শাহ্ মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান: অনারারি ম্যাজিস্ট্রেট (Honorary Magistrate) বা অবৈতনিক ম্যাজিস্ট্রেট একটি ঐতিহ্যবাহী ও অতি পুরাতন পদ। ব্রিটিশ ভারত উপমহাদেশে এ পদটি ব্রিটিশ বিচার ব্যবস্থা থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত। এ পদধারীগণ সমাজে অত্যন্ত সম্মানীয় বলে বিবেচিত হয়। জানা যায়, স্থানীয় বা মফস্বল এলাকার কল্যাণের জন্য ১৭২৬ সালে এ পদের সৃষ্টি হয়। অনারারি ম্যাজিস্ট্রেট পদটিকে জাস্টিস অব দি পিসও (Justice of the Peace) বলা হয়। অনারারি ম্যাজিস্ট্রেটগণের ক্ষমতা প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণির হয়। তাঁদের প্রজ্ঞাপনমূলে নিয়োগপত্রে ম্যাজিস্ট্রেসির ক্ষমতার শ্রেণি উল্লেখ থাকে। অনারারি ম্যাজিস্ট্রেটগণের কোর্টকে অনারারি ফৌজদারি কোর্ট বা অনারারি কোর্ট বলে। অনারারি কোর্টে ন্যূনতম ১জন সাব ইন্সপেক্টর, ১ জন অ্যাসিস্ট্যোন্ট সাব ইন্সপেক্টর ও ৩ জন পুলিশ থাকে।
উল্লেখ্য, অনারারি কোর্টের সাংগঠনিক লোকবলের এই সংখ্যাটি তৎকালীন ময়মনসিংহ জেলার মধ্যে সর্বপ্রথম অনারারি কোর্ট শেরপুরের; এখানে ব্রিটিশ শাসনামলের উনিশ শতকের সত্তর দশকে অনারারি কোর্ট ও এ কোর্টের অধীনে দুটি বেঞ্চ চালু হয় এবং তা বিশ শতকের সত্তর দশক পর্যন্ত চলমান ছিল। এখানকার অবৈতনিক ম্যাজিস্ট্রেটগণ অত্যন্ত বিচক্ষণতার ও দক্ষতার সাথে ছোটখাট ফৌজদারি মামলা বিচার করতেন যে, জামালপুর মহকুমার হাকিম এতদঞ্চলের কোনো মামলা পেতেন না। [তথ্যসূত্র : ময়মনসিংহের ইতিহাস : কেদারনাথ মজুমদার ও অন্যান্য। দেজ পাবলিশিং হাউস, কলকাতা। প্রথম প্রকাশ : ২০০৫ , পৃষ্ঠা : ৭২০]
স্থানীয় অঞ্চলের অনারারি ম্যাজিস্ট্রেট বা জাস্টিস অব দি পিসরা পদাধিকার (Ex-officio) অনুযায়ী এ পদে মনোনীত নন, তারা উক্ত পদে The Code of Criminal Procedure, 1898-এর ২২ ধারার বিধান মোতাবেক নিয়োগপ্রাপ্ত। এ পদে তাঁদের নিয়োগ সরকারি গেজেট বিজ্ঞপ্তি আকারে জারি করা হয়। ফৌজদারি কার্যবিধি আইনের ২২ ধারায় বলা হয়েছে :
Justice of the Peace for the mafassal- The Government may, by notification in the official gazette, appoint such persons resident within Bangladesh and not being the subject of any foreign State as it thinks fit to be justice of the Peace within and for the local area mentioned in such notification.
আইনের প্রখ্যাত ভাষ্যকার গাজী শামছুর রহমান (১৯২১-১৯৯৮) তাঁর ‘ফৌজদারী কার্যবিধির ভাষ্য’ (১৯৯৪) গ্রন্থে এ আইনের ২২ ধারার ভাষ্যে লেখেছেন :
জাস্টিস অব দি পিস্ কি দায়িত্ব প্রতিপালন করেন এবং তার অধিকার ও ক্ষমতা কি, সে সব বিষয়ে ফৌজাদরী কার্যবিধিতে কোন বিধান নেই। বিশেষ আইন দ্বারা তাদের দায়িত্ব ও অধিকার নির্ণীত হয়। নিয়োগপত্রে তাদের কর্তব্য এবং অধিকারের বর্ণনা দেয়া যেতে পারে।
[উদ্ধৃতি : ফৌজদারী কার্যবিধির ভাষ্য : গাজী শামছুর রহমান। খোশরোজ কিতাব মহল। চতুর্থ সংস্করণ : ১৯৯৪, ঢাকা। পৃষ্ঠা ৩৭]
আইন কমিশন থেকে প্রকাশিত ‘আইন-শব্দকোষ’ (২০২০) গ্রন্থে অনারারি ম্যাজিস্ট্রেট বা জাস্টিস অব দি পিস সম্বন্ধে বলা হয়েছে :
The code of criminal Procedure, 1898-এর ২২ ধারা অনুসারে সরকারি গেজেট বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করিয়া বাংলাদেশের বাসিন্দা ও কোনো বিদেশি রাষ্ট্রের নাগরিক নহেন, এইরূপ যে-কোনো ব্যাক্তিকে বিজ্ঞপ্তিতে উল্লিখিত কোনো স্থানীয় এলাকার জাস্টিস অভ দি পিস বা অবৈতনিক ম্যাজিস্ট্রেট নিযুক্ত করা যাইতে পারে। এইরূপ ক্ষেত্রে নিয়োগপত্রে তাঁহাদের কর্তব্য ও অধিকারের বর্ণনা দেওয়া হইয়া থাকে।
[উদ্ধৃতি : আইন-শব্দকোষ : বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক ও অন্যান্য, আইন কমিশন, দ্বিতীয় সংস্করণ : মার্চ ২০২০, পৃষ্ঠা ৬৮৬]
ব্রিটিশ শাসিত ভারত উপমহাদেশে, পরবর্তীকালে পাকিস্তান ও বাংলাদেশ আমলেও স্থানীয় এলাকায় আইনের শাসন এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় অবৈতনিক ম্যাজিস্ট্রেটগণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। এই পরিপ্রেক্ষিতে বর্তমান কালেও অনারারি ম্যাজিস্ট্রেট পদের কার্য ও এ পদের গুরুত্ব অপরিসীম।
অনারারি ম্যাজিস্ট্রেটগণ তাঁদের নিজ নিজ অধিক্ষেত্রের মধ্যে দিবারাতি আইন ও ন্যায়বিচার লঙ্ঘন সম্পর্কে অত্যন্ত সজাগ দৃষ্টি রাখেন। অধিক্ষেত্রের মধ্যে আইন-শৃঙ্খলা বা শান্তিভঙ্গের আশঙ্কা থাকলে অনারারি ম্যাজিস্ট্রেটগণ প্রয়োজনীয় কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেন এবং আইন শৃঙ্খলা যথাযথভাবে পালনের জন্য নির্দেশ দিয়ে আদেশ জারি করেন। এ পদটির গুরুত্ব ও কাজ এখনও প্রাসঙ্গিক। অবৈতনিক ম্যাজিস্ট্রেটগণ তাঁর নিজ নিজ অধিক্ষেত্রের ক্ষমতা অনুযায়ী ১টি বা ২টি বেঞ্চের ক্ষমতা প্রাপ্ত হন। তাঁরা এজাহার গ্রহণ করা, অন্য বিচারকের নিকট রেকর্ড দেওয়ার ক্ষমতা, সোপর্দ বা বিচারার্থে প্রেরণ করা, সরাসরি বিচারের ক্ষমতা, বিশেষ করে ফৌজদারি কার্যবিধির ১১০ ধারার বিচারের ক্ষমতাসহ অনেক ছোটখাট এবং লঘু অপরাধের ফৌজদারি বিচারকার্য সম্পন্ন করেন। [তথ্যসূত্র : ময়মনসিংহের ইতিহাস। প্রাগুক্ত। পৃ. ৭১৯-৭২০]
উল্লেখ্য, ফৌজদারি কার্যবিধির ২২ ধারার বিধান অনুযায়ী নিয়োগপ্রাপ্ত অনারারি ম্যাজিস্ট্রেটগণের কার্যাবলি বিষয়ে সুনির্দিষ্ট করে কোনো বিধান ফৌজদারি কার্যবিধি বা অন্য কোনো আইনে নেই। এ জন্য তাঁদের প্রজ্ঞাপনমূলে নিয়োগপত্রের শর্তাদিতে বিশেষ আইনে উল্লিখিত থাকে। ব্রিটিশ আমল থেকে বাংলাদেশ আমলেও এদেশের মানুষ অনারারি ম্যাজিস্ট্রেটগণের বিচারিক অধিক্ষেত্রের কার্যাবলি অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে গ্রহণ করেছিল। এ বিষয়ে ফৌজদারি আদালতের নথিপত্র থেকে অনেক তথ্যাদি জানা যায়। তাঁরা সংক্ষুব্ধ কোনো ব্যক্তির লেখিত অভিযোগ বা পুলিশের প্রদত্ত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে বা অপরাধ সংঘটনে নিজেদের প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে কোনো অপরাধ আমলে নিতে পারেন এবং বিচারিক কার্য সমাধা করেন। তবে অদ্যাবধি ফৌজদারি কার্যবিধির ২২ ধারায় অনারারি ম্যাজিস্ট্রেট-এর ক্ষমতার সীমাবদ্ধতা বা প্রসারতার বিষয়ে কোনো বিধিবিধান উল্লেখ করা হয়নি। এ কারণে ফৌজদারি কার্যবিধির উক্ত ধারার বিধান মোতাবেক বিধি প্রণয়ন করে তাঁদের ক্ষমতা ও দায়িত্ব নির্ধারণ করা প্রয়োজন।
এক্ষেত্রে উক্ত ধারাটি সংশোধনপূর্বক তাঁদের ক্ষমতা ও কার্যাবলি নির্ধারণ করে অনারারি ম্যাজিস্ট্রেটের বিধানটি এখনও স্থানীয় এলাকাতে জারি করা যায়। এই পদটি স্থানীয় এলাকায় যোগ্য ব্যক্তিদেরকে অর্পণ করা গেলে অনেক কল্যাণ বয়ে আনবে। তাই বর্তমান পরিস্থিতিতেও ফৌজদারি কার্যবিধির অনারারি ম্যাজিস্ট্রেটের ধারাটির প্রাসঙ্গিকতা রয়েছে। এ পদটি স্থানীয় বা মফস্বল এলাকায় যোগ্য ব্যক্তিদেরকে প্রদান করা গেলে বা জারি হলে দেশের অভ্যন্তরে ছোটখাট বহু ফৌজদারি মামলা দায়েরের সংখ্যা কমবে। সুতরাং অনারারি ম্যাজিস্ট্রেট পদটি এখনও প্রয়োজনীয় ও সময়োচিত। এ পদের প্রয়োজনীয়তা বর্তমান নিরীক্ষেও উপেক্ষা করা যায় না।
ব্রিটিশ ভারত উপমহাদেশে বেশ কজন অনারারি ম্যাজিস্ট্রেট এদেশের সামাজিক রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিকসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাঁদের অবদান অপরিসীম। তাঁরা এদেশের ঔপনিবেশিক স্বাধীনতা সংগ্রাম থেকে শুরু করে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্র গঠনে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছেন। আজকের গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ রাষ্ট্র তাঁদের অবদানের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। তাঁরা আজ আর কেউ জীবিত নেই। এই পরিপ্রেক্ষিতে এ সমস্ত অনারারি ম্যাজিস্ট্রেটদের জীবন কর্মের মূল্যায়ন করা প্রয়োজন। তাঁরা এদেশের জাতীয় ইতিহাসের বিরাট এক অংশ। বর্তমান প্রজন্ম অনেকেরই অনারারি ম্যাজিস্ট্রেট পদধারী ঐ সকল ব্যক্তিবর্গের কর্ম সম্পর্কে ধারণা নেই। অথচ তাঁদেরই উত্তরাধিকারী বর্তমান বা ভবিষ্যৎ প্রজন্ম, তারা তাঁদেরকে না চিনলে বা না জানলে ক্ষতি তাদেরই।
আজকের বা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের পথকে উজ্জ্বল করার জন্য ঐ সমস্ত অনারারি ম্যাজিস্টেটরা হলেন পথ প্রদর্শক, তাঁদের নিকট জাতির ঋণের শেষ নেই। তাঁদের সম্বন্ধে জানা অপরিহার্য প্রয়োজন। এদেশের ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের অগ্রগামী কর্মী, ইতিহাসের ঘটনাপ্রবাহের তিনটা ঐতিহাসিক সময়-কালের মানুষ মির্জা আশরাফ উদ্দিন হায়দার (১৯০৫-১৯৮৫) হলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম। তিনি ছিলেন একাধারে ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামী, সাংবাদিক, লেখক ও ক্রীড়াবিদ এবং বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রতি আস্থাশীল অসাম্প্রদায়িক মনোভাবাপন্ন উদারপন্থি ব্যক্তি। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে প্রগতিশীল সব আন্দোলনেই যুক্ত ছিলেন। মানবকল্যাণই ছিল তাঁর আদর্শ। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন-মহান ভাষা আন্দোলন-মুক্তিযুদ্ধে তাঁর ভূমিকা অগ্রণী। তিনি বিশ শতকের চল্লিশ ও সত্তর দশকে দুইবার তৎকালীন জামালপুর মহকুমার সে সময়কার শেরপুর থানার এবং পরবর্তীকালে জামালপুর জেলার শেরপুর থানার (বর্তমানে জেলা) প্রথম শ্রেণির অনারারি ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন।
উল্লেখ্য, ব্রিটিশ ভারতের বৃহত্তম জেলা ময়মনসিংহের শেরপুর থানায় উনিশ শতকের সত্তর দশকে সর্বপ্রথম অনারারি কোর্ট চালু হয়েছিল। এ অঞ্চলে প্রথম শ্রেণির ক্ষমতাপ্রাপ্ত একজন অনারারি ম্যাজিস্ট্রেটের এবং তাঁর অধীনে নিয়মিত ২টি বেঞ্চ অনেক বছর ধরে চলেছিল। বর্তমান শেরপুর জেলার ফৌজদারি আদালত ঐতিহ্যবাহী অনারারি কোর্টের উত্তরাধিকার বহন করছে। মির্জা আশরাফ উদ্দিন হায়দারকে ঐতিহ্যবাহী তৎকালীন শেরপুর থানার অনারারি কোর্ট ও নিয়মিত দুটি বেঞ্চের অনারারি ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে এতদঅঞ্চলের ফৌজদারি মামলার ভার অর্পণ করা হলে, তিনি সুষ্ঠু ও ন্যায়বিচার করেন। অনেকে স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে তাঁর প্রতি বিচারের ভার দিলে তা তিনি অত্যন্ত নিরপেক্ষভাবে নিষ্পত্তি করে দিতেন। এতদঞ্চলের ছোটখাট বিরোধ তিনি ব্যক্তিগত প্রভাব খাটিয়ে উভয় পক্ষের লোকদের ডেকে সালিশির মাধ্যমে বিষয়টি সুষ্ঠু মীমাংসা করে দিতেন। তাঁর এ ব্যবস্থা সরকারের ব্যবস্থার মতোই কার্যকর হতো। তিনি অনারারি ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে তৎকালীন জিলা ও মহকুমার ম্যাজিস্ট্রেটকে ফৌজদারি মামলার নিরপেক্ষ রিপোর্ট প্রদান করতেন। একজন নিরপেক্ষ অনারারি ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে সমকালে তাঁর খ্যাতি ছিল। এ কারণে সমকালের জিলা ও মহকুমা ম্যাজিস্ট্রেটসহ সরকারের উচ্চ পর্যায়ের নিকট তাঁর উচ্চ মর্যাদা ছিল। এই অভিজ্ঞতাই পরবর্তীকালে তাঁর দ্বারা সমাজের বিভিন্ন কল্যাণকর কাজ সম্পন্ন করতে সহজ হয়।
অনারারি ম্যাজিস্ট্রেটের কার্য ছাড়াও মির্জা আশরাফ উদ্দিন হায়দারের মূল্যায়নের ধারা বিভিন্ন সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে প্রকাশ পায়। ব্রিটিশ সরকার সমকালে তাঁকে ইউনিয়ন বোর্ড (বর্তমান ইউনিয়ন কাউন্সিল), বেঞ্চ কোর্ট ও স্পেশাল ঋণ শালিশি বোর্ডের চেয়ারম্যান নিযুক্ত করে। তিনি সুষ্ঠু ও সফলভাবে সেসব দায়িত্ব পালন করেছিলেন।
উল্লেখ্য, ঋণগ্রস্ত কৃষককুলকে সাহায্য করার জন্য ১৯৩৬ সালের ৭ নম্বর আইনের অধীনে ঋণ সালিশি বোর্ড স্থাপিত হয়। এই বোর্ড পাঁচ বছরের জন্য স্থাপিত হয়েছিল এবং পরে এর কার্যকাল আরও দুবছরের জন্য বাড়ানো হয়। তৎকালীন জামালপুর মহকুমার বিভিন্ন অঞ্চলে তিনি ঋণ সালিশি বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসেবে ঋণগ্রস্ত কৃষক সমাজকে কিছুটা হলেও রক্ষা করেছিলেন।
মির্জা আশরাফ উদ্দিন হায়দার এদেশের প্রগতিশীল রাজনীতিতে বিরাট অবদান রেখেছেন। তিনি ব্রিটিশ বিরোধী, সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলনে আজীবন সংগ্রামী ছিলেন। বিশ শতকের দ্বিতীয় ও তৃতীয় দশকের দিকে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামের বহু ধরনের ঘটনা ঘটে- তিনি এসব ঘটনায় বিরাট ভূমিকা রেখেছেন। তিনি ছাত্রজীবনেই প্রগতিশীল ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েন। তাঁর সময়কালে জামালপুরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব খুব কম ছিল। জামালপুর ডানো হাইস্কুল (বর্তমানে জিলা স্কুল) ছাড়া আর কোনো স্কুলের অস্তিত্ব ছিল না। ময়মনসিংহ জিলা স্কুলই ছিল সে সময় একমাত্র ভরসা। তিনি এ স্কুলেই ভর্তি হয়ে পড়াশোনা করতে থাকেন। তিনি মেধাবী ছাত্র ছিলেন। স্কুলের খেলাধুলা-সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতায় তাঁর সফল অংশগ্রহণ ছিল। সে সময় ময়মনসিংহ জিলা স্কুলে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের অনেক কর্মীদের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। তিনি বিপ্লবী যুগান্তর দলসহ প্রগতিশীল ছাত্র আন্দোলনের সাথে জড়িয়ে পড়েন। ফলে তাঁর পড়াশোনা বিঘœ ঘটে। ফলে আসন্ন ম্যাট্রিক পরীক্ষায় অংশ না নিয়ে দেশের ডাকে তিনি ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে যুক্ত হয়ে পড়েন। রাজনৈতিকভাবে সচেতন ছিলেন তিনি। কংগ্রেসের কর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ ও এ অফিসে যাতায়াত করতেন তিনি। বিভিন্ন রাজনৈতিক কার্যকলাপে তাঁর সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল। সভা, শোভাযাত্রা, হরতাল, বিক্ষোভ, প্রতিবাদ-প্রতিরোধে তিনি সোচ্চার ভূমিকা পালন করেছিলেন। বিশ শতকের বিশ-ত্রিশ-চল্লিশ দশকের অবিভক্ত বাংলার প্রগতিশীল রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সঙ্গে তাঁর পরিচয় ছিল। ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চলে তিনি দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের সঙ্গী ছিলেন এবং বিভিন্ন মিছিল-মিটিং শোভাযাত্রায় নেতৃত্ব দিয়েছেন। এদের মধ্যে অনেকেরই তিনি সান্নিধ্য লাভ করেছেন। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের (১৮৭০-১৯২৫) রাজনীতির অনুরাগী ছিলেন তিনি। এ সকল নেতৃবৃন্দের সঙ্গে তাঁর পত্রালাপ হয়েছে। দেশবন্ধুকে তিনি তার রাজনৈতিক নেতা হিসেবে পরম শ্রদ্ধা করতেন।
মিছিল, শোভাযাত্রা, পিকেটিং করতে গিয়ে ধরা পড়েছেন কয়েকবার সঙ্গীসহ তাকে পুলিশে গাড়িতে উঠানো হয়েছে। নির্যাতনের পর ছাড়া পেয়েছেন তিনি। এরকম একাধিকবার সাম্রাজ্যবাদী ঔপনিবেশিক সরকারের জুলুম, অত্যাচার, নির্যাতনের শিকার হয়েছেন তিনি। বিশ শতকের বিশের ত্রিশের ভারতবর্ষের বিক্ষুব্ধ সময়ের ঘটনাবলি তাঁকে আলোড়িত করেছিল। এ সময় ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন তুঙ্গে উঠেছিল। এর কারণ আর কিছু নয়, ইংরেজ সরকারের শাসন, শোষণ, নির্যাতন, নিপীড়ন। এ সময় মহাত্মা গান্ধীজীর (১৮৬৯-১৯৪৮) নেতৃত্বে সত্যাগ্রহ ও অসহযোগ আন্দোলন অবিভক্ত বাংলাসহ সারা ভারতবর্ষে বেগবান হয়। সে সময় ভারতবর্ষের বিশেষ করে অবিভক্ত বাংলায় যে অগ্নিমূর্তি ধারণ করেছিল বঙ্গভঙ্গের (১৯০৫) সময়েও তা হয়নি। এই অগ্নিযুগের চালচিত্র ঔপনিবেশিক দলিলপত্রে প্রমাণ পাওয়া যায়। ব্রিটিশরা ভারতবর্ষের স্বাধীনতা ছিনিয়ে নেবার পর এই সময়েই স্বাধীনতার জন্য সাধারণ মানুষের মধ্যে আকাক্সক্ষা তীব্র হয়ে ওঠে। জাতীয় মুক্তির সংগ্রাম পূর্ণাঙ্গরূপ লাভ করে। সে সময় ব্রিটিশ সরকারের জোর জুলমের বিরুদ্ধে সত্যাগ্রহ (১৯৩০) ও অসহযোগ আন্দোলনে (১৯২০-১৯২২) মুসলমান, হিন্দু, শিখ সকলেই অংশগ্রহণ করেছিল। অবিভক্ত বাংলাসহ ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চলে বহু স্বাধীনতা সংগ্রামী অমূল্য জীবন উৎসর্গ করেছেন।
মির্জা আশরাফ উদ্দিন হায়দার গান্ধীজীর অসহযোগ আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। তিনি ছাত্র অবস্থায় রাজনীতির সঙ্গে দীর্ঘ সময় যুক্ত থাকায় দীর্ঘ বিরতির পর আবার লেখাপড়া শুরু করে কিছুটা দেরিতে ম্যাট্রিক (১৯৩৯) (বর্তমানে এইচ এসসি) পাস করেন, শেরপুরের বর্তমানে গোবিন্দকুমার পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় মতান্তরে বকশিগঞ্জের রূপাজাহান পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় থেকে। অতঃপর ময়মনসিংহের আনন্দমোহন কলেজ থেকে আইএ (১৯৪১) (বর্তমানে এইসএসচি) এবং একই কলেজে বিএ (১৯৪২-’৪৩) ক্লাসে ভর্তি হন। এ সময় দেশে দুর্ভিক্ষ চলেছিল। এই দুর্ভিক্ষ ইংরেজি ১৯৪৩ এবং বাংলা ১৩৫০ সালে সংঘটিত হয়। মির্জা আশরাফ উদ্দিন হায়দার উক্ত পঞ্চাশে ঘটিত মন্বন্তরে ত্রাণকার্যে সক্রিয়ভাবে জড়িয়ে পড়েন। তিনি বিএ পরীক্ষার সন্নিকটের সময় একাডেমিক ডিগ্রির দিকে আগ্রহী না হয়ে ময়মনসিংহ অঞ্চলের ত্রাণ কার্যের জেনারেল সেক্রেটারির দায়িত্ব পালন করেন। এ দায়িত্ব পালনের কারণে কলেজ কর্তৃপক্ষ সেসময় আসন্ন বিএ পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ না দিয়ে এক তরফাভাবে তাঁকে অকৃতকার্য ঘোষণা করা হয়। পরে তিনি আবার লেখাপড়া করে এ কলেজ থেকেই বিএ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। [তথ্যসূত্র : ময়মনসিংহের চরিতাভিধান : দরজি আবদুল ওয়াহাব। ময়মনসিংহ জেলা প্রশাসন। প্রথম প্রকাশ : ১৯৮৯, পৃ. ১৩৭]
মির্জা আশরাফ উদ্দিন হায়দার পাকিস্তান আন্দোলনেও বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন। তিনি বাঙালি জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে পাকিস্তান আন্দোলনকে সমর্থন দিয়েছিলেন। পরবর্তী পর্যায়ে যখন বাঙালির আত্মনিয়ন্ত্রণের প্রশ্নের দ্বন্দ্ব সম্মুখে এসে দাঁড়ালÑ তখন তিনি পূর্ব বাংলার গণমানুষের গণতান্ত্রিক চেতনার লড়াইয়ে যুক্ত ছিলেন। তিনি ভয়-ডরহীনভাবে মাথা উঁচু করে চলতেন, কারও মন জুগিয়ে চলেননি কখনো। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয়ের নেপথ্যে সহযোগিতা এবং সহানুভূতি তাঁর ছিল। [তথ্যসূত্র : ময়মনসিংহের চরিতাভিধান, প্রাগুক্ত]
তিনি জোতদার পরিবারের সন্তান হওয়ায় উত্তরাধিকারসূত্রেই প্রচুর ভূ-সম্পত্তির অধিকারী ছিলেন। তিনি সম্পদের উপযুক্ত ব্যবহার করেছেন। সকল মানুষের মাঝেই তাঁর গ্রহণযোগ্যতা ছিল। তিনি ছিলেন বড় হৃদয়ের মানুষ। তৎকালীন জামালপুর অঞ্চলে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উন্নয়নে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকত। তাঁর সমকালে এ অঞ্চলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অভাব ছিল। এ অঞ্চলে কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার কাজে অন্যতম উদ্যোক্তা ছিলেন তিনি। তাঁর কর্মের মধ্যে ইহাই তাঁর জীবনকে প্রোজ্জ্বল করে রয়েছে। তিনি বকশিগঞ্জের রূপজাহান পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়, জামালপুর উচ্চ বিদ্যালয়, আশেক মাহমুদ কলেজ প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানের ছিলেন অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য এবং উদ্যোক্তা। এছাড়াও অপরাপর প্রতিষ্ঠানে শ্রম ও মেধা দিয়ে সহযোগিতা করেছেন, গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন।
মির্জা আশরাফ উদ্দিন হায়দার এ অঞ্চলের মানুষের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয় ব্যক্তি ছিলেন। এলাকার মানুষ তাঁকে মির্জা সাহেব বলে সম্বোধন করত। এখনও তাঁর নাম এ অঞ্চলে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে। তিনি জামালপুরের মানুষ, মাটিকে খুব ভালোবাসতেন। তাঁর হাত ধরেই জামালপুর শহরে বিদ্যুৎ ও পানির সরবরাহ আসে। তিনি ১৯৫৯ সালে জামালপুর শহরে বেসরকারিভাবে ইলেক্টিক সাপ্লাই কোম্পানি, ওয়াটার ওয়ার্কস্ স্থাপনের মাধ্যমে এ শহরের পানি, বিজলি বাতির ব্যবস্থা করে বিরাট অবদান রেখেছেন। তিনি ১৯৬০ থেকে ১৯৬৫ পর্যন্ত জামালপুর পৌরসভার (প্রতিষ্ঠাকাল ১৮৬৯) নির্বাচিত ভাইস চেয়ারম্যান (বর্তমানে মেয়র) ছিলেন। উল্লেখ্য, সে সময় এদেশে বিতর্কিত মৌলিক গণতন্ত্র জারি ছিল। সেই হিসেবে এ অঞ্চলের মহকুমা ম্যাজিস্ট্রেট পদাধিকার বলে চেয়ারম্যান হতেন এবং ভাইস-চেয়ারম্যান নির্বাচিত হতেন জনসাধারণ কর্তৃক সরাসরি ভোটে নির্বাচিত কমিশনারবৃন্দের (তখন মেম্বার, বর্তমানে কাউন্সিলর) ভোটে; দীর্ঘ পাঁচ বছর কাল তিনি উক্ত পদে আসীন থেকে অনেক উন্নয়নমূলক কাজ সম্পাদন করেছেন। সে সময় যুগ-সভ্যতার সেবা পৌর নাগরিকদের ঘরে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্বভার দক্ষতার সাথে পালন করেছিলেন। তাঁর সময়ে বিভিন্ন দিকে পৌরসভার উন্নতি হয়েছে। শহরের পাবলিক লাইব্রেরি, স্টেডিয়াম, প্রতিষ্ঠায় তিনি উদ্যোগী ভূমিকা পালন করেছেন। তাঁর কর্মকালে ১৯৫৯ সালের বিতর্কিত মৌলিক গণতন্ত্র জারি থাকা সত্ত্বেও তিনি পৌরসভার নিরপেক্ষ উন্নয়নে অনেক মঞ্জুরি করেছিলেন তা পৌরসভার নানা উন্নয়নের কাজে লাগিয়েছেন।
মির্জা আশরাফ উদ্দিন হায়দার এ অঞ্চলের অর্থনীতির উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন। জামালপুর সেন্ট্রাল কো-অপারেটিভ ব্যাংকের (সমকালের সরকার কর্তৃক অনুমোদিত সমবায়ী সদস্যদের একটি অর্থলগ্নী প্রতিষ্ঠান) প্রতিষ্ঠাতা যুগ্ম সম্পাদক ছিলেন তিনি। দি জামালপুর কমার্শিয়াল ট্রেনিং কলেজ নামে তিনি এখানে প্রথম টাইপিং শটহ্যান্ড এবং টেলিগ্রাফি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। তিনি সমকালে সরকার কর্তৃক অনুমোদিত সমবায়ী উদ্যোগে গড়ে তোলা অর্থলগ্নী প্রতিষ্ঠান জামালপুর সাব ডিভিশন সেন্ট্রাল কো-অপারেটিভ মালটি পারপাস সোসাইটি লি. এর ভাইস চেয়ারম্যান ও পূর্বপাকিস্তান কো-অপারেটিভ ইউনিয়ন লি. এবং জামালপুর সেন্ট্রাল কো-অপারেটিভ ব্যাংক লি. এর ডিরেক্টর ছিলেন। সম্মিলিত উদ্যোগে গড়ে তোলা এসব প্রতিষ্ঠানের অগ্রণী ভূমিকা তিনিই রেখেছেন। তিনি এ অঞ্চলে সমবায়ী প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার ক্ষেত্রে পথিকৃৎ।
জামালপুর মহকুমাকে জেলায় উন্নীত করার নেপথ্যে তাঁর ভূমিকা উল্লেখ করার মতো। তিনি জামালপুরকে জেলা করার জন্য গঠিত নাগরিক কমিটির সেক্রেটারির দায়িত্ব পালন করেছিলেন। জামালপুর শহরের রেল স্টেশনের নাম সিংহজানি জংশন হতে জামালপুর টাউন জংশন নাম পরিবর্তনে অগ্রণী ভূমিকা রাখেন। ১৯৫৯ সালের বিতর্কিত মৌলিক গণতন্ত্রের আদর্শের বলে তদানীন্তন জিলা বোর্ডকে নতুন আঙ্গিকে ডিস্ট্রিক কাউন্সিল করা হলে তিনি ময়মনসিংহ ডিস্ট্রিক কাউন্সিলের (বর্তমানে জেলা পরিষদ) একজন নিরপেক্ষ কাউন্সিলর হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন।
মির্জা আশরাফ উদ্দিন হায়দারের খেলাধুলায় সুনাম ছিল। তিনি একজন দক্ষ খেলোয়াড় ছিলেন। খেলাধুলার উচ্চ সমঝদারিত্ব করতেন তিনি। তখন এ অঞ্চলে ফুটবল, হা-ডুডু খেলায় সারা বছর মুখর থাকত। জাতীয় দলের ক্রীড়াবিদদের পদচারণা ছিল। তিনি জাতীয়, বিভাগীয় পর্যায়ে ফুটবল খেলায় অংশ নিয়েছেন। এ অঞ্চলে ফুটবল টিম নিয়ে আসা এবং তাঁদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে খেলাকে জনপ্রিয় করে তোলেন। তখন এখানে তাঁর নেতৃত্বে কয়েকটি ফুটবল ক্লাব গড়ে ওঠেছিল। তিনি এসব ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক সংগঠন উন্নয়নে অবদান রাখেন। তিনি ফুটবলের অত্যন্ত অনুরাগী এবং ফুটবল প্রিয় ব্যক্তি ছিলেন।
ব্রিটিশ ভারত উপমহাদেশের একাধিক ফুটবল ঐতিহ্যের গৌরব গাঁথার সাক্ষী ছিলেন তিনি। বাঙালি ফুটবলের গৌরব গাঁথা তিনি মুখে মুখে বলতে পারতেন। তাঁর সময়কার আন্তর্জাতিক ফুটবল দল ছিল ইংল্যান্ডের আইলিংটন কোরিন্থিয়ান। এ দলটি আধুনিক ফুটবলের পথিকৃৎ। এ দলের ঢাকার খেলাটির তিনি অতিথি দর্শক ছিলেন। ১৯৩৭ সালের ২১শে নভেম্বর পৃথিবী বিখ্যাত এ দলটির সাথে নবগঠিত ঢাকা স্পোটিং অ্যাসোসিয়েশন দলের এক খেলা হয়েছিল। ঢাকার পল্টন মাঠের এ খেলায় ঢাকা কলেজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও জগন্নাথ কলেজের ক’জন শিক্ষার্থী ছিল। এ খেলায় অংশ নেওয়া পাখি সেন (আসল নাম বি.সেন) তখন জগন্নাথ কলেজের ছাত্র। তিনি অলৌকিক একটি গোল করে বাঙালি দলের খেলোয়াড়দের বিজয় নিশ্চিত করেছিলেন। এই খেলার একটি বিখ্যাত বর্ণনার অংশ বিশেষ হলো : ‘মন্টু ঘোষ বল নিয়ে দৌড়–চ্ছেন। কোরিন্থিয়ানরাও ছুটছেন মন্টু ঘোষের পেছনে। মন্টু হঠাৎ বল ঠেলে দিলেন পেছনে দাঁড়ানো পাখি সেনকে। বিপক্ষ দলের কোনো খেলোয়াড় ছিলেন না তাঁর কাছে। গোলকিপারও বলের গতি আঁচ করতে পারেননি। পাখি সেন মওকা মতো বল পেয়ে বল ঢুকিয়ে দিয়েছেন গোলে। ঢাকার মাঠের কয়েক হাজার দর্শকের সে কী উল্লাস! যেন আনন্দের বন্যা বয়ে যাচ্ছে’। [তথ্যসূত্র : দুনিয়া মাতানো বিশ্বকাপ : শামসুজ্জামান খান, প্রথম প্রকাশ, ১৯৮৭, বাংলা একাডেমি, ঢাকা, পৃষ্ঠা ১২]
বাঙালির ফুটবল গৌরব গাঁথার এটি স্মরণীয় ঘটনা। এ খেলায় ব্রিটিশ দল ঢাকা স্পোটিং অ্যাসোসিয়েশনের কাছে পরাজয় বরণ করে। মির্জা আশরাফ উদ্দিন হায়দার ঐতিহাসিক এ খেলাটি অতিথি দর্শক হিসেবে সামনে সারিতে বসে দেখার স্মৃতি চলচ্চিত্র-নাটকের সংলাপের মতো মুখে মুখে বলতে পারতেন। ফুটবলের প্রসঙ্গ এলে তিনি এই স্মরণীয় খেলাটির কথা বলতেন। আজও অনেকে তাঁর নিকট থেকে শোনা এ খেলার আনন্দময় স্মৃতিচারণ করেন।
সাহিত্যের প্রতি তাঁর গভীর অনুরাগ ছিল। তাঁর লেখালেখির হাত ছিল। তিনি কবিতা লেখতেন। উপন্যাস ও ভ্রমণকাহিনিও লেখেছেন। সাংবাদিকতার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ১৯৫০ সালে জামালপুর থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক ‘তৌফিক’ পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন তিনি। ১৯৬৭ সালে ‘ঝিনাই’ নামে একটি সাহিত্য সাময়িকী অত্যন্ত দক্ষ হাতে সম্পাদনা তিনিই করেছিলেন। [তথ্যসূত্র : রজতজয়ন্তী স্মরণিকা। জামালপুর জেলা। প্রকাশ ২০০৩। পৃ. ৪৭]
তিনি প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন সমবায় প্রেস, আমেনা প্রেস। তাঁর আমেনা প্রেস থেকে গোলাম মোহাম্মদের ‘বন্দিনী’ নামক উপন্যাস এবং জামালপুরের গণইতিবৃত্ত’সহ ঐ সময়কার এ অঞ্চলের কবি-সাহিত্যিক অনেক গ্রন্থ ও পত্রপত্রিকা এবং সাময়িকী প্রকাশিত হয়েছে। পাকিস্তানি দুঃশাসনের ষাটের বাঙালির গণতান্ত্রিক আন্দোলনে তাঁর প্রতিষ্ঠিত ছাপাখানা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এ অঞ্চলের স্বাধিকার আন্দোলন-সংগ্রামের পোস্টার, লিফলেট, হ্যান্ডবিল, আইয়ুব বিরোধী জারি ও গণসংগীতের পুস্তিকা তাঁর প্রেস থেকেই ছাপা হতো। তাঁর প্রেস ও পত্রিকা পাকিস্তানি শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে জনমত তৈরিতে ব্যাপক অবদান রেখেছে। বিশশতকের পঞ্চাশ-ষাট-দশকের পূর্ববাংলার তৎকালীন প্রগতিশীল অনেক রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সঙ্গে তাঁর পরিচয় ও যোগাযোগ ছিল। বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের (১৯২০-১৯৭৫) সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত যোগাযোগ ও পরিচয় ছিল। এসকল প্রগতিশীল রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ জামালপুরে এলে তাঁরা কোনো না কোনো সময় তাঁর সমবায় ও আমেনা প্রেসে এসেছেন।
মির্জা আশরাফ উদ্দিন হায়দারের সাহিত্যচর্চা সাংবাদিক জীবনেই উন্মেষ ঘটেছিল। তাঁর রচিত দুটি গ্রন্থ- ‘আসামের জঙ্গলে’ (ভ্রমণ কাহিনি) ও উপন্যাস ‘মায়ার ভিটা’ প্রকাশিত হয়েছিল। এছাড়া তাঁর লেখা অপ্রকাশিত কবিতার পা-ুলিপি ছিল। তিনি জামালপুর সাহিত্য সম্মেলন, ১৯৫৩ অনুষ্ঠানের সেক্রেটারি জেনারেল ছিলেন।
মির্জা আশরাফ উদ্দিন হায়দার সৃষ্টিশীল, আলোকিত ও প্রজ্ঞাবান ব্যক্তি ছিলেন। তিনি সন্তানদের যোগ্য মানুষ হিসেবে গড়ে তুলেছিলেন। তিনি একজন সফল পিতা। তাঁর পুত্র-কন্যা-পৌত্রগণকৃতী ও সফল। তাঁর কন্যা আঞ্জুমান আরা জামান বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে ১৯৬৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমএ ডিগ্রিধারী এবং তিনি ছিলেন জামালপুর থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমএ ডিগ্রিধারী দ্বিতীয় নারী। বর্তমান বাংলাদেশের দন্তের পথিকৃৎ চিকিৎসক ফখরুজ্জামানের সঙ্গে তাঁর বিবাহ হয়। আঞ্জুমান আরার লেখালেখির হাত ছিল এবং বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সাথে যুক্ত ছিলেন। মির্জা আশরাফ উদ্দিন হায়দারের জ্যেষ্ঠপুত্র মির্জা আলী হায়দার (মৃত্যু : ২২.০৩.২০১৭) ছিলেন প্রখ্যাত চিকিৎসক এবং ইউনিভার্সিটি ডেন্টাল কলেজ ও হাসপাতালের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ট্রাস্টি এবং কনিষ্ঠপুত্র বিচারপতি মির্জা হোসেইন হায়দার বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের আপীল বিভাগের অন্যতম জ্যেষ্ঠ বিচারক (অবসর গ্রহণ : ২৮.০২.২০২২) ছিলেন।
মির্জা আশরাফ উদ্দিন হায়দারের পৌত্রী বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ, লেখক সামাই হায়দার আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন একজন পরিব্রাজক। তিনি অর্থনীতিবিষয়ে উচ্চশিক্ষা সম্পন্ন করেন। তিনি প্রায় পঞ্চাশটির অধিক দেশ ভ্রমণ করেছেন। ভ্রমণবিষয়ে তিনি আন্তর্জাতিক পত্রপত্রিকা ও সাময়িকীতে নিয়মিত লেখেন। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থ : ‘টিলমাউন্ডস ট্রাভেল টেলস’ (২০২০) বিখ্যাত। মির্জা আশরাফ উদ্দিন হায়দারের পরিবারের অপরাপর সদস্যগণও কীর্তিমান এ পরিবারের অনেক সুসন্তানের জন্ম হয়েছে- যাঁরা নানাক্ষেত্রে অবদান রাখছেন।
মির্জা আশরাফ উদ্দিন হায়দারের মূল্যায়নের জন্য একজন লোকের উপযুক্ত হওয়াই যথেষ্ট। অথচ দেখা যায় তাঁর সন্তান-সন্তুতির মধ্যে কয়েকজন যোগ্যতার দিক থেকে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছেন। বাংলাদেশে এ রকম বৈশিষ্ট্য খুব কম পরিবারেই রয়েছে। মির্জা আশরাফ উদ্দিন হায়দারের কৃতিত্বের মূল্যায়ন সম্পর্কে প্রখ্যাত সাংবাদিক এএকে মাহমুদুল হাসান খান দারার [(জ. ১৯৩৫) দারামিয়া] উক্তি প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছেন :
‘মির্জা আশরাফ উদ্দিন হায়দার এতদঞ্চলের অত্যন্ত উঁচু মাপের সামাজিক মানুষ ছিলেন। শিল্প-সাহিত্যের সমঝদারি করতেন, একজন সংস্কৃতিমান মানুষ ছিলেন। তাঁর ছেলে-মেয়েরা যোগ্যতার দিক থেকে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছেন। এই বৈশিষ্ট্য খুব কম পরিবারেই রয়েছে। আশরাফ উদ্দিন হায়দারের পরিবার সম্পর্কে বলে শেষ করা যাবে না।’
বর্তমানে তাঁর মতো উচ্চ সামাজিক মনস্কপ্রগতি ধারাটি লুপ্ত হয়ে যেতে বসেছে, তাঁকে অনুসরণে তা আবার উজ্জীবিত হতে পারে।
এই বিখ্যাত ব্যক্তি ১০ই জুন ১৯৮৫ সালে ইন্তেকাল করেন। তিনি ১৯০৫ সালে তৎকালীন বৃহত্তর ময়মনসিংহের অন্তর্গত জামালপুর মহকুমার বকশিগঞ্জে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম জোতদার পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তাঁর পিতার নাম মির্জা আসাদ উদ্দিন হায়দার ও মাতার নাম তৈবুননেসা। তিনি ছিলেন দুই ভাইবোনের মধ্যে জ্যেষ্ঠ।
মির্জা আশরাফ উদ্দিন হায়দার একজন বড় মাপের সামাজিক মানুষ হয়েও এ অঞ্চলে তিনি বিপুলভাবে অবহেলিত। তাঁর যথাযথ মূল্যায়ন আজও করা হয়নি। তাঁর মৃত্যুবার্ষিক নিরবেই প্রায় অতিক্রান্ত হয়, কেউ স্মরণ করে না তাঁর কর্মকীর্তিকে। বর্তমান প্রজন্ম তাঁর নাম তেমন জানেন না। একটি জাতি বড় হয় অতীতকে জেনেই। অথচ প্রজন্মের পর প্রজন্ম চলে যাচ্ছে- এক প্রজন্মের কর্ম অন্য প্রজন্মের কাছে পৌঁছানো যাচ্ছে না। মির্জা আশরাফ উদ্দিন হায়দারের কর্ম, চিন্তাধারা এ দেশের জাতীয় ইতিহাসের অংশ। তার জীবন ও কর্মের প্রাসঙ্গিকতা সমকালে যেমন ছিল বর্তমান কালে অব্যাহত আছে এবং ভবিষ্যতে তেমনি থাকবে। তিনি যে কাজ করেছেন সে জন্য তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা-সম্মান-মূল্যায়নের উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। অন্তত জামালপুর শহরের একটি প্রধান সড়ক তাঁর নামে নামকরণ করার মাধ্যমে তাঁর স্মৃতিকে জাগরূক রাখা যায়। শহরের একটি সড়ক ‘মির্জা আশরাফ উদ্দিন হায়দার সড়ক’ বা তাঁর স্মৃতিবিজড়িত শহরের আমলাপাড়ায় ‘মির্জা আশরাফ উদ্দিন হায়দার স্মৃতিসড়ক’ নামকরণের জন্য জামালপুরের জেলা পরিষদের প্রশাসক, পৌরসভার মেয়র, জেলা প্রশাসকসহ সংশ্লিষ্টদের প্রতি দাবি জানাই। তবেই আমরা শিক্ষিত জাতি হিসেবে গর্ব করতে পারব। বাংলাদেশের ইতিহাস-ঐতিহ্যে মির্জা আশরাফ উদ্দিন হায়দার ও তাঁর পরিবারের অবদান শ্রদ্ধার সাথে স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
(লেখাটি তৈরিতে বিচারপতি মির্জা হোসেইন হায়দার স্যারের নিকট থেকে দুষ্প্রাপ্য কিছু তথ্য সংগ্রহ করা গেছে। স্যারের প্রতি সশ্রদ্ধ কৃতজ্ঞতা জানাই।)
লেখক : গবেষক