কামরুজ্জামান পলাশ: প্রাচীন গ্রীসের বিখ্যাত দার্শনীক এরিস্টটল বলেছেন, “মানুষ তার সর্বোচ্চ পর্যায়ে সকল প্রাণীকূল হতে উত্তম; কিন্তু তখনই নগন্য হয়ে যায়, যখন সে আইন ও ন্যায় বিচার হতে আলাদা হয়ে যায়।”
আইন অঙ্গন ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় মানবজাতি একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কেননা একজন সুস্থ মস্তিষ্কের অধিকারী ব্যক্তি ও একজন প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি সাক্ষ্য প্রদান, কিংবা মামলা করা বা মামলার বিবাদী পক্ষ হতে পারেন।
আমাদের দেশে প্রচুর মামলার জট হয়েছে। অধিকাংশ মামলার বিচার এখনও প্রক্রিয়াধীন বা পেন্ডিং রয়েছে শুধুমাত্র সাক্ষীদের অনুপস্থিতির কারণে। মানুষ সাক্ষ্য দেয়া থেকে বিরত থাকে কেননা তাদের নিরাপত্তা প্রদানের আদৌ কোন প্রকার আইন নেই। যদি কোন সাক্ষী কোন প্রকার হুমকি বা প্রভাবিত বা প্রতিশোধমূলক আচরণের সম্মুখীন হয়, তাহলে তাদের নতুন করে একটি অভিযোগ দায়ের করতে হয়, যেহেতু এখন অবধি চলমান বা এক্সিস্টিং বিচার প্রক্রিয়ায় (ট্রায়াল) অভিযুক্তের শাস্তির কোন প্রকার বিধান নেই। তাই নতুন করে অভিযোগ দায়ের অনেক কষ্টসাধ্য ও সময় সাপেক্ষ হয়ে উঠে। তাই অধিকাংশ সাক্ষী সাক্ষ্য দেয়া থেকে বিরত থাকে।
ভারতে প্রচুর পরিমাণ সড়ক দূর্ঘটনা ঘটে। কিন্তু কোন প্রকার সাক্ষী পাওয়া যায়না, কেননা কোন ব্যক্তিই তাদেরকে সমস্যায় জড়াতে চান না। তারা সাক্ষ্য প্রদান করার মাধ্যমে অনিরাপত্তায় ভূগেন। তাই অধিকাংশ মামলা অমীমাংসিত রয়ে যায়। বাংলাদেশের চিত্রটা ও অভিন্ন বলা যায়।
চলতি বছরের ৫ ফেব্রুয়ারি দৈনিক দেশ রুপান্তর সাক্ষী নিরাপত্তা আইনের গুরুত্ব তুলে ধরে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। যার মধ্যে কিছু ঘটনা হচ্ছেঃ
লায়লা বেগম একটি হত্যা মামলার সাক্ষী ছিলেন। পরবর্তীতে লায়লা বেগম অভিযুক্ত দ্বারা খারাপভাবে জখম হন এবং মারা যান। অভিযুক্ত উক্ত হত্যা মামলায় গ্রেফতার হন।
পীর আলী একটি মামলার সাক্ষী ছিলেন। তিনি আদালতে সাক্ষ্য প্রদান না করতে হুমকির সম্মুখীন হন , যা পরিপ্রেক্ষিতে তিনি থানায় একটি সাধারন ডায়েরী বা জিডি করেন। পরবর্তীতে তার মৃতদেহ পাওয়া যায়। তার আত্মীয় স্বজনের অভিযোগ, তিনি আদালতে সাক্ষ্য প্রদানের কারনেই তার(পীর আলী) এই পরিনতি।
আমরা যদি উন্নত দেশগুলোর দিকে তাকাই, তাহলে দেখতে পাই যে, তারা ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য মামলার সাক্ষীদের নিরাপত্তা প্রদান করে আসছে। যেহেতু মামলায় সাধারণত চার ব্যক্তিকে প্রধান অংশ হিসেবে ধরা হয়। তারা হচ্ছেন- বিচারক, অভিযোগকারী, অভিযুক্ত ও সাক্ষী। এসব ব্যক্তিদের সাহায্য ছাড়া ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। তাই উন্নত বিশ্ব তাদের নিরাপত্তা রক্ষার্থে উল্ল্যেখযোগ্য ব্যবস্থা গ্রহণ করছে।
যুক্তরাষ্ট্রে (ইউএসএ) সাক্ষী কিংবা ভিকটিম বা অভিযোগকারীকে প্রভাবিত করাকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়। জাস্টিস ম্যানুয়েলের মতে, “সাক্ষীকে প্রভাবিত করা একটি অপরাধ যদিও এটি চলমান মামলা (পেন্ডিং) নয় এবং যদি সাক্ষী যদি প্রভাবিত ধরা হয়ে থাকে, তাহলে তার সাক্ষ্য আদালতে সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহনযোগ্যতা (এডমিসিবিলিটি)পাবে না।”
যদিও প্রভাবিত করার পদক্ষেপ ব্যর্থ হয়, সেটিকে অপরাধ হিসেবেই গন্য করা হবে। কেননা এটি শুধুমাত্র সাক্ষীকে ভয় দেখানো নয়, বরং সাক্ষীর সাথে অন্য ব্যক্তিকে (আত্মীয়, স্বজন) ভয় দেখানোর অন্তর্ভূক্ত।
এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে যুক্তরাষ্ট্রে (ইউএসএ) “ভিকটিম এবং উইটনেস্ প্রটেকশন এ্যক্ট ১৯৮২” ধারা-১৫১২ প্রণয়ন করা হয়। উক্ত ধারায় সাক্ষী সহ ভিকটিম ও অভিযোগকারীকে প্রভাবিত করার কথা উঠে এসেছে। এই ধারায় বলা হয়েছে যে, যদি কেউ সাক্ষী সহ ভিকটিম বা অভিযোগকারীকে প্রভাবিত করে বা করার চেষ্টা করে তাহলে উক্ত ব্যক্তি $২৫০০০০(দুই লক্ষ পঞ্চাশ হাজার) ডলার অর্থদন্ডে বা ১ (এক) বছর কারাদন্ডে বা উভয়দন্ডে দন্ডিত হবেন।
“ভিকটিম এবং উইটনেস্ প্রটেকশন এ্যক্ট ১৯৮২” ধারা-১৫১৩ তে সাক্ষী সহ ভিকটিম ও অভিযোগকারীকে প্রতিশোধমূলক আচরন করার কথা উঠে এসেছে।এই ধারায় বলা হয়েছে যে, যদি কেউ সাক্ষী সহ ভিকটিম বা অভিযোগকারীর প্রতি প্রতিশোধমূলক আচরন করে বা করার চেষ্টা করে তাহলে উক্ত ব্যক্তি $২৫০০০০(দুই লক্ষ পঁঞাশ হাজার) ডলার অর্থে দন্ডে বা ১০(দশ) বছর কারাদন্ডে বা উভয়দন্ডে দন্ডিত হবেন।
যুক্তরাজ্য ও ওয়েলস্ এ সাক্ষী সহ ভিকটিম বা অভিযোগকারীর প্রতি প্রতিশোধমূলক আচরণ করাকে আপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়। যাই হোক, সাক্ষী সহ ভিকটিম বা অভিযোগকারীর প্রতি প্রতিশোধমূলক আচরণ “ক্রিমিনাল জাস্টিস এন্ড পাব্লিক অর্ডার এ্যক্ট ১৯৯৪” এর ধারা-৫১ অনুযাযী একটি দন্ডনীয় অপরাধ। সাক্ষী সহ ভিকটিম বা অভিযোগকারীর প্রতি প্রতিশোধমূলক আচরণ হতে রক্ষার্থে “সিরিয়াস অর্গানাইজড্ ক্রাইম এন্ড পুলিশ এ্যক্ট -২০০৫” প্রণয়ন করা হয়।
আন্তর্জাতিক ক্রিমিনাল কোর্ট (আইসিসি) এ ২০০৬ সালে কঙোর ডেমক্রেটিক রিপাব্লিক রাজনৈতিক দলের রাজনীতিবিদ জ্যান-পিয়্যারা ব্যাম্বা কে সাক্ষীকে প্রভাবিত করার দায়ে সাজা দেয়া হয়।
অন্যান্য দেশের ন্যায় আমরাও এধরনের আইন গ্রহণ করতে পারি। যেখানে সাক্ষী কিংবা ভিকটিম বা অভিযোগকারীকে হুমকি প্রদান করলে তারা নতুন করে মামলা না করে চলমান বিচারিক মামলা (এক্সিস্টিং ট্রায়াল)তে একটি দরখাস্ত (পিটিশন) দিতে পারেন। দরখাস্তটি পাবার পর বিজ্ঞ বিচারিক আদালত উক্ত দরখাস্তের সত্যতা যাচাইয়ের জন্য তদন্তের নির্দেশ দিতে পারেন এবং যদি অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায় তাহলে চলমান বিচারিক মামলা (এক্সিস্টিং ট্রায়াল) তে অভিযুক্তকে সাজা প্রদান করতে পারেন।
এভাবেই চলমান বিচারিক আদালতে সাজা প্রদানের বিধানের মাধ্যমে মামলা সংখ্যা কমে যাওয়ার পাশাপাশি বহু মামলা (মাল্টিপ্লিসিটি অব কেসেস) কমানো সম্ভব হবে।
অন্যান্য দেশের ন্যায় আমাদের দেশেও বিচারিক কার্যক্রম মসৃণ করে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে সাক্ষী সহ ভিকটিম ও অভিযোগকারীর নিরাপত্তা রক্ষার্থে আইন প্রণয়ন করা উচিত। কেননা নতুন করে মামলা করা খুবই কষ্টসাধ্য ও কিছু নিয়ম এবং প্রবিধান অনুসরণ করা সময় সাপেক্ষও বটে। বিচারপ্রার্থীর দ্রুত সম্ভব ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হবে। কেননা উইলিয়াম গ্লাডস্টোন তার বিখ্যাত উক্তিতে বলেন, “Justice delayed is Justice denied.”
লেখক: কামরুজ্জামান পলাশ; শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ, ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি।