এমিল ডুর্খেইমের মতে আত্মহত্যা একটি সামাজিক ঘটনা। তিনি সামাজিক সংহতি এবং সামাজিক সচেতনতার সঙ্গে আত্মহত্যা সম্পর্ক নিরূপণ করেছেন।
আত্মহত্যা প্রসঙ্গে অ্যারোন বলেন, আত্মহত্যা হলো আত্মহত্যাকারী কর্তৃক প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ইতিবাচক বা নেতিবাচক ঘটনা যা মৃত্যু ঘটায়। তাই বলা যায় আত্মহনন করা তথা নিজের জীবন নিজের দ্বারা নিঃশেষ হওয়া হলো আত্মহত্যা।
আত্মহত্যা প্রসঙ্গে ডুর্খেইম বলেন, যারা সমাজের সঙ্গে অতিমাত্রায় সম্পৃক্ত তারা আত্মহত্যা করে। আবার যারা সমাজ থেকে অতিমাত্রায় বিচ্ছিন্ন তারাও আত্মহত্যা করে। এ কারণে বিভিন্ন ধরনের আত্মহত্যার ধারণা দেন।
সারাবিশ্বে প্রতি ২ সেকেন্ডে একজন মানুষ আত্মহত্যার চেষ্টা করছেন এবং প্রতি ৪০ সেকেন্ডে একজন সফলভাবে আত্মহত্যা করছেন।
কেউ নিজের জীবনকে শেষ করে ফেললেই আত্মহত্যা। জীবনের আয়ু ফুরিয়ে যাবার আগেই যদি নিজেকে গুটিয়ে নেয়া হয় সেটিই আত্মহত্যা। স্রষ্টার দেয়া আশরাফুল মাখলুকাত উপাধির সাথে আত্মহত্যা একটি প্রতারণা। কোন ক্রমেই নিজের জীবনকে শেষ করে দেয়া উচিত নয়।
বাংলাদেশের আইনে আত্মহত্যার শাস্তি
বিদ্যমান আইনে আত্মহত্যা কোন অপরাধ না হলেও আত্মহত্যার চেষ্টা করা অপরাধ। কেউ আত্মহত্যা করে নিহত হলে আইন তো আর তাকে শাস্তি দিতে পারবে না। তবে চেষ্টা করে ব্যর্থ হলে আইন তাকে ঠিকই সাজা দেওয়ার ক্ষমতা রাখে।
দন্ডবিধির ৩০৯ ধারায় বলা হয়েছে, আত্মহত্যা করতে যেয়ে ব্যর্থ হলে এক বছর পর্যন্ত জেল ও এক হাজার টাকা পর্যন্ত। আত্মহত্যার চেষ্টায় দণ্ড হবে। তবে আত্মহত্যা সফল হলে জেল-জরিমানা মাফ! অর্থাৎ এইজন্য অন্য কাউকে ঝামেলা পোহাতে হবে না।
দন্ডবিধির ৩০৬ ধারায় আত্মহত্যায় প্ররোচনার শাস্তি দশ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড। কিন্তু ৩০৫ ধারায় আঠার বছরের কম বয়স্ক লোক, পাগল, অবুঝ, মাতাল প্রভৃতি লোককে আত্মহত্যায় প্ররোচনা দিলে এবং সে আত্মহত্যা করে ফেললে ফাঁসিও হতে পারে!
আত্মহত্যায় প্ররোচনা অপরাধ
আত্মহত্যা সমাজের জন্য একটি অভিশাপ। নিমিষেই একটি স্বপ্ন ধূলিস্যাৎ হয়ে যায়। তিলে তিলে কারও স্বপ্ন আশা ভেঙে দিয়ে আত্মহত্যার প্ররোচনা। তীব্র অপমান, তুচ্ছতাচ্ছিল্য, উত্তেজিত করা কাউকে আত্মহত্যায় প্ররোচনা করা অপরাধ
বাংলাদেশের প্রচলিত আইনে আত্মহত্যায় প্ররোচনার সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা পাওয়া যায় না। তবে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ (সংশোধিত ২০০৩) -এর ৯ক ধারায় নারীর আত্মহত্যায় প্ররোচনার শাস্তির বিধান উল্লেখ করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, কোনও নারীর সম্মতি ছাড়া বা ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোনও ব্যক্তির ইচ্ছাকৃত কোনও কার্য দ্বারা সম্ভ্রমহানি হওয়ার প্রত্যক্ষ কারণে আত্মহত্যা করলে, ওই নারীকে অনুরূপ কার্য দ্বারা আত্মহত্যা করতে প্ররোচনা দেওয়া হয়েছে বলা হবে।
আত্মহত্যার প্ররোচনায় শাস্তির ব্যাপারে আইন
বাংলাদেশে প্রচলিত আইনে আত্মহত্যার প্ররোচনা দেয়ার অপরাধে শাস্তির বিধান রয়েছে। তবে এমন অভিযোগ এনে দায়ের করা মামলায় শাস্তিদানের ঘটনা বিরল। আত্মহত্যার প্ররোচনায় বাংলাদেশ দণ্ডবিধি ১৮৬০-এর ৩০৬ ধারা অনুযায়ী, ব্যক্তির আত্মহত্যায় প্ররোচণায় সর্বোচ্চ শাস্তি ১০ বছরের কারাদণ্ড এবং জরিমানা। তবে আত্মহত্যার চেষ্টা করেও যদি ঐ ব্যক্তি মারা না যান তবে প্ররোচনা দানকারী ঐ ব্যক্তির ১ বছরের জেল হতে পারে।
যতজনই প্ররোচনা দিয়ে থাকেন না কেন প্ররোচনাদানকারী সবাইকেই আইনের আওতায় আসতে হবে। এক্ষেত্রে অভিযুক্ত সবাইকেই তাদের ভূমিকা বা অপরাধের গুরুত্ব অনুযায়ী বিভিন্ন মেয়াদে শাস্তি প্রদান করা যেতে পারে।
কোন শিক্ষার্থীকে যদি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে তিরস্কার করা হয় বা মানসিকভাবে হেয় করা হয় অথবা অপমান করা হয়ে থাকে তবে সে শিক্ষার্থীর আত্মহত্যার জন্যও দায়ী হবেন ঐ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকগণ। কোন ঘরের গৃহচারী যদি বুলিং এর কারণে আত্মহত্যা করে তবে তার দায়ও তার মালিকের।
আইনজীবী ও মনস্তত্ত্ববিদেরা বলছেন, আত্মহত্যার প্রবণতা ঠেকাতে সামাজিক সচেতনতার পাশাপাশি বিপর্যস্ত ব্যক্তিকে মানসিক সহায়তা ও চিকিৎসা দরকার।
সংবাদমাধ্যমেরও আত্মহত্যার খবর প্রকাশে দায়িত্বশীল থাকা দরকার। মনোরোগ চিকিৎসক মোহিত কামাল বলেন, আত্মহত্যার সংবাদ প্রচারে নীতিমালা করা জরুরি। এমনভাবে সংবাদ উপস্থাপন করতে হবে, সেটা যেন অন্যকে আত্মহননে উৎসাহিত না করে। মনোবিজ্ঞানী মেহতাব খানমের মতে, নারীদের মধ্যে আত্মহত্যার হার বাড়া এবং বিশেষ করে শিশুসন্তানকে হত্যা করে আত্মঘাতী হওয়ার পেছনে সংবাদমাধ্যমগুলো দায়ী।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রে (আসক) সংরক্ষিত তথ্য অনুযায়ী, এ বছর জানুয়ারি থেকে জুন মাস পর্যন্ত উত্ত্যক্তের শিকার হয়ে ১১ জন নারী আত্মহত্যা করেছে। পারিবারিক নির্যাতনের কারণে আত্মহত্যা করেছে ২৬ জন নারী। নির্যাতনের শিকার হয়ে আত্মহত্যা করেছে এমন গৃহপরিচারিকার সংখ্যা চারজন। এ ছাড়া যৌতুকের কারণে ১২ জন নারী আত্মহত্যা করেছে। ধর্ষণের শিকার হয়ে আত্মহত্যা করে ১১ জন নারী।
লেখক: ফাইজুল ইসলাম; আইন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
তথ্যসূত্র: Ain o Salish Kendra; Bangladesh constitution; Penal Code ,1860; বিচারক মুহাম্মদ তাজুল ইসলাম; প্রথম আলো, ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৩; দৈনিক যায়যায়দিন, ১৭ মার্চ, ২০১৪; The Daily Star, 4 January, 2012.