মো: সালাউদ্দিন সাইমুম: Justice delayed is justice denied- গ্লাডস্টোনের এই আপ্তবাক্যটিই আজ বিচারপ্রার্থীদের ক্ষেত্রে বহুলাংশে সত্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। বর্তমানে বিচার ব্যবস্থার অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে ঝুলে থাকা বা বিচারাধীন মামলা।
বর্তমানে ভারতে প্রায় ৪.৭ কোটি মামলা পেন্ডিং অবস্থায় রয়েছে যেটি বিশ্বে শীর্ষ। বিচারপতি রবীন্দ্র ভট্ট কমিটির (২০১৩) রিপোর্ট অনুসারে, একটি দেওয়ানি মামলা মিটতে গড়ে পনেরো বছর সময় লাগে। ভারতের প্রখ্যাত বিচারপতি মার্কান্ডে কাটজু এই পাহাড়সম মামলাজট নিরসন প্রসঙ্গে মন্তব্য করেন- চলমান মামলাজট শূন্যের কোঠায় আনতে কমপক্ষে ৩৬০ বছর লাগতে পারে! বিষয়টা সত্যিই তাজ্জব বনে যাওয়ার মতোই বটে, আবার একইসাথে ভীষণ উদ্বেগের। উল্লেখ্য, চীনে একটি মামলা নিষ্পত্তিতে গড়ে লাগে তিনমাস সময়। যদিও ক্যাঙ্গারু আদালত সেখানে সক্রিয় বলে একটা অভিযোগ আছে।
তবে ভারতে এহেন পাহাড়সম মামলাজট কমাতে তারা অভিনব পন্থারও আশ্রয় নিয়েছেন। মামলা নিষ্পত্তি তরান্বিতকরণে চেন্নাই এবং পশ্চিমবঙ্গে তারা সান্ধ্যকালীন কোর্ট চালু করেছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য বিশ্বের সর্বাধিক জনবহুল দেশ চীনে প্রায় ৩৫৮১টি আদালত রয়েছে।দ্বিতীয় জনবহুল দেশ ভারতে রয়েছে ৬৯৮টি আদালত। এদিকে পড়শীদেশ নেপালে ৯২টি আদালত রয়েছে।
পৃথিবীর দীর্ঘতম সময়কাল ধরে চলমান মামলার রেকর্ডও খোদ ভারতের দখলেই।ননী গোপাল পাল বনাম পশ্চিমবঙ্গ সরকার মামলাটি সেই ১৮০০ সাল থেকে অদ্যাবধি চলছে! গুণে গুণে ২২২ বছর হতে চলল অথচ আজও সেই মামলা অমীমাংসিত! সত্যিই অবিশ্বাস্য! অথচ আমাদের ছোট্ট পড়শীদেশ ভুটানে গেলো বছর মাত্র একশটি মামলা পেন্ডিং ছিলো।
অপরদিকে চোখ কপালে ওঠার মতোই বিপ্রতীপ চিত্র শান্তির দেশ নিউজিল্যান্ডের আদালতে। সেখানে ২০০৪ সালের ২২ জুলাই গ্রেমাউথ জেলা আদালত মাদকদ্রব্য সংক্রান্ত একটি অপরাধের মামলা মাত্র এক মিনিটে নিষ্পন্ন করে! যেটা গিনেজ বুকে বিশ্বরেকর্ড হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। অধিকন্তু ইউরোপের দেশ লুক্সেমবার্গে মামলা নিষ্পত্তিতে গড়ে মাত্র ৯৪ দিন সময় লাগছে।
বিচারপতি লর্ড উলফ মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে দুটি প্রধান প্রতিবন্ধকতাকে চিহ্নিত করেন। একটি মামলা নিষ্পত্তিতে কালক্ষেপণ, অন্যটি হলো মামলার জন্য অধিক খরচ। এ দুটি সমস্যা অ্যাকসেস টু জাস্টিসের ক্ষেত্রেও বড় বাঁধা বলে তিনি মনে করতেন।
মামলাজট নিরসনের ক্ষেত্রে সিঙ্গাপুর একটি আদর্শ উদাহরণ, যেখানে জট প্রায় শূন্যের কোঠায়। সিঙ্গাপুরের আদালতে নির্দিষ্ট দিনের মধ্যে মামলার বিচারকাজ শেষ করার লক্ষ্যে কঠোর নীতি অবলম্বন করা হয়। মামলার নথিতে লেখা থাকে, ‘দিস কেস উইল বি হার্ড বাই দ্য ডেট’ অর্থাৎ এই তারিখেই এই মামলা শুনানি করতে হবে এবং সে মোতাবেক শুনানি হয়। একটু এদিক-সেদিক হওয়ার সুযোগ নেই। সেখানে মামলার শুনানির জন্য বাড়তি সময়ক্ষেপণকে ‘অভিশাপ’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়।
সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের বহুল আলোচিত জনিডেপ বনাম এম্বার হার্ড শীর্ষক মানহানির মামলার বেশকিছু কার্যক্রম সরাসরি ইউটিউবে দেখানো হচ্ছে। সেখানে লক্ষ্য করলে আমরা দেখতে পাই বিচারক পেনি মামলার সময়সীমার ব্যাপারে বেশ কঠোরতার পরিচয় দিচ্ছেন। অপরদিকে মোরগের ডাক বন্ধের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছিল যেদেশে সেই ফ্রান্সে মামলাজট কমাতে সম্প্রতি তারা প্রাথমিক তদন্তের সর্বোচ্চ সময়সীমা দু’বছর বেঁধে দেয়ার সুপারিশ করেছে।
পৃথিবীর সবচেয়ে পুরাতন সক্রিয় আদালত যা আজও স্পেনে কার্যরত রয়েছে সেটি ‘পানি আদালত’ নামে খ্যাত। কৃষকদের সেচ সংক্রান্ত পানির বিবাদ মূলত নিষ্পত্তি করা হয়ে থাকে এ আদালতে। সেই ৯৬০ সাল হতে অদ্যাবধি চলমান এই আদালত প্রতি বৃহস্পতিবার বেলা ১২টায় বসে। সে আদালতের সমস্ত কার্যক্রম মৌখিক রীতিতে চলে এবং সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত বলে বিবেচিত হয়।স্পেনের ভ্যালেন্সিয়ার এ আদালতে কিন্তু মামলাজটের নজির নেই।
আমাদের দেশে বিচারাধীন মামলার সংখ্যাটাও বেশ আঁতকে ওঠার মতোই, প্রায় ৪০ লাখ মামলা দেশের আদালতগুলোতে ঝুলে আছে! উপরন্তু ফি বছর গড়ে প্রায় ২ লাখ অনিষ্পন্ন মামলা যুক্ত হচ্ছে। সুতরাং এহেন পাহাড়সম মামলাজট নিরসনে সময়োপযোগী ও ফলপ্রসূ পদক্ষেপের সুষ্ঠু বাস্তবায়ন অতি জরুরী।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, আইন বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।