কক্সবাজার থেকে মুহাম্মদ আবু সিদ্দিক ওসমানী: ন্যায়বিচার ও সুশাসন প্রতিষ্ঠায় স্থানীয় সরকার পর্যায়ের জনপ্রতিনিধি মেয়র-কাউন্সিলর, উপজেলা চেয়ারম্যান, ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান-মেম্বারদের ভূমিকা অপরিসীম বলে মন্তব্য করেছেন কক্সবাজারের জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ ইসমাইল।
স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা আদালতে মামলার জট কমাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারেন বলেও মন্তব্য করেন তিনি। এসময় আইনশৃংখলা সুরক্ষা, এলাকার উন্নয়নে, উন্নত সমাজ বিনির্মাণেও তাঁদের অবদান রাখার আহ্বান জানান জেলা আইনগত সহয়তা প্রদান কমিটির চেয়ারম্যান সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ ইসমাইল।
আজ শনিবার (২১ মে) সকাল সাড়ে ১০ টায় জেলা জজ আদালতের সম্মেলন কক্ষে কক্সবাজার জেলার আওতাধীন উপজেলা ও ইউনিয়ন সমূহে আইনগত সহয়তা প্রদান (লিগ্যাল এইড) কমিটি গঠন ও সক্রিয়করণ এবং গ্রাম আদালত পরিচালনা সংক্রান্ত সমন্বয় সভায় সভাপতির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।
সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ আবুল মনসুর সিদ্দিকী এবং জেলা লিগ্যাল এইড অফিসার ও সিনিয়র সহকারী জজ সাজ্জাতুন নেছা লিপি’র সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত সমন্বয় সভায় অন্যান্যের মধ্যে কক্সবাজারের চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আলমগীর মোহাম্মদ ফারুকী, কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের ধর্ম বিষয়ক সম্পাদক অ্যাডভোকেট সিরাজুল মোস্তফা, জেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি অ্যাডভোকেট ফরিদুল ইসলাম চৌধুরী, জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট ইকবালুর রশিদ আমিন সোহেল, কক্সবাজার পৌরসভার মেয়র ও কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মুজিবুর রহমান, জেলা প্রশাসনের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ আবু সুফিয়ান, কক্সবাজার সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান কায়সারুল হক জুয়েল, কক্সবাজার প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ মুজিবুল ইসলাম, সাবেক পিপি অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর, সাবেক পিপি নুরুল মোস্তফা মানিক, সাবেক স্পেশাল পিপি অ্যাডভোকেট নুরুল ইসলাম, সাবেক পিপি অ্যাডভোকেট মমতাজ আহমদ, চকরিয়ার পশ্চিম ভেওলা মানিকচর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সিরাজুল ইসলাম বাবলা, টেকনাফের হোয়াইক্ষ্যং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নুর আহমদ আনোয়ারী, চকরিয়ার সুরাজপুর-মানিকপর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আজিম উদ্দিন, উখিয়ার পালংখালী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান গফুর উদ্দিন, রামু’র দক্ষিণ মিটাছড়ি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান খোদেস্তা বেগম রীনা প্রমুখ উম্মুক্ত আলোচনায় অংশ নেন।
জেলা আইনগত সহয়তা প্রদান কমিটির চেয়ারম্যান মোহাম্মদ ইসমাইল বলেন, গ্রাম আদালত অর্থাৎ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানদের বিচারের আর্থিক ক্ষমতা মাত্র ৭৫ হাজার টাকা। এই আর্থিক ক্ষমতা বাস্তবতার তুলনায় খুবই কম। দেশ উন্নত হয়েছে। দেশের মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে।
সবকিছুর মূল্য বাড়ায় গ্রাম আদালতের বিচারের আর্থিক ক্ষমতা ৭৫ হাজার থেকে বাড়িয়ে ৫ লক্ষ টাকায় উন্নীত করার জন্য এবং গ্রাম আদালতে লোকবল বাড়ানোর জন্য সমন্বয় সভা থেকে সরকারের উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব পাঠানো হবে বলে সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ ইসমাইল জনপ্রতিনিধিদের আশ্বাস দেন।
বিচারক মোহাম্মদ ইসমাইল বলেন, গ্রাম আদালতের এখতিয়ারসম্পন্ন বিচার্য মামলাগুলো বিভিন্ন আদালত থেকে বিচারের জন্য গ্রাম আদালতে পাঠানো হবে। গ্রাম আদালতগুলো আরো সক্রিয় করা হলে কক্সবাজারের আদালতসমূহে মামলার জট কিছুটা হলেও কমবে। সততা, নিষ্ঠা, নিরপেক্ষতা ও পেশাদারিত্ব নিয়ে গ্রাম আদালত ও লিগ্যাল এইড কমিটির দায়িত্ব পালন করার জন্য তিনি উপস্থিত সবার প্রতি আহবান জানান।
তিনি বলেন, কক্সবাজার বিচার বিভাগে ৮০ হাজারেরও বেশি মামলা রয়েছে। তার মাঝে এক হাজারেরও বেশি হত্যা মামলা রয়েছে। ২০ হাজারের বেশি মাদক মামলা রয়েছে।
এসব মামলা নিষ্পত্তি করার জন্য তাঁর আবেদনের প্রেক্ষিতে কক্সবাজারে আরো অতিরিক্ত ৪ জন অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজের পদ সৃজন করায় প্রধানমন্ত্রী, প্রধান বিচারপতি, আইনমন্ত্রী, আইনসচিব, স্থানীয় সংসদ সদস্য সহ সংশ্লিষ্ট সকলের প্রতি আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানান সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ ইসমাইল।
এখতিয়ার ও আর্থিক ক্ষমতা বহির্ভূত মামলা গ্রাম আদালতে বিচার না করার জন্য গ্রাম আদালতের বিচারক প্যানেলের প্রধান ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানদের প্রতি আহবান জানান তিনি। এজন্য গ্রাম আদালতের প্যানেল কমিটি নিয়মতান্ত্রিক ও সুষ্ঠুভাবে গঠন করে বিচারকার্য পরিচালনা করার জন্য নির্দেশনা প্রদান করেন জ্যেষ্ঠ এই বিচারক।
জেলা লিগ্যাল এইড কমিটির চেয়ারম্যান বলেন, প্রধানমন্ত্রীর বদান্যতায় কক্সবাজার জেলায় সাড়ে ৩ লক্ষ কোটি টাকার মেগা উন্নয়ন প্রকল্প চলছে। এজন্য হাজার হাজার কোটি টাকার জমি অধিগ্রহণ করা হচ্ছে। কক্সবাজারে প্রায় ১৫ লক্ষ রোহিঙ্গা শরনার্থী রয়েছে। ভৌগোলিক কারণে কক্সবাজার এলাকায় মাদক পাচার হয় বেশি। এসব কারণে কক্সবাজারে মামলার সংখ্যা বাড়ছে অস্বাভাবিকভাবে। ফলে কক্সবাজারের আদালতসমূহে মামলার জট বাড়ছে। এসব মামলা নিষ্পত্তিতে জনপ্রতিনিধিরা সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারেন। এছাড়া, লিগ্যাল এইড কার্যক্রমকে আরো সক্রিয় ও কার্যকর করতে হবে।
বিচারক মোহাম্মদ ইসমাইল সন্তোষ প্রকাশ করে আরো বলেন, জেলার ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানদের বিরুদ্ধে মাদকের সাথে সম্পৃক্ততার কোন অভিযোগ নাই। তবে কিছু কিছু মেম্বারদের বিরুদ্ধে মাদকের সাথে সম্পৃক্ততার অভিযোগ রয়েছে।
সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ উষ্মা প্রকাশ করে বলেন, কক্সবাজারে এখন বিভিন্ন ধাপের বিচার প্রক্রিয়ায় বিজ্ঞ বিচারকদের নিয়ে টাউট বাটপারেরা প্রতারণা করছে। এ বিষয়টা সকলকে সম্মিলিতভাবে সচেতন ও দায়িত্বের সাথে মোকাবেলা করতে হবে।
সভায় চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আলমগীর মোহাম্মদ ফারুকী সকল পর্যায়ের জনপ্রতিনিধিদের উদ্দেশ্যে বলেন, পৌরসভার মেয়র-কাউন্সিলর, উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও মেম্বরেরা একদিকে জনপ্রতিনিধি, সামাজের নেতা অন্যদিকে, বিচারক, প্রশাসক ও রাজনীতিবিদ। তাঁরা সহজে যেটা পারেন, বিচারকেরা বিভিন্ন সীমাবদ্ধতার কারণে সেটা পারেননা। তাই জনপ্রতিনিধিরা তাঁদের এখতিয়ারভুক্ত মামলাসমূহ নিষ্পত্তির পাশাপাশি এখতিয়ার বহির্ভুত বিরোধও আনঅফিসিয়ালী সহজে নিষ্পত্তি ও আদালতে সুনির্দিষ্ট সুপারিশমালা পাঠাতে পারেন। এতে আদালতের কার্যক্রম সহজ ও সাবলীল হবে এবং মামলার জট কিছুটা হলেও কমবে।
কক্সবাজারের সিজেএম আরো বলেন, গ্রাম আদালতের জন্য যেমন সুনির্দিষ্ট আইন রয়েছে, তেমনি পৌরসভার মেয়রদের জন্যও ২০০৪ সালের অনুরূপ আইন বিদ্যমান আছে। যে আইনে মেয়রেরা সহজে তাঁদের এখতিয়ারভুক্ত বিচারকার্য পরিচালনা করতে পারেন।
তবে এজন্য সকল পর্যায়ের জনপ্রতিনিধি কে সংশ্লিষ্ট আইন ও বিচারকার্য পরিচালনার বিধিমালা জানতে হবে বলে উল্লেখ করেন-বিজ্ঞ চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আলমগীর মোহাম্মদ ফারুকী।
কক্সবাজার জেলা আইনগত সহয়তা প্রদান কমিটির উদ্যোগে আয়োজিত সমন্বয় সভায় যুগ্ম জেলা ও দায়রা জজ-১ মাহমুদুল হাসান, সিনিয়র সহকারী জজ সুশান্ত প্রসাদ চাকমা, জেলা জজশীপ ও ম্যাজিস্ট্রেসীর বিজ্ঞ বিচারকবৃন্দ, কক্সবাজার জেলা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট মোহাম্মদ তাওহীদুল আনোয়ার, টেকনাফ পৌরসভার মেয়র হাজী মোহাম্মদ ইসলাম, টেকনাফ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ নুরুল আলম, স্পেশাল পিপি এডভোকেট বদিউল আলম, এডভোকেট একরামুল হুদা, জেলা আইনজীবী সমিতির জ্যেষ্ঠ আইনজীবীবৃন্দ, সাবেক পাবলিক প্রসিকিউটরবৃন্দ, জেলার অধিকাংশ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।
সভার শুরুতে কোরআন তেলাওয়াত করেন, সহকারী জজ আবদুল মান্নান এবং ত্রিপিটক পাঠ করেন যুগ্ম জেলা জজ আদালত-১ এর বেঞ্চ সহকারী সেতু বড়ুয়া। আইনগত সহয়তা প্রদান আইন-২০০০ এর আলোকে উপজেলা ও ইউনিয়ন কমিটি গঠন ও সক্রিয়করণ সংক্রান্ত নির্দেশনা প্রদান করেন জেলা লিগ্যাল এইড অফিসার ও সিনিয়র সহকারী জজ সাজ্জাতুন নেছা লিপি।
অনেক ব্যস্ততার মাঝেও জনপ্রতিনিধিরা জেলা আইনগত সহয়তা প্রদান কমিটির সমন্বয় সভায় অংশ নেওয়ায় লিগ্যাল এইড কমিটির চেয়ারম্যান মোহাম্মদ ইসমাইল তাঁদের ধন্যবাদ জানান।