মুহাম্মদ আবু সিদ্দিক ওসমানী: ঈদুল ফিতরের পর থেকে সারাদেশে সয়াবিন তেলসহ সব ধরনের ভোজ্য তেলের অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধি ও মজুতদারি নিয়ে চলছে ব্যাপক অরাজকতা। এ অরাজকতা মূলত শুরু হয় গত ৫ মে বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স এন্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স এসোসিয়েশন সয়াবিন তেলসহ বিভিন্ন ভোজ্য তেলের বাজার দর অস্বাভাবিকভাবে বাড়িয়ে এক প্রেস বিজ্ঞপ্তি দেওয়ার পর থেকে। এই মূল্য বৃদ্ধির পর সারাদেশে পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ের দোকানগুলোতে সয়াবিন তেল সহ অন্যান্য ভোজ্য তেল উধাও হয়ে যায়। বাড়তি দরেও ভোজ্য তেল পাওয়া যাচ্ছেনা।
এক পর্যায়ে স্বয়ং বাণিজ্য মন্ত্রী বললেন, “ব্যবসায়ীরা তার কাছে দেওয়া কথা রাখেনি। রমজান মাসে মানুষের দুর্ভোগের কথা চিন্তা করে তেলের দাম না বাড়িয়ে ঈদুল ফিতরের পর তেলের দাম বাড়ালেও তেল মজুত করবেন না বলে ব্যবসায়ীরা বাণিজ্য মন্ত্রীকে কথা দিয়েছিলেন। কিন্তু ব্যবসায়ীরা রমজান মাসে তেল মজুত করে মজুতকৃত তেল বর্ধিত দরে বিক্রি করার জন্য বাজারে তেলের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করেছে।” তেলের দাম বাড়ানোর পর মজুতকৃত তেলের পাত্রে পূর্বের দামের উপর আরেক দফা লেবেল পাল্টিয়ে দাম বাড়িয়ে তেল বিক্রি করা হচ্ছে।
এরপর ভোক্তা অধিদপ্তর বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে অসাধু ব্যবসায়ীদের মজুতকৃত দায়সারা গোসরোর নামমাত্র কিছু তেল উদ্ধার করে ব্যবসয়ায়ীদের নগন্য কিছু জরিমানা করে ভোক্তা অধিকার কর্তৃপক্ষ তাদের দায় সারছেন। ভোক্তা অধিকার কর্তৃপক্ষ কোন আইনে এ নগন্য জরিমানা করছেন তাও বোধগম্য নয়।
কিন্তু কথা হলো, ভোক্তা অধিকার কর্তৃক অভিযান চালিয়ে উদ্ধারকৃত অবৈধভাবে মজুতকৃত তেল বাজেয়াপ্ত করা হচ্ছেনা কেন? অবৈধ মজুত থেকে উদ্ধারকৃত তেল বাজেয়াপ্ত করে টিসিবি’র মাধ্যমে বা সরকারের অন্য কোন সংস্থার মাধ্যমে স্বল্প ও সহনীয় মূল্যে সহজে বিক্রি করা যেত। তাতে দেশের সাধারণ মানুষ কিছুটা হলেও উপকৃত হতো। অবৈধ তেল মজুতকারীরও ন্যুনতম শাস্তি হতো।
তারচেয়ে বড় কথা হলো, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর তৎকালীন অতি মুনাফালোভী অসাধু ব্যবসায়ী চক্র নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য মজুত করে বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে আসছিল। অসাধু ব্যবসায়ীদের এ জগণ্য তৎপরতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান উপলব্ধি করতে পেরে অসাধু, দেশ বিরোধী তথাকথিত ব্যবসায়ীদের মজুতদারি ঠেকনোর জন্য ১৯৭৪ সালে “মজুতদার বিরোধী বিশেষ ক্ষমতা আইন” (hoarding) প্রণয়ন ও প্রয়োগ করেছিলেন। এ আইনে মজুতদার (hoarding) ও কালো বাজারী (Black marketing) এর সুস্পষ্টভাবে পৃথক সজ্ঞা দেওয়া হয়েছে।
মজুতদারি (hoarding) বিরোধী এই বিশেষ ক্ষমতা আইনের ২৫ ধারায় সুস্পষ্টভাবে বলা আছে-অবৈধ মজুতদারি প্রমাণিত হলে তার সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ড অথবা যাবজ্জীবন কারাদন্ড। এ আইনে সর্বনিম্ন শাস্তি হলো-১৪ বছরের কারাদন্ড। আর যাবজ্জীবন মানে ৩০ বছরের কারাদন্ড। মজুতদারি বিরোধী পরিস্থিতি মোকাবেলা করার জন্য বিদ্যমান এ আইনেই যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে।
অবৈধ মজুতদারি সাধারণ কোন অপরাধ নয়। দেশের আপামর জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে দন্ডনীয় অপরাধ। তথা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অপরাধ।
অবৈধ মজুতদারি বিরোধী সুস্পষ্ট আইন দেশে বিদ্যমান থাকলেও সম্প্রতি ভোজ্য তেল মজুত করে দেশে চরম অরাজকতা সৃষ্টি করলেও এই বিশেষ ক্ষমতা আইনের দেশের কোথাও কোন প্রয়োগ হতে এ পর্যন্ত দেখা যায়নি। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারে উদাসীন বলে মনে হয়েছে।
মজুতদারি বিরোধী বিশেষ ক্ষমতা আইনে মামলা হলে অসাধু ব্যবসায়ীদের মজুতদারি কিছুটা হলেও হয়ত কমে আসতো। অবৈধ মজুতদারির বিরুদ্ধে মামলা করতে হলে-অভিযান চালিয়ে অবৈধ মজুতদারি প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত হলে ভোক্তা অধিকার কর্তৃপক্ষ অথবা রাষ্ট্রের অন্যকোন দায়িত্বশীল সংস্থাকেই এ আইনে মামলা করতে হবে।
সাধারণ নাগরিকদের পক্ষে এ বিষয়ে মামলা করা অনেকটা দুরূহ ও কঠিন কাজ। এজন্য জনস্বার্থে রাষ্ট্রের সংশ্লিষ্ট সংস্থা গুলোকেই অবৈধ মজুতদারি বিরোধী মামলার দায় দায়িত্ব নিতে হবে। এ আইনের যথাযথ প্রয়োগ হলে শুধু ভোজ্য তেল বা নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য নয়, সকল পণ্যের অবৈধ মজুতদারি কমে আসবে।
মজুতদারির বিরুদ্ধে বিশেষ ক্ষমতা আইনের ২৫ ধারায় মামলা দায়ের করা শুরু হলে একদিকে, ভোজ্য তেলের বাজার কিছুটা হলেও নিয়ন্ত্রণে আসতো, বাজারে শৃঙ্খলা আসতো, অন্যদিকে, অবৈধমজুতদারি করে পিঁয়াজ সহ নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টির প্রবণতাও ক্রমান্বয়ে হ্রাস পেতো। সাধারণ মানুষ অসাধু ব্যবসায়ীদের জিম্মি দশা থেকে কিছুটা হলেও মুক্তি পেত।
ভোজ্য তেল নিয়ে পুরো দেশে অরাজকতা সৃষ্টির জন্য যে প্রেস বিজ্ঞপ্তিটা মূল হাতিয়ার হিসাবে কাজ করেছে, সেটি হল বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স এন্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স এসোসিয়েশন এর প্রেস বিজ্ঞপ্তি। এই বিজ্ঞপ্তি কি আসলে সঠিক? নাকি ফেইক। কারণ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হওয়া এ বিজ্ঞপ্তিতে এসোসিয়েশনের কোন প্যাড বা সীল ব্যবহার করা হয়নি। তাছাড়া ভোজ্য তেলের বর্ধিত বাজারদর নির্ধারণ করে দেওয়ার জন্য এ এসোসিয়েশন রাষ্ট্রের প্রপার অথরিটি কিনা-তাও কিন্তু প্রশ্ন সাপেক্ষ বিষয়। এ বিষয়ে রাষ্ট্রের সংশ্লিষ্ট সংস্থার আদৌ অনুমোদন আছে কিনা।
অন্যদিকে, উৎপাদন পর্যায়ে, ডিলার বা এজেন্ট পর্যায়ে, পাইকারি পর্যায়ে এবং খুচরা বিপনন পর্যায়ে কতটুকু বা কি পরিমান পণ্য মজুত রাখা যাবে তারও একটা বিধিবদ্ধ নিয়ম থাকা দরকার।
আমাদের দেশে প্রয়োজনীয় অনেক আইন আছে, কিন্তু কার্যক্ষেত্রে তার যথাযথ প্রয়োগ নেই। ফলে অনেকক্ষেত্রে জনদুর্ভোগ বাড়ছে। এ অবস্থায় ভোজ্য তেল, পিঁয়াজ সহ সব ধরনের পণ্য মজুতদারি ঠেকিয়ে অস্থির বাজারে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে ১৯৭৪ সালের মজুতদারি বিরোধী বিশেষ ক্ষমতা আইনে ২৫ ধারার কঠোর ও যথাযথ প্রয়োগ করা দরকার।
লেখক: আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট।