সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার (এস কে) সিনহার অপকর্ম সম্পর্কে অবগত থাকা সত্ত্বেও পরিবারের সদস্য হওয়ায় চুপ ছিলেন বলে জানিয়েছেন তাঁর বড় ভাই নরেন্দ্র কুমার সিনহা।
দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) প্রধান কার্যালয়ে সাক্ষ্য শেষে সোমবার (১৬ মে) সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে এ কথা বলেন এস কে সিনহার বড় ভাই নরেন্দ্র কুমার সিনহা।
নরেন্দ্র কুমার সিনহা সাংবাদিকদের বলেন, ‘এস কে সিনহার সঙ্গে আমাদের পারিবারিক দূরত্ব ছিল আগে থেকেই। তার অপকর্ম সম্পর্কে আমরা ওয়াকিবহাল ছিলাম, কিন্তু পারিবারের সদস্য হওয়ায় আমরা চুপ ছিলাম।’
দুদকের উপ-পরিচালক গুলশান আনোয়ার প্রধানের ডাকে সাড়া দিয়ে নরেন্দ্র কুমার সিনহাসহ ৩ জন সোমবার কমিশনে হাজির হন। এদিন দুপুর দেড়টায় তাদের দুদকের একটি মাইক্রোবাসে করে আদালতে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে আদালতে তারা এসকে সিনহার বিরুদ্ধ ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেন বলে জানা গেছে। দুদকে আসা অন্য দুইজন হলেন শঙ্খজিৎ সিংহ ও ইঞ্জিনিয়ার সুজিত।
ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে আলাদাভাবে ১৬৪ ধারায় ওই তিনজন জবানবন্দি দেন বলে দুদকের আদালত নিবন্ধন শাখার কর্মকর্তা মো. জুলফিকার জানিয়েছেন।
মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মামুনুর রশীদ চৌধুরীর খাস কামরায় জবানবন্দি দেন সিনহার ভাই নরেন্দ্র কুমার সিনহা, মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ জসীমের খাসকামরায় নেওয়া হয় সিনহার ভাতিজা শঙ্খজিৎ সিংহের জবানবন্দি, তার আত্মীয় সুজন কুমার সিংহ জবানবন্দি দেন মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মেহেদী হাসানের খাস কামরায়।
এর আগে বিদেশে অবস্থানরত সিনহার বিরুদ্ধে করা এই মামলার তদন্ত কর্মকর্তা দুদকের উপ-পরিচালক গুলশান আনোয়ার ওই তিনজনের জবানবন্দি নেওয়ার আবেদন করেন।
জুলফিকার বলেন, “জবানবন্দিদাতারা যেহেতু ঘটনার আগাগোড়া সব জানেন, পরে বিচারের সময় তারা যেন অভিযুক্ত কর্তৃক প্রভাবান্বিত হয়ে মিথ্যা সাক্ষ্য দিতে না পারেন, সে জন্যই মূলত তাদের জবানবন্দি নেওয়া হয়।”
উল্লেখ্য, দুদক উত্তরায় প্লট জালিয়াতির ঘটনায় ২০২১সালের ৭ অক্টোবর এসকে সিনহার বিরুদ্ধে ৭ কোটি ১৪ লাখ ৫ হাজার ৮৬৫ টাকা অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে মামলা করে।
মামলায় বলা হয়, সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা তার নিজ নামে ইতোপূর্বে রাজউক থেকে উত্তরা আবাসিক এলাকায় একটি প্লট বরাদ্দপ্রাপ্ত হন। পরে তিনি অসৎ উদ্দেশ্যে নিজ ক্ষমতার অপব্যবহার করে অবৈধ প্রভাব বিস্তারের মাধ্যমে প্রতারণার আশ্রয়ে তার ভাই নরেন্দ্র কুমার সিনহার নামে রাজউক পূর্বাচল প্রকল্পে প্লটের জন্য আবেদন করান এবং ৩ কাঠার একটি প্লট বরাদ্দ করান। পরে ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে ওই তিন কাঠার প্লটটি পাঁচ কাঠার প্লটে উন্নীত করান।
পূর্বাচল থেকে প্লট স্থানান্তর করে উত্তরার সেক্টর-৪, রোড নং-৬, বাড়ি নং-১/এ প্লটটি রাজউক থেকে অনুমোদন করান। সুরেন্দ্র কুমার সিনহা নিজেই ওই প্লটের যাবতীয় অর্থ মোট ৭৫ লাখ টাকা পরিশোধ করেন। পরে ওই প্লটে ৯তলা ভবন নির্মাণ করেন।
দুদক সূত্রে আরও জানা যায়, অনুসন্ধানকালে নিরপেক্ষ প্রকৌশলীর প্রতিবেদন অনুযায়ী, উত্তরা আবাসিক এলাকায় সেক্টর-৪ এর বাড়িটির নির্মাণ ব্যয় ৬ কোটি ৩১ লাখ ৫ হাজার ৮৬৫ টাকা। এছাড়া ওই প্লটের মূল্য হিসেবে রাজউকে পরিশোধ করা হয় ৭৫ লাখ টাকা। সে হিসেবে প্লটের মূল্যসহ ভবন নির্মাণ ব্যয় দাঁড়ায় ৭ কোটি ৬ লাখ ৫ হাজার ৮৬৫ টাকা। এর মধ্যে খালেদা চৌধুরীর কাছ থেকে ফ্ল্যাট বিক্রির অগ্রিম বাবদ ৭০ লাখ টাকা টাকা পান। ওই টাকা বাদে অবশিষ্ট ৬ কোটি ৩৬ লাখ ৫ হাজার ৮৬৫ টাকা ও সিনহার পরিচিত শঙ্খজিৎ সিংহের নামে স্থায়ী ও নগদে ৭৮ লাখ টাকা জমা করেন।
অর্থাৎ ৭ কোটি ১৪ লাখ ৫ হাজার ৮৬৫ টাকার সম্পদ সুরেন্দ্র কুমার সিনহা ক্ষমতার অপব্যবহার ও প্রতারণার মাধ্যমে নিজ ভাই এবং আত্মীয়ের নামে-বেনামে অর্জন করেছেন। যার কোনো বৈধ উৎস নেই বা তার জ্ঞাত আয়ের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ।
দুদকে এসকে সিনহার বিরুদ্ধে মোট তিনটি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে ঋণ জালিয়াতি ও অর্থপাচারের দুই মামলায় সাবেক এই প্রধান বিচারপতিকে চার ও সাত বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। এর মধ্যে ঋণ জালিয়াতির মামলায় চার বছর এবং অর্থ পাচারের মামলায় সাত বছরের কারাদণ্ড হয় তার।