ফেনীর আলোচিত ফুলগাজী উপজেলা চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি একরামুল হক একরাম হত্যার ৮ বছর পূর্ণ হলেও মেলেনি বিচার। রায় ঘোষণার চার বছর হলেও বহুল আলোচিত এ মামলার রায় কার্যকর না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছে একরামের পরিবার ও তার সমর্থক গোষ্ঠী। এ হত্যাকাণ্ডের রায় বাস্তবায়ন আদৌ হবে কিনা, তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করছেন অনেকে।
২০১৪ সালের ২০ মে প্রকাশ্যে ফেনী শহরের একাডেমি এলাকায় একরামকে গুলি করে, কুপিয়ে ও গাড়িসহ পুড়িয়ে নৃংশসভাবে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। এ নিয়ে দেশ-বিদেশে সমালোচনার ঝড় উঠলে হত্যার ঘটনায় জড়িতরা একের পর এক গ্রেফতার হতে থাকে। এতে ঘটনার নেপথ্যে থাকাদের মুখোশ উন্মোচিত হয়। বেরিয়ে আসে দলীয় অন্তঃকোন্দলই এ হত্যাকাণ্ডের কারণ। হত্যার সঙ্গে রাঘববোয়ালদের নাম বেরিয়ে এলে আত্মগোপনে চলে যায় হত্যাকারীরা।
ঘটনার প্রতিবাদে ও হত্যাকারীদের গ্রেফতার দাবিতে ফুঁসে ওঠে এলাকাবাসী। হরতাল-অবরোধ-বিক্ষোভসহ মাসব্যাপী বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করেন তারা। এ ঘটনায় একরামের বড় ভাই রেজাউল হক জসিম বাদী হয়ে বিএনপি নেতা মাহাতাব উদ্দিন চৌধুরী মিনারের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাত ৩০-৩৫ জনকে আসামি করে ফেনী থানায় মামলা করেন।
হত্যার ১০০ দিন পর ওই বছরের ২৮ আগস্ট মামলার তদন্ত কর্মকর্তা আবুল কালাম আজাদ ৫৬ জনকে আসামি করে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। আদালত ১২ নভেম্বর আলোচিত এ হত্যা মামলার অভিযোগপত্র গ্রহণ করেন। অভিযোগপত্র দাখিলের ১৬ মাস পর ২০১৭ সালের ১৫ মার্চ আদালত মামলার চার্জ গঠন করেন আদালত। এরপর শুরু হয় বিচারকাজ।
আদালত মামলার বাদী একরামের ছোট ভাই এহসানুল হক, নিহতের স্ত্রী তাসমিন আক্তার, গাড়ি চালক আব্দুল্লাহ আল মামুনসহ ৫০ জন সাক্ষীর সাক্ষ্য নেন। মামলায় ৫৯ জনকে সাক্ষী করে পুলিশ। এর মধ্যে সাধারণ সাক্ষী ছিলেন ২৮ জন। গ্রেফতারদের মধ্যে ১৬ আসামি আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত একাধিক চাপাতি ও ৫টি পিস্তলের মধ্যে কয়েকটি চাপাতি এবং দুটি পিস্তল উদ্ধার করে পুলিশ।
২০১৮ সালের ১৩ মার্চ দুপুরে ফেনী জেলা ও দায়রা জজ আমিনুল হক এ মামলার রায় ঘোষণা করেন। রায়ে ৩৯ আসামিকে মৃত্যুদণ্ড এবং ১৬ জনকে বেকসুর খালাস দেওয়া হয়। ওইদিন একরামের পরিবারের কাউকে আদালত ভবন এলাকায় দেখা যায়নি।
রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত বলেন, স্থানীয় নির্বাচন থেকে আসামিদের সঙ্গে নিহত ব্যক্তির দ্বন্দ্বের সূত্রপাত। রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের কারণে পরিকল্পিতভাবে একজন জনপ্রতিনিধিকে ষড়যন্ত্র করে দিবালোকে হত্যা করা হয়েছে।
এ হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত কারাবন্দি ২২ জন হলেন- হত্যার পরিকল্পনাকারী জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির আদেল, ফেনী পৌরসভার কাউন্সিলর আওয়ামী লীগ নেতা আবদুল্লাহিল মাহমুদ শিবলু, সাজ্জাদুল ইসলাম পাটোয়ারী ওরফে সিফাত, আবু বক্কর সিদ্দিক ওরফে বক্কর, মো. আজমির হোসেন রায়হান, মো. শাহজালাল উদ্দিন শিপন, জাহিদুল ইসলাম জাহিদ ওরফে আজাদ, কাজী শানান মাহমুদ, মীর হোসেন আরিফ ওরফে নাতি আরিফ, আরিফ ওরফে পাণ্ডু আরিফ, রাশেদুল ইসলাম রাজু মো. সোহান চৌধুরী, জসিম উদ্দিন নয়ন, নিজাম উদ্দিন আবু, আবদুল কাইউম, নুর উদ্দিন মিয়া, তোতা মানিক, মো. সজিব, মামুন, রুবেল, হুমায়ূন ও টিপু।
খালাসপ্রাপ্ত ১৬ জন হলো- প্রধান আসামি জেলা তাঁতী দলের সভাপতি মাহতাব উদ্দিন আহম্মেদ চৌধুরী মিনার, একরামের একান্ত সহযোগী আওয়ামী লীগ নেতা বেলাল হোসেন পাটোয়ারী ওরফে টুপি বেলাল, পৌর যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক জিয়াউল আলম মিস্টার, মো. আলমগীর ওরফে আলাউদ্দিন, আবদুর রহমান রউফ, সাইদুল করিম পবন ওরফে পাপন, জাহিদ হোসেন ভূঁইয়া, ইকবাল হোসেন, মো. শাখাওয়াত হোসেন, শরিফুল ইসলাম পিয়াস, কালা ওরফে কালা মিয়া, নুরুল আবসার রিপন, মো. ইউনুস ভূঁইয়া শামীম ওরফে টপ শামীম, মো মাসুদ, কাদের ও ফারুক।
মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তদের ২২ জন রয়েছেন কারাগারে। আটজন জামিনে মুক্ত হয়ে পলাতক এবং চার্জশিটভুক্ত নয়জন শুরু থেকে পলাতক ছিলেন। এর মধ্যে জিয়াউর রহমান বাপ্পি (২৮) নামে একজনকে ২০২১ সালের ১২ নভেম্বর গ্রেফতার করে পুলিশ। দণ্ডপ্রাপ্তদের মধ্যে পলাতক আসামিরা হলো ফুলগাজী উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জাহিদ হোসেন জিহাদ, আবিদুল ইসলাম আবিদ, চৌধুরী মো. নাফিজ উদ্দিন অনিক, আরমান হোসেন কাউসার, জাহেদুল হাসেম সৈকত, জিয়াউর রহমান বাপ্পি, জসিম উদ্দিন নয়ন, এমরান হোসেন রাসেল ওরফে ইঞ্জিনিয়ার রাসেল, রাহাত মো. এরফান ওরফে আজাদ, একরাম হোসেন ওরফে আকরাম, শফিকুর রহমান ওরফে ময়না, কফিল উদ্দিন মাহমুদ আবির, মোসলে উদ্দিন আসিফ, ইসমাইল হোসেন ছুট্টু, মহিউদ্দিন আনিছ, বাবলু ও টিটু। এদের মধ্যে হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে একেবারে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত জাহিদ হোসেন জিহাদ ও আবিদুল ইসলাম আবিদ পালিয়ে দেশের বাইরে চলে যান।
এ হত্যাকাণ্ডের ৮ বছর পূর্ণ হতে চললেও হত্যা মামলার রায় কার্যকর হয়নি এখনও। নিম্ন আদালতের পর হাইকোর্টে দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের ডেথ রেফারেন্স ও জেল আপিলের শুনানি এখনও শুরু হয়নি। রায় নিষ্পত্তিতে ধীরগতির কারণে হতাশা প্রকাশ করেছেন নিহতের স্বজনরা। তাদের দাবি, এ হত্যা মামলার আসামিদের দণ্ড যেন দ্রুত কার্যকর করেন উচ্চ আদালত।
মামলার বাদী নিহত একরামের বড় ভাই রেজাউল হক জসিম জানান, অনেক হত্যা মামলার রায় দ্রুত কার্যকর হলেও উচ্চ আদালতে এ মামলার ফাইল রহস্যজনক কারণে নিচে পড়ে যায়। রাষ্ট্রের কাছে দ্রুত রায় কার্যকর করার দাবি জানান তিনি।