্গন টিকে থাকবে, আইনের শাসন থাকবে, শোনা যাবে আইনের বজ্রকণ্ঠ, ততদিন সিসেরো আমাদের মাঝে বেঁচে থাকবেন।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, আইন বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।