মোহাম্মদ মোখলেসুর রহমান বাদল একজন মুক্তিযোদ্ধা। দীর্ঘ তিন যুগের বেশি সময় আইন পেশায় জড়িত আছেন অ্যাডভোকেট মোখলেসুর রহমান বাদল। তীক্ষ্ণ বুদ্ধিসম্পন্ন ও সম্মোহনী ক্ষমতাধর চৌকস এই আইনজীবী ১৯৫৫ সালে কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন বিষয়ে পড়াশোনা শেষ করে ১৯৮৫ সালে বার কাউন্সিলের সনদপ্রাপ্ত হন। একই বছর ঢাকা আইনজীবী সমিতির সদস্যপদ লাভের মাধ্যমে আইন পেশায় নিযুক্ত হন। ১৯৮৯ সালে সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে প্র্যাকটিসের অনুমতিপ্রাপ্ত হন এবং পরের বছরই সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সদস্য হন। ঢাকা আইনজীবী সমিতির সাবেক এই সভাপতি আইনজীবীদের সনদপ্রদানকারী ও নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের হিউম্যান রাইট অ্যান্ড লিগ্যাল এইড কমিটির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেছেন। আইনজীবী সুরক্ষায় পৃথক আইনের প্রয়োজনীয়তা, আইনজীবীদের পেশাগত মান উন্নয়নে বার কাউন্সিলের ভূমিকা সহ বিভিন্ন প্রসঙ্গে ল’ইয়ার্স ক্লাব বাংলাদেশ ডটকম সম্পাদক অ্যাডভোকেট বদরুল হাসান কচি মুখোমুখি হয়েছেন অ্যাডভোকেট মোখলেসুর রহমান বাদল এর সাথে।
ল’ইয়ার্স ক্লাব: গত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশক থেকে একাধিকবার আইনজীবী সমিতির কার্যনির্বাহী পরিষদে নির্বাচিত হয়েছেন, নেতৃত্ব দিয়েছেন বার কাউন্সিলেও। এই সুদীর্ঘ সময়ে আইনজীবীদের কল্যাণে আপনার উল্লেখযোগ্য কাজসমূহ সম্পর্কে কিছু বলুন…
মোখলেসুর রহমান বাদল: আমি ১৯৮৫ সালে ঢাকা আইনজীবী সমিতির সদস্যপদ লাভের মাধ্যমে আইন পেশায় নিয়োজিত হই। তিন বছর পর ঢাকা বারে কার্যনির্বাহী সদস্য নির্বাচিত হওয়ার মধ্য দিয়ে আইনজীবীদের নেতৃত্ব প্রদানের সুযোগ পাই। এরপর ১৯৯২-১৯৯৩ সালে লাইব্রেরী সম্পাদক, ২০০৩-২০০৪ সালে সাধারণ সম্পাদক এবং ২০০৯-২০১০ সালে একই বারে সভাপতি নির্বাচিত হয়েছি।
দায়িত্ব গ্রহণের শুরু থেকেই আইনজীবীদের জন্য কল্যাণকর কাজসহ সমিতির উন্নয়নে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছি। একদম শুরুর দিকে আইনজীবীদের জন্য সুপেয় পানির অভাব ছিল। প্রথমবার নির্বাচিত হওয়ার পর সিনিয়র নেতৃবৃন্দের সাথে আলোচনা করে সমিতি প্রাঙ্গণে পানির ট্যাংক স্থাপনের মাধ্যমে সেই সংকট নিরসন করেছি। পরবর্তীতে লাইব্রেরী সম্পাদক নির্বাচিত হলে তৎকালীন কমিটির সভাপতি, সাধারণ সম্পাদকসহ সকল নেতৃবৃন্দের সাথে পরামর্শ করে সমিতির জন্য যুগোপযোগী পাঠাগার স্থাপনের উদ্যোগ গ্রহণ করি। সরকারের সাথে দেন দরবার করে অনুদানের ব্যবস্থা করি এবং আইনজীবীদের জন্য সমৃদ্ধশালী একটি লাইব্রেরী স্থাপনে সক্ষম হই।
পরবর্তী সময়ে যখন শীর্ষস্থানীয় নেতা হিসেবে নির্বাচিত হই ততদিনে ঢাকা বারের সদস্য সংখ্যা প্রচুর পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে একটি দোতলা জরাজীর্ণ ভবনে আইনজীবীদের বসার জায়গা সংকুলান হত না। এ বিপুল সংখ্যক সহকর্মীর কোর্ট প্রাঙ্গণে বসার স্থান না থাকার বিষয়টি আমাকে ভাবিয়েছে। আইনজীবীদের জন্য একটি বহুতল ভবন করা যেতে পারলে সদস্যদের বসার জায়গা নিয়ে সমস্যা দূরীভূত হবে।
এ লক্ষ্যে তৎকালীন ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে নতুন ভবন নির্মাণের দাবী নিয়ে যাই। আইনজীবীবান্ধব এই নেত্রী এ সময় ঢাকা বার পরিদর্শনের ইচ্ছা পোষণ করেন। এরপর তিনি ঢাকা বারে এসে বাস্তব চিত্র দেখতে পান। প্রধানমন্ত্রীর আগমনী ওই সভায় আমি সভাপতিত্ব করি। সবকিছু দেখে প্রধানমন্ত্রী আইনজীবীদের জন্য বহুতল নতুন ভবন নির্মাণে ২০ কোটি টাকা অনুদান দেন এবং ভবন নির্মাণের জন্য ৫ কাঠা জমিও ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। এরপর ঢাকা আইনজীবী সমিতির নতুন এ ভবন নির্মাণ করা হয়।
মাত্র একবছরের জন্য দায়িত্ব নিয়ে সব সমস্যা দূর করা সম্ভবপর হয়না। তবে যতদিন দায়িত্বে ছিলাম আইনজীবীদের যেকোন আপদ-বিপদ ও সুখে-দুঃখে পাশে থাকার সর্বোচ্চ চেষ্টা আমার সর্বদাই ছিল। সবক্ষেত্রে যে সফল হয়েছি তা বলব না, কিছু ব্যর্থতাও এই সুদীর্ঘ সময়ে নিশ্চয়ই রয়েছে। সময়-সুযোগের অভাবে ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও কিছু কাজ করা হয়ে উঠেনি। আবার এসব কিছুর পরও যে সকলেই পছন্দ করবেন না কিন্তু না, কেউ কেউ অপছন্দও করতে পারেন। সফলতা-ব্যর্থতা, উত্থান-পতন নিয়েই তো জীবনের পথচলা।
এখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে দেশের সকল আইনজীবী মিলে বৃহৎ পরিবার। ফলে দল-মত-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল কিছুর ঊর্ধ্বে উঠে একজন আইনজীবী অপর একজন আইনজীবীর সুখে-দুঃখে পাশে এসে দাঁড়ায়। বিগত সময় যতবার নির্বাচিত হয়েছি আইনজীবীদের জন্য কল্যাণকর কাজ করার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। ফলশ্রুতিতে ২০১৮ সালে যখন আইনজীবীদের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের নির্বাচনে সাধারণ আসনে প্রার্থী যখন হয়েছিলাম, সারাদেশের আইনজীবীরা আমাকে বিমুখ করেননি। তাঁদের মূল্যবান ভোট দিয়ে আমাকে নির্বাচিত করেছিলেন।
দায়িত্ব গ্রহণের পর নির্বাচিত সকল সদস্যরা মিলে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাৎ করে বার কাউন্সিলের জরাজীর্ণ ভবন সংস্কারের প্রস্তাব উত্থাপন করি। যার ফলাফল তো সকলের সামনে দৃশ্যমান, বার কাউন্সিলের নতুন বহুতল সুরম্য ভবন।
এখানে একটা বিষয় সকলকে জানাতে চাই, বার কাউন্সিলের পুরাতন ভবন নির্মাণের জায়গাও কিন্তু ১৯৭২ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দিয়েছিলেন। একইসাথে ৫০ হাজার টাকা প্রদান করে বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের বেনাভোলেন্ট ফান্ডের গোড়াপত্তন করেছিলেন। যে ফান্ড ক্রমান্বয়ে ৫ লক্ষ টাকায় উন্নীত হয়েছে। আমাদের কমিটি নির্বাচিত হওয়ার পর এই ফান্ড ১০ লাখ টাকায় উন্নীত করা হয়। যা ২০২২ সালের পহেলা জানুয়ারি থেকে কার্যকর হয়েছে।
এই করোনা মহামারীর মধ্যে সারা পৃথিবীর প্রায় সকল দেশ অর্থনীতিসহ নানা সূচকে নিম্নগামী ছিল। এসময় সারাদেশের আইনজীবীদের জন্য কোভিড পরিস্থিতি মোকাবেলায় অনুদান প্রদানের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। সেই সাথে বার কাউন্সিলের পক্ষ থেকে সরকারের কাছ থেকে আইনজীবীদের জন্য প্রণোদনা নেওয়ার জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করা করেছি। যার ফলে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আইনজীবীদের জন্য ২০ কোটি টাকা প্রণোদনা প্রদান করেছেন। ওই প্রণোদনার টাকা ইতোমধ্যে বার কাউন্সিলের চেয়ারম্যান সাহেব অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন সারা বাংলাদেশের আইনজীবীদের মধ্যে মাথাপিছু হারে বণ্টন করে দিচ্ছেন।
যুগের সাথে তাল মিলিয়ে বার কাউন্সিলের কার্যক্রমেও ডিজিটাল ছোঁয়া আনার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে আমাদের কমিটির মাধ্যমেই। দেখুন বিগত দিনগুলোতে বার কাউন্সিলে এসে সনদপ্রার্থীদের ফরম ফিলাপ কার্যক্রম সম্পন্ন করতে হত। এতে করে সারাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে ঢাকায় এসে দুই-তিন দিন থাকা, খাওয়াসহ প্রার্থিদের নানা সমস্যার সম্মুখীন হতে হত ও অর্থ ব্যয় তো হতোই। কিন্তু বর্তমানে সনদপ্রার্থীদের সেই সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে না। দেশের যেকোন প্রান্ত থেকে ঘরে বসেই অনলাইনে রেজিস্ট্রেশন ও ফরম ফিলাপ করতে পারছেন অনায়াসে। এসবই যুগোপযোগী ও আধুনিক বার কাউন্সিল করার জন্য আমাদের অব্যাহত প্রয়াসের ফসল।
ল’ইয়ার্স ক্লাব: পেশাগত দায়িত্বপালন করতে গিয়ে অনেক সময় বিচারপ্রার্থী কিংবা অনান্য বিরোধের জেরে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তিদের হাতে আইনজীবীদের লাঞ্চিত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে, এপ্রেক্ষিতে আইনজীবী সুরক্ষায় পৃথক আইন প্রয়োজন বলে মনে করেন কিনা?
মোখলেসুর রহমান বাদল: আমাদের নির্বাচনী অঙ্গীকারনামায় আইনজীবীদের সুরক্ষার জন্য ব্যবস্থা গ্রহণের বিষয়টি সন্নিবেশিত আছে। ইশতেহার অনুযায়ী আইনজীবীদের মান-মর্যাদা বজায় রাখাসহ অন্যান্য অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা থেকে সুরক্ষায় সংবিধানের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ আইন প্রণয়নের উদ্যোগ গ্রহণ করব। যেহেতু এটি সংসদের মাধ্যমে পাস করাতে হবে এক্ষেত্রে সরকারের নীতি-নির্ধারক মহলের সাথে আলোচনা চলছে। বলতে পারেন, বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন।
এছাড়া এই আইনটি প্রণয়নের প্রস্তাব করার আগে বিশেষজ্ঞ মতামত গ্রহণ করা হচ্ছে। কারণ আমাদের মূল সংবিধানে সকল নাগরিকের জন্য আইনের দৃষ্টিতে সমান অধিকার দেওয়ার যে বিষয়টি উল্লেখ আছে সেটির যেন ব্যত্যয় না ঘটে সেদিকটা লক্ষ্য রেখে সিদ্ধান্ত গ্রহণের চেষ্টা করা হচ্ছে।
দেখুন, যারা বার কাউন্সিলের নির্বাচিত নেতৃবৃন্দ আমরা কিন্তু এসব বিষয় ভুলে যাই না। কারণ আগেও বলেছি দেশের সকল আইনজীবীরা একটা পরিবারের মতো। একছাদের নিচে বসবাসরত এই পরিবারের সকল সদস্যকে সুরক্ষা দেওয়ার দায়িত্ব নির্বাচিত প্রতিনিধিদের। এজন্য আমরা দল-মত-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল কিছুর ঊর্ধ্বে উঠে আইনজীবীদের কল্যাণে কাজ করি।
ল’ইয়ার্স ক্লাব: বলা হয়ে থাকে, বিচার ব্যবস্থায় বার ও বেঞ্চ একটি পাখির দুটি ডানা। তবে মাঝেমধ্যে বিচারক অপসারণের দাবীতে আইনজীবীদের আদালত বর্জনের ঘটনা নেহায়েত কম নয়। এতে একদিকে বিচারপ্রার্থীরা যেমন ভোগান্তিতে পরেন, অন্যদিকে অভিযোগ ওঠা বিচারকের প্রতিও জনসাধারণের আস্থা কমে যায়। যা সামগ্রিক বিচার ব্যবস্থার জন্য মঙ্গলকর নয়। এক্ষেত্রে আইনজীবীদের আরো বেশি দায়িত্বশীল আচরণ করা সমীচীন কিনা? সেই সাথে এই বিষয়গুলো প্রকাশ্যে না এনে আভ্যন্তরীণভাবে সুরাহা করা জরুরি বলে মনে করেন কিনা?
মোখলেসুর রহমান বাদল: অত্যন্ত সুন্দর ও গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। আসলে পেশাগত দায়িত্বপালন করতে গিয়ে আইনজীবীদের নানা ধরণের সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। যেহেতু বিচারকদের তুলনায় আইনজীবীদের সংখ্যা অনেক কম ফলে আমরা ইচ্ছা করলেই তাঁদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করা যায়। তবে শক্তিশালী বার যদি থাকে তাহলে খুব সহজেই এসব সমস্যা সমাধান করা যায়। কারণ শক্তিশালী বার থাকলে বেঞ্চ সঠিক পথে চলতে বাধ্য হয়। সেজন্য আমি বলব আইনজীবীদের জ্ঞানের চর্চা অব্যাহত রেখে মেধা ও মননকে কাজে লাগাতে হবে। আইনজীবীদের বিজ্ঞ বলা হয়। জ্ঞান আহরণে মাধ্যমে তারা এই বিজ্ঞতা অর্জন করেন। খেয়াল করে দেখবেন জ্ঞানী মানুষ মাত্রই বিনয়ী। কথা বলার ক্ষেত্রেও সকল দিক বিবেচনা করে বলেন। তাই সেই অবস্থান থেকে সরে এসে আমরা যদি চিন্তা, চেতনা ও মেধা দিয়ে এসব সমস্যা মোকাবেলা করতে পারি তাহলে বিচারকরাও ঠিক দিশা পাবে বলে মনে করি।
এছাড়া কিছুক্ষেত্রে সামাজিক অবক্ষয় যে ঘটেছে সেটা তো অনস্বীকার্য। পেশাগত জায়গায় সিনিয়র-জুনিয়রদের মধ্যে আগের যে সম্পর্ক ও পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের ব্যাপার ছিল সেটার কিছু কিছু ক্ষেত্রে ব্যত্যয় ঘটেছে। এজন্য ট্রেনিংয়ের প্রয়োজন আছে বলে মনে করি। বিশেষ করে একজন আইনজীবীর পেশাগত দায়িত্ব, আচরণ, শিষ্টাচার ইত্যাদি বিষয়ে প্রশিক্ষণ আবশ্যক। আর এই দায়িত্ব বার কাউন্সিলকে পালন করতে হবে।
আবার এই অবস্থার জন্য কিছু বিচারকও দায়িত্ব এড়াতে পারেন না। জজশীপের কেউ কেউ অনেক সময় ‘আমি কি হনুরে’ একটা ভাবে থাকেন। এই জায়গাতেও কাজ করার সুযোগ আছে। এজন্য প্রধান বিচারপতি ও মন্ত্রণালয়ের সাথে আলোচনা করা যায়। সংশ্লিষ্টরা যদি বিচারকদের এসব বিষয়ে নিয়মিত তদারকি করেন তাহলে কোন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটার আগেই সুন্দর সমাধানের পথ তৈরি হবে।
ল’ ইয়ার্স ক্লাব: আইনজীবীদের পেশাগত মান উন্নয়নে বার কাউন্সিলের ভূমিকা কেমন হওয়া উচিৎ, এক্ষেত্রে বার কাউন্সিলের সফলতা-ব্যর্থতা কিভাবে মূল্যায়ন করবেন?
মোখলেসুর রহমান বাদল: আইনজীবীদের পেশাগত মান উন্নয়নে বার কাউন্সিলের সফলতা-ব্যর্থতা দুটোই রয়েছে। গত নির্বাচনের আগে কথা দিয়েছিলাম বার কাউন্সিলের জরাজীর্ণ ভবন ভেঙ্গে নতুন ভবন নির্মাণ করা হবে। সুরম্য বহুতল ভবন নির্মাণ কাজ বাস্তবায়ন করে এই কমিটি সেই কথা রেখেছে। দেশের অন্য যে কোন পেশাজীবীদের ভবনের চেয়ে বার কাউন্সিলের ভবন দৃষ্টিনন্দন হয়েছে। যা আইনজীবীদের মান-মর্যাদা বৃদ্ধি করেছে বলে মনে করি। আমাদের সফলতার মধ্যে এটি একটি। কথা দিয়েছিলেম আইনজীবীদের বেনাভোলেন্ট ফান্ড বৃদ্ধি করা হবে, করেছি।
এছাড়া ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা প্রতিষ্ঠানে আইন শিক্ষার যাচ্ছে তাই অবস্থা নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়েছি। বেশ কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছিল যেখানে কোন শিক্ষার্থী ভর্তি হলেই পাশ, ইচ্ছা করেও অকৃতকার্য হওয়ার কোন সুযোগ ছিলনা। যা আইনপেশার জন্য ক্ষতিকর হয়ে দাঁড়িয়েছিল। বার কাউন্সিলের লিগ্যাল এডুকেশন কমিটি এদের লাগাম টেনে ধরে নিয়ন্ত্রণে সক্ষম হয়েছে।
এছাড়াও সনদপ্রার্থীদের কষ্ট লাঘবে অনলাইন ফরম পূরণের ব্যবস্থা করা হয়েছে, যা আগেও একবার মেনশন করেছি। তবে করোনা মহামারির কারণে বেশকিছু পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। কিন্তু করোনা কিছুটা স্তিমিত হওয়ার সাথে সাথেই সনদ পরীক্ষার দীর্ঘসূত্রিতা নিরসনে দ্রুত সময়ে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। আগামীতেও এ ধারাবাহিকতা বজায় থাকবে বলে আমার প্রত্যাশা।
ল’ ইয়ার্স ক্লাব: এবার একটু আইন শিক্ষা প্রসঙ্গে আসি, যেহেতু দেশের আইন পড়ুয়াদের সিংহভাগই বিচার ব্যবস্থায় (বিচারক কিংবা আইনজীবী) ক্যারিয়ার গড়ছে সেহেতু আইন শিক্ষা ব্যবস্থায় কারিকুলাম সেট করার ক্ষেত্রে বার কাউন্সিলের আইনগত এখতিয়ার আছে কি-না? এক্ষেত্রে আদালতের নির্দেশে প্রতি সেমিস্টারে শিক্ষার্থীর সংখ্যা নির্ধারণ করে দেওয়া ছাড়া পাঠ্যসূচী তৈরিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুষদের সাথে সমন্বয় সাধনে বার কাউন্সিল বিশেষ কোন ভূমিকা রাখতে পেরেছে কিনা?
মোখলেসুর রহমান বাদল: দেখুন, সুপ্রিম কোর্টের আপীল বিভাগ থেকে যখন এসব বিষয়ে দায়বদ্ধতার জায়গায় দাঁড় করানো হল, তখন বার কাউন্সিল পরিকাঠামোগত দিক থেকে মোটেও প্রস্তুত ছিলনা। কারণ আপনারা সকলেই জানেন, বার কাউন্সিলে চরম জনবল সংকট রয়েছে। ফলে এসব বিষয়ে তদারকির সুযোগ ছিলনা। তবে আমরা হাল ছেড়ে দেইনি। সাধ্য অনুযায়ী এসব বিষয়ে ব্যবস্থা নিয়েছি। ইতোমধ্যে শিক্ষার্থী সংখ্যা নির্ধারণ করে দেওয়া, শিক্ষা সনদ যাচাই-বাছাইসহ নানা বিষয়ে কাজ করেছি। সামনের দিনগুলোতে আইন শিক্ষার্থীদের সিলেবাস, কারিকুলাম কেমন হবে, কীভাবে পুঁথিগত বিদ্যার পাশাপাশি প্রায়োগিক জ্ঞানের সমন্বয় করে পাঠদান কার্যক্রম পরিচালিত হবে সেসব বিষয়ে বার কাউন্সিল কাজ করবে। ইনশাআল্লাহ্ দ্রুতই এই সমস্যাও দ্রুত নিষ্পত্তি হবে।
ল’ ইয়ার্স ক্লাব: আইন শিক্ষার গুণগত মান উন্নয়নে বিশেষায়িত আইন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন কিনা?
মোখলেসুর রহমান বাদল: আইন শিক্ষার গুনগত মান উন্নয়নে স্বতন্ত্র আইন বিশয়বিদ্যালয়ের প্রয়োজনীয়তা আছে, এই বিষয়ে সন্দেহ নাই। আমরা চেষ্টা করছি যেন এটা বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের মধ্যমেই প্রতিষ্ঠা করা যায়। ইতোমধ্যে বিষয়টি নিয়ে বার কাউন্সিলের নেতৃবৃন্দের মধ্যে আলোচনা হয়েছে, কীভাবে একটি বিশেষায়িত আইন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা যায়।
ল’ ইয়ার্স ক্লাব: আপনি আসন্ন বার কাউন্সিল নির্বাচনে সাধারণ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন, নির্বাচিত হলে আইনজীবীদের পেশাগত মান উন্নয়ন ও আইন শিক্ষা ব্যবস্থার গুণগত পরিবর্তনে বিশেষ কোন পরিকল্পনা আছে কিনা?
মোখলেসুর রহমান বাদল: সঠিকভাবে আইন চর্চা না হলে, গণতন্ত্র সঠিক পথ পায় না। গণতন্ত্র সঠিক পথে চলতে হলে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আর আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় আইনজীবীদের পেশাগত মান ও দক্ষতা অর্জন খুবই প্রয়োজন। আবার এক্ষেত্রে বার কাউন্সিল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে বলে প্রতিষ্ঠানটির কর্যক্রমে স্বচ্ছতা জরুরি। এই বিষয়গুলোতে বিগত সময়ে আমিসহ যারা দায়িত্বে ছিলেন সকলেই সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছেন, এটি ভবিষ্যতেও অব্যাহত থাকবে। বার কাউন্সিলের সভায় এসব বিষয়ে নানান সংস্কারমূলক প্রস্তাব আমি তুলে ধরেছি।
সম্প্রতি সরকারি প্রণোদনার ২০ কোটি টাকার চেক হস্তান্তর অনুষ্ঠানেও আমি মাননীয় আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক ও বঙ্গবন্ধু আওয়ামী আইনজীবী পরিষদের সদস্য সচিব ব্যারিস্টার ফজলে নূর তাপস সাহেবের কাছে বেনাভোলেন্ট ফান্ড বৃদ্ধির জন্য সরকারের কাছ থেকে একশ কোটি টাকা অনুদান আনার দাবী উত্থাপন করেছি। একটি সাধারণ পরিবার থেকে উঠে আসা একজন সাধারণ আইনজীবী হিসেবে সকল আইনজীবী বন্ধুর কল্যাণে কাজ করার তাগিদ আমি সবসময় অনুভব করেছি এবং যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি। সুযোগ পেলে আগামীতেও এসব বিষয়ে সক্রিয় ভূমিকা রাখবো ইনশাআল্লাহ্। সবাই আমার জন্য দোয়া করবেন।
ল’ইয়ার্স ক্লাব: আমাদের পাঠকদের উদ্দেশ্যে আপনার মূল্যবান সময় দেয়ার জন্য ধন্যবাদ।
মোখলেসুর রহমান বাদল: ল’ইয়ার্স ক্লাব বাংলাদেশ ডটকমকেও ধন্যবাদ। এই পোর্টালের সকল পাঠক ও শুভানুধ্যায়ীদের প্রতি আন্তরিক শুভেচ্ছা।