সৈয়দ রিয়াজ মোহাম্মদ বায়েজিদ: মানুষ তার সামাজিক, পারিবারিক, বংশগত বা ব্যক্তিগত অবস্থানে আত্মসম্মান নিয়েই বসবাস করতে চায় অথবা মানুষ তার মৃত্যুর পূর্বে বা পরে তার মান-মর্যাদা বা সম্মান বা সুনাম অক্ষুন্ন রেখে এ পৃথিবীতে টিকে থাকার প্রচেষ্টা চালিয়ে যায়। সুস্থ মস্তিষ্কের কোন ব্যক্তি চায় না সমাজে তার মান-মর্যাদা বা সম্মানহানি হোক। সম্মানহানি বা মানহানি বলতে আমরা কি বুঝি! ‘মানহানি’ বলতে এমন কোন কাজ বা কথা বলার ধরণ যাতে কারো মান বা প্রতিষ্ঠা নষ্ট হয়।
আমাদের বাংলাদেশ সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৩৯ অনুযায়ী বাংলাদেশী নাগরিকদের বাকস্বাধীনতার কথা বলা হয়েছে, তবে এর মানে এই নয় যে, কোন ব্যক্তিকে তার সম্মানহানি বা সুনাম নষ্ট করার জন্য উদ্দেশ্যমূলকভাবে কোন কথা বলার অধিকার একজন নাগরিককে দেয়া হয়েছে।
দি পেনাল কোড, ১৮৬০ এর ৪৯৯ ধারা অনুযায়ী, কোন ব্যক্তি অন্য কোন ব্যক্তির সুনাম নষ্ট করার জন্য উদ্দেশ্যমূলকভাবে এমন কথা বলে বা এমন কিছু লিখে অথবা এমন কোন চিহ্নাদি ব্যবহার করে যাতে অপর ব্যক্তির সুনাম নষ্ট হয় তাহলে সেক্ষেত্রে মানহানি হয়। কোন ব্যক্তির বিরুদ্ধে অপপ্রচার ও মিথ্যা বক্তব্য প্রদান বা প্রচারের মাধ্যমে সুনামহনি করাই হচ্ছে মানহানি। কোন মৃত ব্যক্তি সম্পর্কে অপপ্রচার বা সুনাম নষ্ট করে কোন কিছু করলে তাও মানহানি হয়। এক্ষেত্রে মৃত ব্যক্তির আত্মীয় চাইলে মানহানির অভিযোগ আনতে পারে।
যেসব বিষয় মানহানি নয়
বাংলাদেশী আইনে যেসকল ক্ষেত্রে কোন ব্যক্তি অন্য কোন ব্যক্তির নামে কোন কিছু প্রকাশ বা প্রচার করলে তাতে মানহানি হবে না, সেগুলো হলো-
১। জনগণের কল্যাণে কারো প্রতি সত্য দোষারোপ করলে তাতে মানহানি হবে না।
২। সরকারি কর্মচারীর সরকারি আচরণ সম্পর্কে সৎবিশ্বাসে অভিমত প্রকাশ করলে তা মানহানির শামিল হবে না।
৩। সরকারি বিষয় সংশ্লিষ্ট প্রশ্নে কোন ব্যক্তির আচরণ নিয়ে মত প্রকাশ করলে মানহানি নয়।
৪। আদালতসমূহের কার্য বিবরণী প্রতিবেদন প্রকাশ করা মানহানির অন্তর্ভূক্ত হবে না।
৫। যে কোন জনসমস্যা সম্পর্কে ও কোন ব্যক্তির আচরণ সম্পর্কে সৎবিশ্বাসে অভিমত প্রকাশ করা মানহানির শামিল নয়।
৬। আদালতে সিদ্ধান্তকৃত মামলার দোষ, গুণ বা স্বাক্ষীদের সম্পর্কে বাঅন্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের আচরণ সম্পর্কে অভিমত মানহানির পর্যায়ে পড়বে না।
৭। গণ অনুষ্ঠানের অনুষ্ঠানাদি সম্পর্কে কোন মতামত প্রদান মানহানি নয়।
৮। কর্তৃত্বসম্পন্ন ব্যক্তির কাছে সৎবিশ্বাসে কারো সম্পর্কে অভিযোগ করা হলে সেটিও মানহানি হবে না।
৯। কোন ব্যক্তি কর্তৃক তার বা অন্য কারো স্বার্থ রক্ষার্থে দোষারোপ করা মানহানি নয়।
১০। জনকল্যানার্থে সতর্কতা প্রদানের উদ্দেশ্যে কারো সম্পর্কে কিছু বলা হলে সেটিও মানহানি হবে না।
দি পেনাল কোড, ১৮৬০ এর ৫০০ ধারায় মানহানির শাস্তি সম্পর্কে বলা হয়েছে। মানহানির অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হলে ২ বছর বিনাশ্রম কারাদন্ড বা অর্থদন্ড বা উভয়বিধ দন্ড হতে পারে। এছাড়া এই আইনের ৫০১ ও ৫০২ ধারায় বলা হয়েছে, মানহানিকর বলে পরিচিত বিষয় মুদ্রণ বা খোদাইকরণ সম্পর্কে এবং এর শাস্তি সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে।
অনলাইনে মানহানি ও শাস্তির বিধান
যদি কোন ব্যক্তি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম কিংবা যে কোন ওয়েবসাইটে বা ফেইসবুকে যদি মানহানিকর কিছু প্রকাশ করে বা বক্তব্য প্রকাশ করে তাহলে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৮ এর ২৯ ধারা মোতাবেক ৩ বছরের কারাদন্ড বা ৫ লক্ষ টাকা অর্থদন্ড বা উভয়েই। তবে কেউ যদি একই অপরাধের পুনরাবৃত্তি করে তাহলে ৫ বছরের কারাদন্ড বা ১০ লক্ষ টাকা অর্থদন্ড বা উভয়ই।
বর্তমান সময়ে দেখা যাচ্ছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একজন অন্যজনের পোস্টে কোন কিছু চিন্তা না করেই খারাপ মন্তব্য, অসম্মানজনক কমেন্ট বা কটূক্তি বা মিথ্যা কিছু সহজেই বলে ফেলছে। এতে মানহানি হচ্ছে এবং মানহানির অভিযোগ আনা হচ্ছে।
সুতরাং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বা ইলেক্ট্রনিক বিন্যাসে কোন ব্যক্তির নামে খারাপ মন্তব্য বা বক্তব্য প্রকাশ বা প্রচার একটি আইনত দন্ডনীয় অপরাধ। বাংলাদেশী আইনে মানহানি শুধুমাত্র ফৌজদারী অপরাধ নয় বরং এটি দেওয়ানী অপরাধও বটে। মানহানির মাধ্যমে ক্ষতিপূরণ আদায়ের মোকদ্দমা করতে হলে দেওয়ানী আদালতে মামলা দায়ের করতে হবে।
কানাডা, নিউজিল্যান্ড, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্রে মানহানি টর্ট আইনে অন্তর্ভূক্ত। মালয়েশিয়া, শ্রীলংকা, ভারত-এ মানহানির বিরুদ্ধে দেওয়ানী ও ফৌজদারী উভয় আইনে নাগরিকদের বিরুদ্ধে প্রতিকার চাওয়া যায় যা আমাদের দেশের মতোই। অস্ট্রেলিয়ায় ডিফামেশান এ্যাক্ট, ২০০৫ অনুযায়ী কোন ব্যক্তি দ্বারা কৃত মানহানির বিচার হয়।
সুতরাং দেখা যাচ্ছে, আমাদের দেশের মতো বিশ্বে বিভিন্ন দেশেও নাগরিকদের বিরুদ্ধে উত্থাপিত মানহানির অভিযোগের বিচার প্রচলিত দেওয়ানী ও ফৌজদারী আদালতে হয়।
লেখক: আইনজীবী; জজ কোর্ট, চট্টগ্রাম।