শাহ্ মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান: একজন মানুষের মৌলিক অধিকার ও মানবাধিকার লিপিবদ্ধ থাকে সংবিধানে। সংবিধান হলো রাষ্ট্র পরিচালনার মৌলিক দলিল এবং সর্বোচ্চ আইন। Constitution বা সংবিধান বলতে কতকগুলো লিখিত বা অলিখিত মৌলিক বিধিমালাকে বোঝায় যা কোনো রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সম্পর্ক নির্ণয় করে এবং রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ব্যবহারের ও বন্টনের নীতি নির্ধারণ করে।
আধুনিক বিশ্বে রাষ্ট্র পরিচালনা করার জন্য সংবিধান এক অপরিহার্য দলিল। প্রতিটি রাষ্ট্র তার নিজস্ব কিছু আইন-কানুন, নীতি দ্বারা পরিচালিত হয়। এ সকল নিয়ম নীতিসমূহ হলো ঐ সকল রাষ্ট্রের সংবিধান। জগৎ বিখ্যাত দার্শনিক ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অ্যারিস্টটল বলেন, ‘সংবিধান হলো এমন একটি জীবন পদ্ধতি যা রাষ্ট্র তার নিজের জন্য বেছে নিয়েছে।’
লর্ড ব্রাইস বলেন, ‘সংবিধান হলো এমন কতগুলো আইন ও প্রথার সমষ্টি যার মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় জীবন পরিচালিত হয় অথবা এমন কতিপয় আইনের সমন্বয় ঘটে যাতে সম্প্রদায়ের সংগঠিত, শাসন এবং একত্রীকরণের নীতিমালা এবং নিয়মাবলি সংযোজিত।
সংবিধান সাধারণত লিখিত ও অলিখিত এবং সুপরিবর্তনীয় ও দুষ্পরিবর্তনীয় হয়ে থাকে। সংবিধানের আইন মেনে চলা দেশের সরকারসহ প্রতিটি নাগরিকের অবশ্য কর্তব্য।
উল্লেখ্য, সংবিধান সংসদকর্তৃক প্রণীত কোনো সাধারণ আইনের মতো নয়, বরং সংসদের সকল আইন সংবিধানের আলোকে প্রণীত হয়। সংবিধানের সঙ্গে নাগরিকদের সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। রাষ্ট্রের সাথে নাগরিকদের চুক্তি সংবিধানের মাধ্যমেই সম্পাদন হয়। পৃথিবীর দেশের সংবিধান রচিত হয়েছে গোল টেবিল বৈঠক করে। যুক্তরাষ্ট্রের মূল সংবিধান একশ দিনে লিখিত হলেও গৃহীত হতে সময় লেগেছে এক বছরেরও বেশি। ভারতের সংবিধান লিখতে সময় লেগেছে চার বছর। যুক্তরাজ্যে কতগুলো সর্বমান্য বিধান, চুক্তি ও আইনের মাধ্যমে সরকার এবং রাষ্ট্রযন্ত্র পরিচালিত হয়। তাদের লেখিত সংবিধান নেই।
‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান’ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সেরা অবদান। এ সংবিধান রচিত হয়েছে ৩০ লক্ষ শহিদ ও ২ লক্ষ ৬০ হাজার নারীর সম্ভ্রমের বিনিময়ে। জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে পৃথিবীর সকল রাষ্ট্রের সাথে শান্তিপূর্ণ সুসম্পর্ক বজায় রেখে শান্তি নিরাপত্তা ও সংহতির উন্নয়ন সংক্রান্ত জাতিসংঘ সনদের চেতনা-সহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক আইন এবং মানবাধিকার সংরক্ষণ ও বাস্তবায়ন, নাগরিকগণের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকারের বিষয়টি বাংলাদেশের সংবিধানে গুরুত্ব পেয়েছে।
১৯৭১ সালের ১০ই এপ্রিল মুজিবনগরে গৃহীত বাংলাদেশের প্রথম অন্তঃর্বর্তীকালীন সংবিধান হলে ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র’ (Proclamation of Independence)। এ ঘোষণাপত্রের বিধান অনুযায়ী গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ রাষ্ট্র আইনগতভাবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে এবং উক্ত ঘোষণাপত্র অনুযায়ী সকল সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী বাংলাদেশের জনগণ কর্তৃক সত্তরের নির্বাচনে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিগণের সমন্বয়ে একটি গণপরিষদ গঠন করা হয়। এভাবে গঠিত গণপরিষদ কর্তৃক বাংলাদেশের জন্য একখানি সংবিধান প্রণয়ন না করা পর্যন্ত স্বাধীনতা ঘোষণাপত্রের বিধান অনুসারে মুক্তযুদ্ধকালীন মুজিবনগর সরকারের সব কার্যক্রম পরিচালিত হয়। ১৯৭২ সালের ১০ই জানুয়ারি মুজিবনগর সরকারের রাষ্ট্রপতি হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশে ফেরার একদিন পর ১১ই জানুয়ারি ১৯৭২ সালে তিনি ‘অস্থায়ী সংবিধান আদেশ’ (Provisional Constitution Order) জারি করেন। এটি বাংলাদেশের দ্বিতীয় অন্তঃর্বর্তীকালীন সংবিধান।
এ সংবিধান আদেশ বলে বাংলাদেশের জনগণের অভিপ্রায় অনুসারে সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা (মন্ত্রিপরিষদ শাসিত) অবলম্বিত হলে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী স্বাধীন বাংলাদেশের সংসদীয় সরকার ব্যবস্থার রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং রাষ্ট্রপতির পদ স্বেচ্ছায় ত্যাগ করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রধানমন্ত্রিত্বের পদ গ্রহণে স্বাধীন বাংলাদেশের সরকারের কার্যক্রম পরিচালিত হয়।
উল্লেখ্য, স্বাধীনতা ঘোষণাপত্রের বিধান অনুযায়ী গঠিত গণপরিষদের আইন প্রণয়নের ক্ষমতা না থাকায় ঘোষণাপত্রের প্রদত্ত ক্ষমতাবলে রাষ্ট্রপতির আদেশে (Presidential Order বা P.O.) জারিকৃত আইন দ্বারা রাষ্ট্রের সকল বিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানসমূহ গঠিত ও পরিচালিত হয়। সংবিধান প্রণয়নের পূর্ব পর্যন্ত ১৩৫টি রাষ্ট্রপতির আদেশ জারি করা হয়। এভাবে জারিকৃত আইন বলে বাংলাদেশ রাষ্ট্রীয় আইনগত কাঠামোপূর্ণ অবয়বে প্রতিষ্ঠা পায়। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশর সংবিধানের ৪৭ অনুচ্ছেদ ও তৎসহ পঠিতব্য প্রথম তফসিলে উল্লেখিত অনেক আদেশ এখনও বলবৎ রয়েছে।
স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র দ্বারা বাংলাদেশের একখানি সংবিধান প্রণয়নের জন্য গণপরিষদ গঠিত হলেও এই পরিষদের সদস্যপদের যোগ্যতা, অযোগ্যতা, অপসারণসহ এর কার্যপ্রণালি সম্পর্কিত কোনো বিধান ছিল না। সঙ্গত কারণে এসব বিষয়াবলি বিধিবদ্ধ করে ১৯৭২ সালের ২৩শে মার্চ প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী ‘বাংলাদেশ গণপরিষদ আদেশ, ১৯৭২’ (Constituent Assembly of Bangladesh, 1972′ P.O. No. 22 of 1972) জারি করেন এবং ইহা ১৯৭২ সালের ২৬শে মার্চ থেকে কার্যকর বলে ঘোষিত হয়। রাষ্ট্রপতির এই আদেশ বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়নের প্রথম পদক্ষেপ।
জারিকৃত গণপরিষদ আদেশের ৭ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়, ‘গণপরিষদ প্রজাতন্ত্রের লাগিয়া একটি সংবিধান প্রণয়ন করিবে।’ একমাত্র সংবিধান প্রণয়নের দায়িত্ব ছাড়া গণপরিষদের আইন প্রণয়নের কোনো ক্ষমতা অর্পণ করা হয়নি।
এই আদেশেই বলে, ১৯৭০ সালের ৭ই ও ১৭ই ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচনে পূর্বপাকিস্তান থেকে জাতীয় আইন পরিষদের ১৬৯জন এবং প্রাদেশিক পরিষদের ৩০০ জন নির্বাচিত সদস্যবর্গ নিয়ে গণপরিষদ হয়। ফলে গণপরিষদের মোট সদস্য ৪৬৯ জন হলেও মুক্তিযুদ্ধের সময় শহিদ হওয়ার, পাকিস্তানের প্রতি অনুগত্য ঘোষণা করা, পদত্যাগ করা, সরকারি পদে নিযুক্ত হওয়া, শপথ গ্রহণের ব্যর্থ হওয়া ও বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের জন্য আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কৃত হওয়া ইত্যাদি কারণে সদস্যপদে অযোগ্য ঘোষিতদের বাদ দিয়ে গণপরিষদের সদস্য সংখ্যা হয় ৪০৩ জন। এই ৪০৩ জন গণপরিষদ সদস্যের মধ্যে ৪০০ জন আওয়ামী লীগের, ১জন ন্যাপের, (মোজাফফর) এবং ২ জন নির্দলীয় ছিল।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান রচনার জন্য গঠিত বাংলাদেশ গণপরিষদ’ নেতা নির্বাচিত হয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। গণপরিষদের প্রথম অধিবেশন স্বাধীনতা ঘোষণাপত্রের দিবস স্মরণে ১৯৭২ সালের ১০ই এপ্রিল অনুষ্ঠিত হয়। এ অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন মওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ। গণপরিষদের এ অধিবেশনে বাংলাদেশের জন্য একখানি উপযুক্ত সংবিধান প্রণয়নের জন্য আইনমন্ত্রী ড. কমাল হোসেনকে সভাপতি করে ৩৪ জন সদস্যের সমন্বয়ে একটি খসড়া সংবিধান প্রণয়ন কমিটি হয়।
খসড়া সংবিধান প্রণয়নের জন্য এ কমিটিকে দুই মাস সময় দেওয়া হয়। ১৭ই এপ্রিল, ১৯৭২ তারিখে মুজিবনগর সরকারের শপথ গ্রহণের দিন অনুষ্ঠিত কমিটির প্রথম বৈঠকে মে মাসের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে সংবিধানের জন্য প্রস্তাব পেশ করার জন্য জনগণের প্রতি আহ্বান জানানো হয়। এ আহ্বানের ফলে বিভিন্ন সংগঠন ও ব্যক্তির নিকট থেকে প্রাপ্ত মোট ৯৮টি সুপারিশ এবং কমিটির সদস্যদের প্রদত্ত প্রস্তাব বিবেচনায় নিয়ে ১৯৭২ সালের ১০ই জুন অনুষ্ঠিত বৈঠকে কমিটি সংবিধানের প্রাথমিক খসড়া প্রস্তুত করে।
কমিটি সদস্যগণ মোট ৭৪ টি বৈঠকে মিলিত হয়ে ১১ই অক্টোবরের মধ্যে একখানি পূর্ণাঙ্গ খসড়া গ্রহণ ও অনুমোদন করতে সক্ষম হয়। ইংরেজিতে প্রস্তুত এই খসড়ার বাংলা পাঠ গণপরিষদের বিবেচনার জন্য উপস্থাপন করার প্রয়োজনে কমিটি ড. সৈয়দ আলী আহসান, ড. মযহারুল ইসলাম ও ড. আনিসুজ্জামানের সহায়তা গ্রহণ করে। ১৯৭২ সালের ১২ই অক্টোবর গণপরিষদের দ্বিতীয় অধিবেশন শুরু হয়।
এই অধিবেশনে ১৯শে অক্টোবর খসড়া প্রণয়ন কমিটির সভাপতি এবং আইনমন্ত্রী ড. কামাল হোসেন খসড়া সংবিধানটি বিল আকারে সংসদে উপস্থাপন করেন। গণপরিষদের একমাত্র বিরোধী দলীয় সদস্য (ন্যাপ মোজাফফর) সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বিলটি জনমত যাচাইয়ের জন্য প্রস্তাব করলে কণ্ঠভোটে নাকচ হয়। বিলটির ওপর আলোচনা শুরু হলে মোট ১৬৩টি সংশোধনী প্রস্তাব উত্থাপিত হয়, যার মধ্যে ৮৪টি প্রস্তাব গৃহীত হয়। গৃহীত সংশোধনী প্রস্তাবের মধ্যে বিরোধীদলীয় সদস্যরা একটি প্রস্তাব অন্তর্ভুক্ত ছিল, যা পার্লামেন্টারি ইতিহসে এক বিরল ঘটনা। ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী ও গণপরিষদ নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর বক্তৃতার পর দুপুর ১টা ১০ মিনিটে গণপরিষদ সদস্যদের তুমুল করতালির মধ্য দিয়ে সর্বসম্মতক্রমে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান গৃহীত হয়।
সংবিধানের মূল বাংলা পাঠ এবং ইংরেজিতে অনূদিত একটি অনুমোদিত পাঠ স্পিকার কর্তৃক নির্ভরযোগ্য বলে সার্টিফিকেট প্রদান করা হয়। ১৪ই ও ১৫ই ডিসেম্বর গণপরিষদের সংক্ষিপ্ত শেষ অধিবেশনে পরিষদ সদস্যগণ সংবিধানে বাংলায় হস্তলিখিত এবং শিল্পকর্মে অলংকৃত মূল কপিতে স্বাক্ষর করেন। সংবিধানে প্রথম স্বাক্ষর করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং এরপর সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও তাজউদ্দিন আহমদ স্বাক্ষর করেছেন। হাতে লেখা মূল সংবিধানে মোট ৩৯৯ জন গণপরিষদ সদস্যের স্বাক্ষর রয়েছে এবং চারজন সদস্য স্বাক্ষর করা থেকে বিরত থাকেন। স্বাক্ষর না করা সদস্যগণ হলেন সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, আজিজার রহমান, জালাল আহমেদ ও মানবেন্দ নারায়ণ লারমা।
১৯৭২ সালের ১৬ই ডিসেম্বর বিজয় দিবসের প্রথম বার্ষিকীতেই ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান’ নামে অভিহিত দেশের সর্বোচ্চ আইনের এই অমূল্য ঐতিহাসিক দলিলটি বলবৎ করা হয়। ‘বাংলাদেশ গণপরিষদ আদেশ, ১৯৭২-এর বিধানে গঠিত গণপরিষদ সদস্যের দ্বারা প্রণীত ও প্রবর্তিত আইনে রাষ্ট্রপতির কোনো সম্মতি গ্রহণের কোনো ব্যবস্থা না থাকায় সংবিধানটি সম্মতির জন্য রাষ্ট্রপতির কাছে প্রেরণের প্রয়োজন হয়নি।
বাংলাদেশের সংবিধান একটি অনন্য বৈশিষ্ট্যপূর্ণ সংবিধান। এ সংবিধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সেরা অবদান। মহান মুক্তিযুদ্ধের ত্রিশ লখ শহিদের রক্তের কালিতে লেখা এ সংবিধান স্বাধীন বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ অর্জন। এতে মৌলিক অধিকার ও মানবাধিকার সুস্পষ্টভাবে লিপিবদ্ধ রয়েছে।
লেখক: গবেষক