সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণা নিয়ে সৃষ্ট জটিলতা সমাধানে সমিতির সাবেক সহ-সভাপতি মো. অজি উল্লাহ’র নেতৃত্বে গঠিত নতুন সাব-কমিটি অবৈধ বলে দাবি করেছেন সমিতির সম্পাদক ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস (কাজল)। একইস সঙ্গে এই কমিটি কর্তৃক ভোট কাউন্টিং/নির্বাচনী ফলাফল বিষয়ে যে কোন পদক্ষেপও অবৈধ বলে মন্তব্য করেন তিনি।
এটিকে সমিতির সুমহান ঐতিহ্যকে কলঙ্কিত করার নির্লজ্জ অপচেষ্টা উল্লেখ করে এ ধরণের অবৈধ, নীতিহীন কার্যক্রম থেকে বিরত থাকার জন্য সকলের প্রতি আহ্বান জানান ব্যারিস্টার কাজল।
আজ বুধবার (২৭ এপ্রিল) সুপ্রিম কোর্টের ল’ রিপোর্টার্স ফোরামের সভাকক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তিনি এসব কথা বলেন। সংবাদ সম্মেলনে সমিতির ২০২১-২২ বর্ষের সিনিয়র সহ-সভাপতি জনাব মো. জালাল উদ্দিন, সিনিয়র সহ-সম্পাদক মাহমুদ হাসান, সদস্য এস. এম. ইফতেখার উদ্দিন মাহমুদ, পারভীন কাউসার মুন্নী ও রেদওয়ান আহমেদ রানজীব উপস্থিত ছিলেন।
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস (কাজল)। লিখিত বক্তব্যে তিনি বলেন, ‘সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির প্যাড ব্যবহার করে গত ১২ এপ্রিল কার্যকরী কমিটির সাতজন সদস্যের উপস্থিতিতে তথাকথিত ১৫তম সভায় সমিতির নির্বাচন সাব কমিটির আহ্বায়ক এ. ওয়াই. মশিউজ্জামানের পদত্যাগপত্র গ্রহণ করে সমিতির সাবেক সহ-সভাপতি মো. অজি উল্লহা’র নেতৃত্বে নতুন সাব-কমিটি গঠন করে ফরমায়েশি ফলাফল প্রকাশ করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে মর্মে বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদের প্রতি আমাদের দৃষ্টি আকৃষ্ট হলে আমি বিগত ১৪ এপ্রিল সমিতির সদস্যদের উদ্দেশে একটি সতর্কীকরণ নোটিশ জারি করি। যা মিডিয়াতে প্রকাশিত হয়। এমনি আমি সরাসরি জনাব মো. অজি উল্লাহকে বিষয়টি অবহিত করি।
গতকাল ২৬ এপ্রিল জনাব মো. অজি উল্লাহ এক সংবাদ সম্মেলন করে নিজেকে পুনরায় নির্বাচন সাব-কমিটির আহ্বায়ক দাবি করে আজ ১৭ এপ্রিল নির্বাচন সংক্রান্ত বাকী কাজ অর্থাৎ ফলাফল ঘোষণা করবেন বলে ঘোষণা করেছেন। তৎপ্রেক্ষিতে জরুরী ভিত্তিতে অত্র সংবাদ সম্মেলন আয়োজন করা হয়েছে।
প্রকৃতপক্ষে, ঐদিন অর্থাৎ ১২ এপ্রিল সমিতির কার্যকরি কমিটির কোন সভা অনুস্থিত হয়নি। সমিতির গঠনতন্ত্রের ২০ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সভাপতির সঙ্গে পরামর্শক্রমে কেবলমাত্র সম্পাদকই কোন সভা আহ্বান করতে পারেন। ২০২১-২২ কমিটির সভাপতি জনাব আব্দুল মতিন খসরু মৃত্যুবরণ করায় সিনিয়র সহ-সভাপতি জনাব জালাল উদ্দিনের সঙ্গে পরামর্শ করে সম্পাদক সভা আহ্বান করে থাকেন। গঠনতন্ত্রের ১৮ ও ১৯ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সুনির্দিষ্ট এজেন্ডাসহ অগ্রিম নোটিশ দিয়ে সম্পাদক কর্তৃক কার্যকরী কমিটির সভা আহ্বান করা হয়।
২০২১-২২ কার্যকরি কমিটির সর্বশেষ ১৩তম সভা গত ৩০ মার্চ অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত সভায় সভাপতিত্ব করেন সমিতির সিনিয়র সহ-সভাপতি জনাব মো. জালাল উদ্দিন। সভা পরিচালনা করেন সম্পাদক জনাব মো. রুহুল কুদ্দুস (কাজল)। কার্যকরী কমিটির ১৩জন সদস্য উক্ত সভায় যোগদান করেন। উক্ত সভায় জনাব এ. ওয়াই. মসিউজ্জামানের প্রদত্ত পদত্যাগ পত্র গ্রহণ না করে সমিতির নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণা বিষয়ক জটিলতা নিরসনে সাবেক সভাপতি-সম্পাদকগণকে অন্তরভুক্ত করার সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। কার্যকরী কমিটির প্রতিটি সদস্য পূর্বের সকল সভার ন্যায় উক্ত সভায় গৃহীত সিদ্ধান্তে (Resolution) স্বাক্ষর করেন।
সমিতির সাবেক সভাপতি-সম্পাদকগণের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় গত ৬ এপ্রিল। মোট ১৬ জন সাবেক সভাপতি-সম্পাদক উক্ত বৈঠকে যোগদান করেন। উক্ত বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি-সম্পাদকদের প্রতিনিধি, সাবেক সভাপতি ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন, সাবেক সভপতি এ. জে. মোহাম্মদ আলী, সাবেক সভাপতি ও বিজ্ঞ অ্যাটর্নি জেনারেল জনাব এ এম আমিন উদ্দিন ও সাবেক সম্পাদক বিচারপতি নজরুল ইসলাম চৌধুরী গত ৭ এপ্রিল জনাব এ. ওয়াই মসিউজ্জামানের সঙ্গে ফলপ্রসূ বৈঠক করেন। ফলাফল প্রকাশ প্রক্রিয়া শুরু হয়। এরপর থেকে নির্বাচনে পরাজিত সম্পাদক পদপ্রার্থী জনাব আব্দুন নূর দুলালের কতিপয় কর্মী-সমর্থক সমিতিতে এক নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করে চলেছে। চর দখলের মত সমিতির সভাপতি কক্ষকে দলীয় কার্যালয়ে রুপান্তরিত করেছে।
ফলশ্রুতিতে ফলাফল প্রকাশের আনুষ্ঠানিকতা বিলম্বিত হয়েছে। যদিও উক্ত নির্বাচনের ফলাফল সকলেরই জানা। সম্পাদক হিসেবে আমি ৩য় বারের মতো নির্নাচিত হই। শুধুমাত্র আনুষ্ঠানিক ঘোষণা বাকি থাকে।
এদিকে গত ৩০ মার্চ অনুষ্ঠিত কার্যকরি কমিটির ১৩তম সভার পর আর কোন সভা অনুষ্ঠিত হয়নি। অতীতের সকল সভা ১৩জনের উপস্থিতিতে সর্বসম্মত সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে অনুষ্ঠিত হলেও ৭ জনের উপস্থিতিতে ১৪তম সভা অনুষ্ঠান ব্যতিরেকে কথিত ১৫তম সভা অনুষ্ঠান হাস্যকর। এছাড়া কার্যকরী কমিটির সিদ্ধান্ত কখনো সমিতির প্যাডে লেখা হয় না।
গঠনতন্ত্রের উপরোক্ত সুনির্দিষ্ট বিধান থাকা সত্ত্বেও সমিতির সিনিয়র সহ-সভাপতি জনাব মো. জালাল উদ্দিন, সম্পাদক রুহুল কুদ্দুস (কাজল), সিনিয়র সহ-সম্পাদক জনাব মাহমুদ হাসান, সদস্য এস. এম. ইফতেখার উদ্দিন মাহমুদ, সদস্য পারভীন কাউসার মুন্নী ও সদস্য রেদওয়ান আহমেদ রানজীবের অগোচরে অপর সহ-সভাপতি জনাব মুহাম্মদ শফিক উল্যাহ’র সভাপতিত্বে ও জুনিয়র সহ-সম্পাদক সাফায়েত সুলতানা রুমি’র পরিচালনায় গত ১২ এপ্রিল অনুষ্ঠিত তথাকথিত সভার কোন আইনগত ভিত্তি নেই। কাজেই উক্ত সভায় গৃহীত যে কোন সিদ্ধান্ত অবৈধ।
এছাড়া, ২০২১-২২ কার্যকরী কমিটির সহ-সভাপতি জনাব মুহাম্মদ শফিক উল্যা নিজে জনাব এ. ওয়াই মসিউজ্জামানের নেতৃত্বাধীন নির্বাচন সাব-কমিটির একজন সদস্য। কাজেই তার সভাপতিত্বে কোন সভা আহ্বান, নির্বাচন সাব-কমিটি বাতিলকরণ, আবার নিজেকেই তথাকথিত নতুন সাব-কমিটির সদস্য ঘোষণা করাটা যে কতটা উদ্দেশ্যমূলক তা সহজেই অনুমেয়। কথিত কমিটির সকল সদস্য বঙ্গবন্ধু আওয়ামী আইনজীবী পরিষদের সদস্য, কয়েকজন ডিএজি/এএজি। যারা প্রতিনিয়ত নির্বাচনে পরাজিত সম্পাদক পদপ্রার্থী জনাব আব্দুন নূর দুলালকে সম্পাদক হিসেবে ঘোষণা করার জন্য সভা সমাবেশ করে বক্তৃতা-বিবৃতি দিয়ে থাকে। হাতুড়ী হামলায় অংশ নিয়েছে। কথিত নির্বাচন সাব-কমিতির একজন সদস্য, সমিতির সাবেক সহ-সভাপতি জনাব মো. মনিরুজ্জামান আবার বিগত ৬ এপ্রিল অনুষ্ঠিত তথাকথিত সাধারণ সভার সিদ্ধান্ত মোতাবেক গঠিত আরেকটি তথাকথিত নির্বাচন সাব-কমিটির আহ্বায়ক দাবিদার। তাদের প্রত্যেকের উদ্দেশ্য বিগত ১৫-১৬ মার্চ অনুষ্ঠিত সমিতির ২০২২-২৩ কার্যকরী কমিটির নির্বাচনে সমিতির বিজ্ঞ সদস্যদের রায়কে ছিনিয়ে নেওয়া, বিশেষ করে তথাকথিত রি-কাউন্টিং/ফ্রেশ কাউন্টিং -এর নামে পরাজিত সম্পাদক পদপ্রার্থী জনাব আব্দুন নূর দুলালকে বিজয়ী ঘোষণা করা।
উপরোক্ত অবস্থাধীনে জনাব মো. অজি উল্লাহর নেতৃত্বে তথাকথিত নতুন নির্বাচন সাব-কমিতি গঠন, ভোট কাউন্টিং/নির্বাচনী ফলাফল বিষয়ে তাদের যে কোন পদক্ষেপ অবৈধ। সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সুমহান ঐতিহ্যকে কলঙ্কিত করার নির্লজ্জ অপচেষ্টা। এ ধরণের অবৈধ, নীতিহীন কার্যক্রম থেকে বিরত থাকার জন্য সকলের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি।’
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠের পর সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণা নিয়ে সৃষ্ট জটিলতার সমাধান শিগগরই হবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি। এসময় ব্যারিস্টার কাজল বলেন, আগামী দুই-একদিনের মধ্যেই সকলের সঙ্গে বসে নির্বাচন সাব-কমিটির আহ্বায়ক এ. ওয়াই. মসিউজ্জামান একটা সমাধান করবেন বলে মনে করি।
উল্লেখ্য, সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির ২০২২-২০২৩ বর্ষের কার্যনির্বাহী পরিষদ নির্বাচনের ভোটগ্রহণ সম্পন্ন হওয়ার পর দেড় মাস পেরিয়ে গেছে। দুইদিনব্যাপী এ নির্বাচন গত ১৫ ও ১৬ মার্চ অনুষ্ঠিত হলেও এখনো ফলাফল ঘোষণা করা হয়নি।
মূলত সম্পাদকের পদ নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে এ অচলাবস্থা তৈরি হয়েছে। আইনজীবীদের এ নির্বাচনের জন্য গঠিত নির্বাচন পরিচালনা উপ-কমিটির আহ্বায়ক জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এ ওয়াই মশিউজ্জামান পদত্যাগ করায় এ নিয়ে জটিলতা আরও ঘনিভূত হয়।
এখন প্রশ্ন উঠেছে, সম্পাদক পদের ভোট ফের গণনা করা হবে নাকি ভোট গণনা ছাড়াই ফল ঘোষণা করা হবে। এ নিয়ে এক পক্ষ বলছে ভোট আবার গণনা করতে হবে। আবার অন্য পক্ষ বলছে ভোট পুনর্গণনা বা রি-কাউন্টিংয়ের কোনো নিয়মই নেই।
এদিকে গত ৩১ মার্চ সুপ্রিম কোর্ট বারের কমিটির মেয়াদ শেষ হয়েছে। গঠনতন্ত্র অনুযায়ী এর পরে কোনোভাবেই কমিটির মেয়াদ বাড়ানোর সুযোগ নেই। আবার এর মধ্যে নতুন কমিটিও আসেনি। ফলে সুপ্রিম কোর্ট বার এখন কার্যত কমিটিশূন্য।
পেছনের কথা
গত ১৫ ও ১৬ মার্চ দুই দিনে এ নির্বাচনের ভোট গ্রহণ হয়। ১৭ মার্চ (বৃহস্পতিবার) বিকেলে ভোট গণনা শুরু হয়, চলে রাত পর্যন্ত। রাত ১টার দিকে নির্বাচন উপকমিটি আনুষ্ঠানিক ফল ঘোষণার প্রস্তুতি নিলে সম্পাদক পদে ভোট পুনরায় গণনার দাবি তোলেন আওয়ামী লীগপন্থী আইনজীবীরা। অন্যদিকে ফলাফল ঘোষণার দাবি তোলেন বিএনপি-সমর্থিত নীল প্যানেলের সমর্থকরাও। এ নিয়ে সেদিন মধ্যরাতের পরেও পক্ষে-বিপক্ষে চলে হইচই ও হট্টগোল। অনেকে আহ্বায়কের পদত্যাগের দাবিও তোলেন।
এরপর গভীর রাত গড়িয়ে ভোররাত ৩টার দিকে পরিস্থিতি সামাল দিতে নির্বাচন পরিচালনা কমিটির আহ্বায়ক, সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদপ্রার্থীদের নিয়ে বৈঠকে বসেন। ফলাফল ঘোষণা, নাকি পুনরায় গণনা, আধা ঘণ্টার বৈঠকের পর সিদ্ধান্ত আসে নতুন করে গণনা করা হবে ভোট৷
রাত সাড়ে তিনটার দিকে নির্বাচন পরিচালনা কমিটির আহ্বায়ক এ ওয়াই মসিউজ্জামান আদালত প্রাঙ্গণ থেকে বেরিয়ে যান। বেরিয়ে যাওয়ার আগে তিনি জানান, সম্পাদক পদে পুনরায় ভোট গণনা চেয়ে করা আবেদন দুই পক্ষের উপস্থিতিতে পরের দিন বিকেলে অর্থাৎ শুক্রবার (১৮ মার্চ) বিকেল তিনটায় নিষ্পত্তি করা হবে।
প্রকাশ্যে এ ঘোষণা দিলেও স্বাস্থ্যগত কারণ উল্লেখ করে এর আগেই (বৃহস্পতিবার রাতে) তিনি সমিতির কার্যনির্বাহী কমিটির কাছে পদত্যাগপত্র জমা দিয়ে যান।
ঘোষণা অনুযায়ী শুক্রবার বিকেলে প্রার্থী আবদুন নূর ও মো. রুহুল কুদ্দুস উপস্থিত হন। কিন্তু কমিটির প্রধান এ ওয়াই মসিউজ্জামান উপস্থিত হননি। এর মধ্যে খবর আসে সুপ্রিম কোর্ট বারের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির আহ্বায়ক পদত্যাগ করেছেন। এর পর থেকে বিষয়টি সেভাবেই ঝুলে আছে।