ব্রিটিশ আমলে তৈরি বিতর্কিত রাষ্ট্রদ্রোহ আইনের প্রয়োগ স্থগিত করেছে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট। সেইসঙ্গে এই আইনে আপাতত নতুন কোনো মামলা নথিভুক্ত এবং কাউকে গ্রেপ্তার করা থেকেও সরকারকে বিরত থাকার নির্দেশ দিয়েছে দেশটির সর্বোচ্চ আদালত।
আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থা বিবিসি এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, বর্তমানে এই আইনে যতগুলো মামলার শুনানি চলছে সবগুলো স্থগিত রাখার নির্দেশও দেয়া হয়েছে। এছাড়া এই আইনে গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিরা জামিনের আবেদন করতে পারবেন।
রাষ্ট্রদ্রোহ আইনের প্রয়োগ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই বিতর্ক চলে আসছে। সমালোচকদের মতে, ভিন্নমত দমনে সরকার এই আইনের অপপ্রয়োগ করতে পারে। গ্রেপ্তার হতে পারেন বিরোধীদলের রাজনীতিক, সাংবাদিক বা সমাজকর্মীরা।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, নরেন্দ্র মোদী সরকারের জন্য এই আদেশ বড় ধাক্কা হয়ে এসেছে। ভারত সরকার শুরুতে এই আইনের পক্ষে সমর্থন দিলেও গত মঙ্গলবার (১০ মে) বলেছে, তারা আইনটি পুনঃপর্যালোচনা করবে।
এদিকে পশ্চিমবঙ্গের বাংলা দৈনিক আনন্দবাজার জানায়, মঙ্গলবার সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি এন ভি রমণার বেঞ্চ কেন্দ্রের কাছে জানতে চায়, যত দিন রাষ্ট্রদ্রোহ আইনের পুনর্বিবেচনা চলছে, তত দিন এই আইনের আওতায় হওয়া মামলা স্থগিত রাখা যায় কিনা?
পাশাপাশি আদালত কেন্দ্রের কাছে এটাও জানতে চায়, কেন্দ্রীয় সরকার রাজ্যগুলোকে এই আইন প্রয়োগ করে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করা থেকে বিরত রাখতে পারবে কিনা?
উত্তরে বুধবার (১১ মে) কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে সুপ্রিম কোর্টকে বলে, তারা রাজ্যগুলোকে এটা বলতে পারবে যে, পুলিশ সুপার বা তার চেয়ে উঁচু পদমর্যাদার কোনো কর্মকর্তাই কেবল রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা করতে পারবেন।
কেন্দ্র সরকারের উত্তর পাওয়ার পর সুপ্রিম কোর্ট বুধবার সাফ জানিয়ে দেয়, যত দিন না রাষ্ট্রদ্রোহ আইনের পুনর্বিবেচনা শেষ হচ্ছে, ততদিন এই আইনের প্রয়োগ স্থগিত থাকবে এবং এই আইনের বলে কাউকে গ্রেপ্তার করা যাবে না।
রাষ্ট্রদ্রোহের মামলার বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে পিটিশনকারীদের একজন ভারতের প্রধান বিরোধীদল কংগ্রেস পার্টির জ্যেষ্ঠ নেতা কপিল সিবাল। এদিন কপিল সিবাল সুপ্রিম কোর্টকে বলেন, ভারত জুড়ে রাষ্ট্রদ্রোহের ৮০০’র বেশি মামলায় ১৩ হাজারের বেশি মানুষ কারাগারে আছেন।
আরেক পিটিশনকারী পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল কংগ্রেসের সাংসদ মহুয়া মৈত্র আনন্দবাজারকে বলেন, ‘‘আমার দীর্ঘদিনের লড়াই আজ স্বীকৃতি পেল। সুপ্রিম কোর্টের মহামান্য প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন বেঞ্চকে এই রায় প্রদানের জন্য আমি আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাই। আশা রাখি যে কেন্দ্রীয় সরকার যথোপযুক্ত পুনর্বিবেচনার মাধ্যমে এই আইনের বিলোপ ঘটাবে।’’
বিবিসি জানায়, ওয়েবসাইট আর্টিকেল১৪ এ সংকলিত তথ্যানুযায়ী গত এক দশকে রাজনীতিক ও সরকারের সমালোচনা করার কারণে যে ৪০৫ জন ভারতীয়র বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা হয়েছে যেগুলোর বেশিরভাগই ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ক্ষমতায় আসার পর দায়ের করা।
গতবছর ওই আইন প্রয়োগ করে এক শিক্ষার্থীকে গ্রেপ্তার করা হলে তা খবরের শিরোনাম হয়। ভারতে কৃষি সংস্কার আইন নিয়ে আন্দোলন চলার সময় ওই শিক্ষার্থী একটি নথি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করে কৃষকদের সাহায্য করেছিলেন।
এমনকি একটি স্কুলে একটি নাটকে অংশ নেওয়া নয় থেকে ১২ বছর বয়সের শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধেও এই আইন প্রয়োগ করতে দেখা গিয়েছিল। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তারা একটি ফেসবুক পোস্টে ‘লাইক’ দিয়েছে।
সিনেমা হলে জাতীয় সঙ্গীত বাজানোর সময় না দাঁড়ানোয় রাষ্ট্রদ্রোহ আইন প্রয়োগের নজিরও আছে।
স্বাধীনতার পর ১৯৬২ সালে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট রাষ্ট্রদ্রোহ আইন প্রয়োগের উপর সীমাবদ্ধতা আরোপ করে। কিন্তু ভারতের বিভিন্ন সরকার নিজেদের প্রয়োজনে এই আইনের ব্যবহার করে যাচ্ছে। বিশেষ করে যারা সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলছে তাদের ভয় দেখিয়ে মুখ বন্ধ করতে।
ভারতে বিচার পাওয়ার দীর্ঘসূত্রিতার কারণে বছরের পর বছর ধরে ওই সব মামলা চলে।
এদিকে, যাদের বিরুদ্ধে এই আইনে মামলা চলছে তাদের অবশ্যই আদালতে তাদের পাসপোর্ট জমা দিতে হয়, তারা কোনো সরকারি চাকরিতে আবেদন করতে পারে না এবং যখনই ডাকা হয় তখনই আদালতে উপস্থিত থাকতে বাধ্য থাকে।
এই আইনে সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডই হতে পারে।